কম বয়সী দম্পতিদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব : কারণ ও সমাধান
কম বয়সী দম্পতিদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব : কারণ ও সমাধান - ছবি : সংগ্রহ
বন্ধ্যাত্বের সমস্যা বিশ্বে দ্রুতহারে বাড়ছে। বন্ধ্যাত্বের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে পরিবেশ, জীবনযাত্রার ধরন এবং নানা রোগ।
এছাড়াও আজকাল কম বয়সী অর্থাৎ ২০ বা ৩০ বছর বয়সী দম্পতিদের মধ্যেও বন্ধ্যাত্ব মারাত্মক আকার নিয়েছে। বন্ধ্যাত্ব নারী ও পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। চিকিৎসকেরা বলেন যে, সন্তান ধারণে অক্ষম নারী ও পুরুষের সংখ্যা একই রকম। ধূমপান, অত্যধিক অ্যালকোহল সেবন, স্থূলতা এবং পরিবেশ দূষণকারী পদার্থের সংস্পর্শের মতো পরিবেশগত এবং জীবনযাত্রার কারণগুলো পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের কারণ হিসেবে যুক্ত হয়েছে, ফলে সঠিক সময়ে একজন বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞের পরামর্শের প্রয়োজন আছে।
কম বয়সীদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের বিষয়ে আমরা কথা বলেছিলাম কলতাতার নোভা আইভিএফ ফার্টিলিটি ইস্টের ফার্টিলিটি কনসালটেন্ট ডাক্তার অনিন্দিতা সিংয়ের সঙ্গে। তিনি কম বয়সীদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের কারণ ও সমাধান সম্পর্কে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, ‘আমরা সবসময় বিশ্বাস করি বন্ধ্যাত্ব এমন একটি বিষয় যা বয়স্ক দম্পতিদেরই শুধু মোকাবিলা করতে হয়, তবে এটি সত্যি নয়। জীবনের যেকোনো সময়ে বন্ধ্যাত্বের সমস্যা আসতে পারে, এমনকী আপনি যদি অল্পবয়সী হন তাহলেও!’
কম বয়সী মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের কারণ : যদিও এটা সত্যি যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সন্তান ধারণ ক্ষমতা কমে যায়, তবে ২০ ও ৩০ বছর বয়সী নারীরাও নিম্নলিখিত কারণে সমস্যার মুখে পড়তে পারেন-
১) গাইনোকোলজিকাল অবস্থা : যে নারীরা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে ভুগছেন তাদের প্রজনন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ওভারিয়ান রিজার্ভ সময়ের আগেই পড়ে যেতে পারে, ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকেজ, জরায়ু গহ্বরের অস্বাভাবিকতা যেমন পলিপ বা ফাইব্রয়েডও প্রজনন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
২) লাইফস্টাইল ফ্যাক্টর : ধূমপান এবং অতিরিক্ত ওজন বা কম ওজনের মতো সমস্যাগুলো বয়স নির্বিশেষে মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।
৩) জেনেটিক অস্বাভাবিকতা : যদি কোনো মহিলার জেনেটিক অস্বাভাবিকতা থাকে বা পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের অকাল মেনোপজ, এন্ডোমেট্রিওসিস ইত্যাদির মতো সমস্যার ইতিহাস থাকে, তাহলে তার ২০ বছর বয়সেই প্রজননের সমস্যা হতে পারে।
৪) অব্যক্ত বন্ধ্যাত্ব : কখনো কখনো বন্ধ্যাত্বের জন্য কোনো সুস্পষ্ট কারণ শনাক্ত করা যায় না, এই ধরনের ক্ষেত্রে একে অব্যক্ত বন্ধ্যাত্ব বলা হয়।
অল্পবয়সী মহিলাদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের উপসর্গ : অস্বাভাবিক, অনিয়মিত বা বেদনাদায়ক পিরিয়ড হলে কোনও মহিলার বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভোগার ঝুঁকি রয়েছে। ঋতুচক্রের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি আরো বড় উপসর্গ হতে পারে। এছাড়াও কিছু অন্যান্য লক্ষণ যা একজন মহিলার নজর দেওয়া উচিত তা হল ব্রন, সেক্স ড্রাইভে পরিবর্তন, চুল পড়া এবং ওজন বৃদ্ধির মতো সমস্যা। বন্ধ্যাত্বের অন্যান্য উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে যৌনাঙ্গে বেদনা এবং স্তনের বোঁটা থেকে দুধের মতো সাদা স্রাব ক্ষরণ।
যুবকদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের কারণ : অল্পবয়সী পুরুষরা বন্ধ্যাত্ব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন যখন তাদের শুক্রাণুর সংখ্যা কম বা শুক্রাণুর গতিশীলতা কম থাকে। কিছু পুরুষের অস্বাভাবিকভাবে শুক্রাণু তৈরি হয় বা তাদের শুক্রাণু নালী ব্লক হয়ে যায়। অণ্ডকোষে আঘাত বা কিছু রাসায়নিকের কারণেও শুক্রাণুর সংখ্যা সাময়িকভাবে কমে যেতে পারে।
