ইউক্রেন থেকেই রাশিয়ার জন্ম!
ইউক্রেন থেকেই রাশিয়ার জন্ম! - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যেকার উত্তেজনা এখন এক চরম নাটকীয় মোড় নিয়েছে। পুরো ইউক্রেনই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে রাশিয়া। ইতোমধ্যেই রুশ বাহিনী বেশ ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
'ইউক্রেন প্রকৃতপক্ষে কোন রাষ্ট্র নয়'
অভিযান শুরুর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। যে কথাটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে তা হলো- পুতিন বলেছেন - ইউক্রেন কোনো দিনই প্রকৃত অর্থে একটা রাষ্ট্র ছিল না।
তিনি এর আগেও বলেছেন, এখন যা ইউক্রেন তা আসলে 'প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড।'
পুতিনের কথায়- আধুনিক যুগের এই ইউক্রেন আসলে সম্পূর্ণতই বলশেভিক কমিউনিস্ট রাশিয়ার সৃষ্টি।
"১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং লেনিন ও তার সহযোগীরা রাশিয়ার ঐতিহাসিক ভূখণ্ডকে ভাগ করে ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে সবচেয়ে খারাপভাবে এ কাজটা করেছিলেন" - বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেছেন, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সময় মিখাইল গর্বাচেভের দুর্বল সরকারের কারণেই ইউক্রেন স্বাধীন হবার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল।
সত্যিই কি তাই? এ যুগের ইউক্রেন রাষ্ট্র কি আসলে একটা অবাস্তব কল্পনা - যেমনটা পুতিন বলছেন?
ইতিহাস কী বলে?
প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ইতিহাস বহু শতাব্দী ধরেই এক সাথে জড়িয়ে আছে এবং সেই ইতিহাস অত্যন্ত জটিল।
রাশিয়া ও ইউক্রেন- উভয়েরই প্রধান ধর্ম অর্থোডক্স খ্রিস্টান। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং খাদ্য - এগুলো একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ অতি প্রাচীন শহর, এবং রুস জনগোষ্ঠীর একসময়ের রাজধানী। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাশিয়ার বর্তমান রাজধানী মস্কোর চেয়েও কয়েক শতাব্দী আগে ।
রুশ এবং ইউক্রেনীয় - উভয় জনগোষ্ঠীই দাবি করে থাকে কিয়েভই হচ্ছে তাদের আধুনিক সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার মূল কেন্দ্র।
তবে এখন যা ইউক্রেন- তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে এই যে গত এক হাজার বছরে তাদের সীমান্ত, ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর প্রকৃতি বার বার পরিবর্তিত হয়েছে।
'কিয়েভের রুশ'
ইউক্রেন আর রাশিয়ার অভিন্ন উৎসের সবচেয়ে পুরোনো খোঁজ পাওয়া যায় ইউরোপের ওই অঞ্চলে স্লাভ জনগোষ্ঠীর প্রথম রাষ্ট্রের ইতিহাসে।
সেটা ছিল মধ্যযুগের এক সাম্রাজ্য - যার নাম 'কিয়েভান রুস' - আর এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল নবম শতাব্দীতে ।
বর্তমান ইউক্রেন, বেলারুস এবং রাশিয়ার অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই কিয়েভান রুস। আজ পর্যন্ত এই তিন দেশই দাবি করে যে কিয়েভান রুসই হচ্ছে তাদের সাংস্কৃতিক পূর্বপুরুষ।
"কিয়েভান রুস" কথাটির সরল অর্থ হলো "কিয়েভের রুসদের আবাসভূমি।"
তাদের রাজধানী ছিল কিয়েভ, আর এই রাজ্যের অধিবাসীদের বলা হতো রুস।
এই কিয়েভান রুসের প্রতিষ্ঠাতা ছিল ভাইকিংরা - যারা এ যুগের উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা সুইডেন-নরওয়ে-ডেনমার্ক অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর লোক। রুশ জাতির আদি উৎস নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে, কেউ বলেন- রুশদের আদি পূর্বপুরুষরা ছিল সুইডেনের, আবার আরেক দল ইতিহাসবিদ মনে করেন এটা ঠিক নয়, রুশরা হচ্ছে স্লাভ জনগোষ্ঠীর বংশধর।
