ইউক্রেন পরমাণু অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করছিল?
ইউক্রেন পরমাণু অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করছিল? - ছবি : সংগ্রহ
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ১ মার্চ জেনেভায় পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে বলেছিলেন যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির শাসন তার প্রতিবেশী দেশ এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কারণ কিয়েভ তাদের নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পরিকল্পনায় জড়িত, আর এই বিপজ্জনক খেলা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুরু থেকেই রাশিয়া এটা বলে আসছে যে পারমাণবিক হামলার হুমকির কারণেই তাদের ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে হয়েছে। ল্যাভরভ সম্মেলনে আরো বলেছিলেন যে ইউক্রেনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতিগুলিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা উচিত। কারণ ইউক্রেনের কাছে সোভিয়েত জমানার পারমাণবিক প্রযুক্তি এবং এই অস্ত্র সরবরাহের উপায় রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একজন দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে রাশিয়া পরমাণু অপ্রসারণ চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই পারমাণবিক অস্ত্র এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির উত্থান রোধে ইউক্রেনে প্রতিটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে রাশিয়া।
একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ইউক্রেন ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ করেছিল। এখন, রাশিয়া আক্রমণ করার পর অনেক ইউক্রেনীয় ভাবছে যে ওই চুক্তি করা ভুল ছিল। পরমাণু অস্ত্র থাকলে রাশিয়া হামলা চালাতে সাহস পেত না। এই অনুমানের উপর ভিত্তি করেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দেশগুলি খুব কমই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যায়, কারণ এতে পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংসের আশঙ্কা থাকে। রাশিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার ফলে বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম নামে একটি পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি হয়েছিল। সেই সময় ইউক্রেন পশ্চিমি দেশের আর্থিক সহায়তায় নিজের পারমাণবিক অস্ত্রাগার, সরবরাহ ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সম্মত হয়েছিল। ইউক্রেনের পরমাণু অস্ত্র পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্তটি তিন বছর ধরে আলোচনার পরে নেয়া হয়েছিল। বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও রাশিয়া ইউক্রেনকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তান যখন পরমাণু অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে ওঠে তখন ইউক্রেনের এই সিদ্ধান্ত নজর কাড়ে, বিশ্বব্যাপী প্রশংসাও পেয়েছিল তারা।
শীতল যুদ্ধের শেষে, ইউক্রেনের পছন্দ
১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর ইউক্রেন ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতার পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯০ সালে সার্বভৌমত্বের ঘোষণা করে তারা যা সোভিয়েত রাশিয়ার ভেঙে যাওয়ার ঠিক এক বছর আগে। একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ঘোষণা ছিল যে ইউক্রেন একটি অ-পরমাণু, পারমাণবিক অস্ত্র-মুক্ত রাষ্ট্র হতে চায়। ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত রাশিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে একটি ছিল। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল বিপর্যয়ের সময় ইউক্রেনের পারমাণবিক অস্ত্রের কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল মস্কোতে। তৎকালীন ইউক্রেনীয় নেতারা আশঙ্কা করেছিলেন যে এটি তাদের স্বাধীনতার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর অবশ্য ইউক্রেনের মেজাজ বদলে যায়। তারা এখন বিশ্বাস করে যে স্বাধীনতার জন্য পরমাণু ত্যাগ করা প্রয়োজন ছিল না। সেই সময়ে, ইউক্রেনের কাছে ১৭৬টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল, ৪৪টি ক্রুজ মিসাইল সজ্জিত কৌশলগত বোমারু বিমান ছিল। উপরন্তু, ছিল ২ হাজার ৬০০ কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র। কিন্তু প্রশ্নটি তখন ওঠে যে এই অস্ত্রের মালিকানা কার কাছে থাকবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসাবে রাশিয়ার কাছে থাকবে, না কি ইউক্রেন বা বেলারুশ বা কাজাখাস্তানের কাছে থাকবে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইলের দীর্ঘ পরিসরের পরিপ্রেক্ষিতে অস্ত্রাগারের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি ছিল মাথায়। অস্ত্র ধরে রাখার অর্থ হল ইউক্রেন NPT-র বাইরে একটি পারমাণবিক রাষ্ট্র হবে। P5 দেশ ব্যতীত অন্যান্য স্বাক্ষরকারীদের অ-পারমাণবিক রাষ্ট্র হতে হবে অথবা পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দিতে হবে)। ইউক্রেন, যারা ইউরোপের অংশ হতে চেয়েছিল তারা নিষেধাজ্ঞা এবং বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করতে চায়নি।
বুদাপেস্টে চুক্তি