যুবকদের মধ্যে বন্ধ্যাত্বের উপসর্গ : পুরুষদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব মহিলাদের তুলনায় আরো জটিল। চুলের বৃদ্ধির পরিবর্তন এবং যৌন ইচ্ছার পরিবর্তনের মতো ছোটখাটো পার্থক্য পুরুষদের সম্ভাব্য বন্ধ্যাত্বের উপসর্গ হতে পারে। অল্পবয়সী পুরুষ, যারা ইরেকশন এবং বীর্যপাতের সমস্যায় ভুগছেন তারা ভবিষ্যতে প্রজনন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। তাছাড়া ছোট ও শক্ত অণ্ডকোষ বা অণ্ডকোষে ব্যথা ও ফোলাও বন্ধ্যাত্বের উপসর্গ হতে পারে।
অল্প বয়সে প্রজনন সমস্যা মোকাবিলা করার সময় যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে :
১) শরীরের ওজন : এটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্যই প্রয়োজ্য। একটি উপযুক্ত ওজন থাকা গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে।
২) পুষ্টিকর খাবার : খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন যেমন জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে যাওয়া এবং পুষ্টিগুণে ভরা খাবার খাওয়া এক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
৩) অতিরিক্ত ব্যায়াম : ওজন কমানোর চেষ্টা করলে তা পরিমিতভাবে করতে হবে। অত্যন্ত জোরালো ব্যায়ামের রুটিনে হিতে বিপরীত হতে পারে।
৪) স্ট্রেস : আজকের জীবনের চাপে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা খুব সহজ। যাই হোক, এটি শুধুমাত্র শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নয়, বরং প্রজনন ক্ষমতার ওপরও প্রভাব ফেলে। তাই যখনই সম্ভব বিরতি নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। ধ্যান এবং যোগব্যায়াম করতে হবে।
৫) জীবনধারা : ধূমপান এবং মদ্যপান এড়িয়ে চলতে হবে, পর্যাপ্ত ঘুমও অত্যন্ত প্রয়োজন। একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গর্ভধারণের সম্ভাবনাকে উন্নত করবে। প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানোই কিন্তু যথেষ্ট নয়, একই সঙ্গে তাড়াতাড়ি ঘুমানো এবং তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মেলাটোনিন নামে একটি হরমোন অন্ধকারে মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত হয়, এটি উর্বরতা নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং, সঠিক সময়ে ঘুমোলে মেলাটোনিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা প্রাকৃতিক উর্বরতাকে উন্নত করে।
বন্ধ্যাত্বের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়ার বয়স হয় না : অনেক সময় অল্পবয়সী দম্পতিরা ১২ মাস ধরে গর্ভধারণ করতে সফল না হওয়া সত্ত্বেও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ তারা মনে করেন আরও সময় আছে। অনেকে আবার অন্যের কথায় প্রভাবিত হন। যাই হোক, বন্ধ্যাত্বের জন্য খুব কম বয়স বলে কিছু হয় না। তাই অবৈজ্ঞানিক গবেষণা বা মিথ্যা ধারণার উপর নির্ভর করা ছেড়ে দিতে হবে।
যদি ১২ মাস ধরে গর্ভধারণের চেষ্টা করা হয় এবং সফল না হওয়া যায়, তবে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এরপর যাবতীয় টেস্ট করানো উচিত। বন্ধ্যাত্বের উপসর্গ আছে এমন অল্পবয়সী দম্পতিদের এক্ষেত্রে অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই বন্ধ্যাত্বের সুচিকিৎসা করতে পারেন একজন ইনফার্টিলিটি ফিজিশিয়ান বা বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যাবে, জটিলতা কম হবে।
চিকিৎসা পদ্ধতি
মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব : বন্ধ্যাত্বের কারণ জানার পরে চিকিৎসা শুরু হয়। বন্ধ্যাত্বের জন্য পরীক্ষাগুলি হল- এগ ফার্টিলাইজেশন পরীক্ষা, হিস্টেরোসালপোগ্রাফি, হরমোন পরীক্ষা ইত্যাদি। ডিম্বাশয়, এর নালী ও জরায়ুর সমস্যা দেখতে ল্যাপারোস্কোপি রয়েছে। এ ছাড়াও চালু হয়েছে স্টেম সেল থেরাপি।
পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব : পুরুষদের মধ্যে বন্ধ্যাত্ব সনাক্ত করতে বীর্য পরীক্ষা, টেস্টিকুলার বায়োপসি, স্ক্রোটাল আল্ট্রাসাউন্ড, জেনেটিক টেস্ট এবং পোস্ট-ইজাকুলেটরি ইউরিনালাইসিস করতে হয়। শুক্রাণু উৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যা হলে আগে এর কারণ খুঁজতে হবে। যদি দেখা যায় যে স্পার্ম তৈরি হচ্ছে কিন্তু কোনো বাধা থাকার জন্যে তা বেরোতে পারছে না, সেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করে ব্লকেজ সারানো হয়। ওষুধের সাহায্যে স্পার্মের সংক্রমণ দূর করা যায়। প্রস্রাব চেপে রাখলে সংক্রমণ ও তার থেকে শুক্রাণুর সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
আইভিএফ : এই প্রক্রিয়াটি ফার্টিলাইজেশন , ভ্রূণের পরিপক্কতা, রোপন, গর্ভাবস্থায় সহায়তা করে।
সূত্র : নিউজ ১৮