জটিল উত্থানপতনের ইতিহাস
কিয়েভ শহরটির অবস্থান এমন এক জায়গায় -যেখান দিয়ে নবম-দশম শতাব্দীতে অনেকগুলো প্রাচীন বাণিজ্যিক পণ্য চলাচলের পথ গড়ে উঠেছিল। ইউক্রেনের ভূ-প্রকৃতিরও আছে অনেক বৈচিত্র্য। এখানে আছে কৃষিজমি, বনভূমি আর কৃষ্ণসাগর হয়ে নৌচলাচলের পথ।
তাই বিভিন্ন সময় বহু যোদ্ধা জনগোষ্ঠীর দখলে ছিল এই এলাকাটি।
এটাও ঠিক যে আধুনিক ইউক্রেনের কিছু অংশ বহু শতাব্দী ধরে রুশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।
কিন্তু ইউক্রেনের অন্য কিছু অঞ্চল আবার বিভিন্ন সময় অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, পোল্যান্ড বা লিথুয়ানিয়ারও অংশ ছিল। ইউক্রেনের ভূখণ্ড উসমানিয়া তুর্কদেরও দখলে ছিল কিছু সময়ের জন্য।
কিন্তু এর মধ্যে আবার বিভিন্ন সময় এমন কিছু দৃষ্টান্তও আছে যখন সাময়িকভাবে হলেও ইউক্রেন রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দেখা গিয়েছিল- যেমন সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউক্রেনীয় কসাকদের স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য।
ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস দৈনিকের এক রিপোর্টে বলা হচ্ছে - ইউক্রেনকে অনেক রুশই দেখে থাকেন তাদের জাতির "ছোট ভাই" হিসেবে, এবং মনে করেন ইউক্রেনীয়দের আচরণও সেরকমই হওয়া উচিত।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবেরও অনেক আগে দেশটিতে যখন কয়েক শতাব্দী ধরে জারের শাসন চলছিল - তখন থেকেই ইউক্রেনীয়দের জাতীয়তাবাদ এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের রাজনীতি রাশিয়ায় নানা সমস্যা তৈরি করছিল।
সেন্ট পিটার্সবুর্গে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে বলশেভিক বিপ্লব হয় - তার পর ক্রাইমিয়াসহ ইউক্রেনের এক বড় অংশ রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র গঠনের কয়েকটি চেষ্টা করে । ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে এক যুদ্ধবিক্ষুব্ধ এবং চরম বিশৃঙ্খল সময়ে সেই স্বাধীন ইউক্রেন গঠনের চেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি।
লেনিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার স্বাধীন ইউক্রেন গঠনের চেষ্টাকে দমন করে। ইউক্রেনের বেশির ভাগ ভূখণ্ডই সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে পশ্চিম ইউক্রেনের কিছু অংশ পোল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া আর রোমানিয়ার মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ইউক্রেনের নাম হয় ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক।
বলা যায়, আজকের ইউক্রেনের মানচিত্র তৈরি হয়েছে রুশ বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই । কিন্তু ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ এবং নিজস্ব রাষ্ট্র পাবার আকাঙখা বা প্রয়াস তার অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছিল।
ইউক্রেনের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার ব্যাপারে সবসময়ই রুশ শাসকরা সচেতন ছিল। একে ঠেকানোর চেষ্টায় জারদের শাসনের সময় ইউক্রেনের রুশী-করণের জন্য নানারকম আইনও হয়েছিল।
সোভিয়েত শাসনের সময় সেখানকার স্কুলে ইউক্রেনীয় ভাষাও শেখানো হতো না।
অবশেষে সাত দশকেরও বেশি সময় পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার মধ্যে দিয়ে ১৯৯১ সালে জন্ম হয় স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্রের।
ইউক্রেন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আগস্ট মাসে, আর সে বছরের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে সে দেশের জনগণ বিপুলভাবে এর পক্ষে রায় দেয়।
সূত্র : বিবিসি