১৯৯৪ সালের শুরুর দিকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি করে ইউক্রেন। বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম নামে পরিচিত ওই চুক্তিতে সই করেছিল রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে আত্মরক্ষা ব্যতীত কোনও দেশই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যবহার করবে না এবং সবাই দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে সম্মান জানাবে। চুক্তিতে আরও বলা ছিল, আগ্রাসন হলে ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য চুক্তিকারীরা জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীরা ছিলেন ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিওনিড কুচমা, মার্কিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন এবং ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর পরে চীন এবং ফ্রান্সও স্বাক্ষর করে। তবে সবটাই ছিল একটি আশ্বাস ছিল, কোনো নিরাপত্তা গ্যারান্টি নয়। বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামটি ১৯৯২ সালের লিসবন প্রোটোকলের পরে এসেছিল। এটি ইউক্রেন, বেলারুশ এবং কাজাখাস্তানের মধ্যে প্রথম কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস চুক্তি। পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯১ সালে।
বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে ইউক্রেন তার মাটিতে থাকা সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। ইউক্রেনও কঠিন দর কষাকষি করতে সক্ষম হয়েছিল। রাশিয়া তার প্রতিবেশীকে ১ বিলিয়ন ডলারের অর্থ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং ইউক্রেনের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ কেনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিশাল অর্থ দিয়েছে। যদিও ইউক্রেনের উদ্বেগ অব্যাহত ছিল কারণ রাশিয়া নতুন আন্তর্জাতিক সীমানা পুরোপুরি মেনে নেয়নি। রাশিয়া ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ভ্লাদিমির পুতিন ১৯৯৯ শেষের দিকে বরিস ইয়েলৎসিনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে প্রথম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন পুতিন। তিনি সরসারি এই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন। পুতিনের অভিযোগ ছিল, আমেরিকা নিজেকে আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করছে এবং একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।
ক্রিমিয়ার সংযুক্তি থেকে ইউক্রেন আক্রমণ: ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করা রাশির জন্য বুদাপেস্ট চুক্তির একটি সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ইউক্রেনের নিরাপত্তা আশ্বাসের প্রথম বড় পরীক্ষা। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী হওয়া সত্ত্বেও মস্কো আলোচনায় অংশ নেয়নি এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে সংযুক্তির বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাবে ভেটো দেয়। রাশিয়ার উপর আমেরিকা কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ইউরোপের দেশগুলো তার সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০১৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসে সিনেট কমিটি অফ ফরেন রিলেশনের উপর একটি আলোচনা রাশিয়ার প্রসঙ্গ উঠে আসে। সেই আলোচনা একে অপরের প্রতি মার্কিন ও রাশিয়ায় মনোভাবের প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করেছিল। মার্কিন প্রশাসনের সিনিয়র কর্তা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড রাশিয়াকে রোখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলিছেন, "ইউক্রেনকে তার সীমানা আরও ভালভাবে সুরক্ষিত করতে, বাহিনীকে আরও নিরাপদে এবং কার্যকরভাবে মোতায়েন করতে এবং সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৬০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমরা ১ হাজার ৭০০ ইউক্রেনীয় সেনা এবং ন্যাশনাল গার্ড কর্মীকে, ১২০ জন স্পেশাল অপারেশন ফোর্সের কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমরা কাউন্টার আর্টিলারি এবং কাউন্টার-মর্টার রাডার, ৩ হাজারেরও বেশি সুরক্ষিত রেডিও, ১৩০টি হুমভি, ১০০টিরও বেশি সাঁজোয়া গাড়ি এবং হাজার হাজার মেডিকেল কিট প্রদান করেছি। যাতে ইউক্রেনীয় সেনারা সাফল্যের সঙ্গে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত করতে পারে।" তিনি আরও বলেন, "রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসন মোকাবিলা করতে, যে কোন সামরিক পদক্ষেপের বাধা দিতে গত ২ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগীরা ন্যাটোর পূর্ব প্রান্ত বরাবর সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে।"
মার্কিন প্রশাসনের ওই ঘোষণা প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে অশনী সঙ্কেত ছিল। তাঁর আশঙ্কা, রাশিয়াকে ঘিরে ফেলার দিকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির বিদেশ বিষয়ক কমিটির প্রধান সিনেটর আন্দ্রেই এ ক্লিমভ গত সপ্তাহে বলেছেন, "দেশকে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করার কথা বলেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তার ওই বিবৃতি লাল রেখা অতিক্রম করছে।" এখন পুতিন রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীকে তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই পদক্ষেপটি পশ্চিমের আক্রমনাত্মক বিবৃতির প্রতিক্রিয়া হিসাবে ন্যায়সঙ্গত বলেই মনে হচ্ছে। যেহেতু রাশিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিনগুলি মহড়ায় অংশ নিয়েছিল, তাই অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে পুতিন কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। তবে পাল্টা অনেকেই দাবি করছেন যে পুতিন এত দূর যাবেন না।
সূত্র : নিউজ ১৮