এমনটি কি হতে পারে না?
সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশন - ছবি : সংগ্রহ
বাংলাদেশে শেষ ভ্রমণে গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই একজন বাবার বয়সের ভিক্ষুক নজর কেড়ে নিলেন। রাস্তার এক পাশে বসে মনের আনন্দে গানের সুরে বলছেন, 'মনে বড় আশা ছিল যাবো মদিনায়। সালাম আমি করব গিয়ে নবীর রওজায়।' ভিক্ষুক বাবার কন্ঠে গানের ছন্দে এমনটি কথা শুনে থমকে গেলাম। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভিক্ষুক বাবা তুমি কি সত্যিই মদিনায় যেত চাও? উত্তরে তিনি বললেন, 'নারে বাবা গান গাইয়ে মানুষের কাছতে কিছু পয়সা চাইতেছি।' আমার কাছে বাংলাদেশী টাকা ছিল না, তো ২০ ডলার তিনাকে দিতেই পুলিশ ভিক্ষুক বাবার উপর লাঠি চার্জ করলেন। আমি পুলিশ ভাইকে বললাম, বয়স্ক লোক মারার দরকার নেই। পুলিশ ভাই বললেন, 'এখানে ভিক্ষা করা নিষেধ সত্ত্বেও বিদেশী পেলেই তাল-বাহানা করে।'
আমি অনেক দিন পর দেশে এসেছি, বিষয়টি হয়ত হৃদয়ে লেগেছিল। তাই ভিক্ষুক বাবাকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করে বেশ দূরে নিয়ে এলাম। ভিক্ষুক বাবা শুধু বললেন 'বাবা এ কোন দেশের টাকা?' বললাম, আমেরিকান। অল্প সময়ের মধ্যেই বললেন, 'যাক আজ আর ভিক্ষা না করলেও সমস্যা নেই। পুলিশ ঝামেলা না করলে ইনকাম একটু বেশি হয় এখানে। বিদেশ থেকে যারা আসে তাগের পটাতে একটু সহজ হয়। কিন্তু পুলিশের অত্যাচারে একটু ভিক্ষা করব তাও ঠিক মত হয় নারে বাবা!'
এদিকে আমাকে যারা নিতে এসেছে তারা কিছুটা বিরক্ত বোধ করছে ভিক্ষুকের আচরণ দেখে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। আমি বিমানবন্দর ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। যেতে যেতে পথে ভাবনার জগতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভিক্ষুক বাবার কথা বেশ মনে পড়তে লাগল! ভিক্ষুক বাবার মনের বাসনায় হয়ত মদিনা যাবেন, সেটা মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। তবে কিছু অর্থ সঞ্চয় করবেন- এ আশা তার মনে বিরাজ করছিল তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশবাসীর কাছে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সংবিধানের আলোকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের মাধ্যমে এই কমিশন গঠন করা হবে। এর ফলে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ প্রণীত হয়েছে এবং আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন।
অনেকের ধারণা ভিক্ষুক বাবার মতো নতুন নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। আমরাও আশা করি, নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা তাদের দায়িত্ব–কর্তব্য সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন; দেশের মানুষ যাতে ভোটের মাধ্যমে তাঁদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন, সে বিষয় সুনিশ্চিত করবেন।
কারো মনের বাসনা নতুন কমিশনে বুদ্ধিজীবী বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী এবং আরো একজন নারী থাকলে ভালো হতো। অনেকে বিরোধী দলগুলোকে নতুন কমিশনারদের সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কেউ তার প্রস্তাবিত নাম থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ায় সরকারকেও স্বাগত জানিয়েছেন এবং কমিশনের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় তার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ইত্যাদি।
সরকারের কেউ কেউ নিজেদের ঢোল নিজেরা বাজিয়ে বলছেন, যেমন যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, বহু পুরোনো গণতন্ত্রের দেশেও এটি করা হয় না। অতীতে যারা সফল, নিষ্ঠা, সততা ও বলিষ্ঠতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে ইত্যাদি।
নানাজনের নানা কথার মধ্যে আমার নিজের কিছু মতামত শেয়ার করলাম শেয়ার ভ্যালুর কনসেপ্ট থেকে। অনেকেই নিশ্চয় শুনেছেন 'দরগায় মোম জ্বেলে কী হবে, মিথ্যা ফকির সেজে কী হবে? অন্তর যদি না হয় সুন্দর, বৃথা হবে সাধনা।'
জাতি যদি মনে করে একজন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা হয়েছে তার মানে নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হবে, তবে সেটা হবে হতাশা। কারণ বাঙালি জাতি না শিখেছে ভুলতে না শিখেছে ক্ষমা করতে। যে অন্যায় অত্যাচার অতীতের ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দল করেছে তার প্রতিশোধ নিতে এতটুকু কৃপণতা করেনি বর্তমান ক্ষমতাশীল রাজনীতিবিদরা।
নতুন দল ক্ষমতায় এলে প্রতিশোধের বন্যা বয়ে যাবে দেশের উন্নতি হবে না। যে উন্নতি সরকার বার বার তুলে ধরে যেমন রাস্তা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি এটা আসল উন্নতি নয়, আসল উন্নতি প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া, দারিদ্র্যতা মোচন করা, জীবনের মূল্য দেয়া, জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া এবং তাদের সেবা দেয়া। যত দিন প্রতিহিংসাপরায়ণতার সংগ্রাম চলবে তত দিন বাঙালি জাতি সোনার বাংলা গড়তে পারবে না। দুর্নীতিবাজরা পুতিনের মতো প্যারাডাইজে বসবাস করবে আর দেশের অবহেলিত জনগণ পথে ঘাটে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং সুশিক্ষার অভাবে ধুকে ধুকে মরবে।
আমি মনে করি বর্তমান সরকারের উচিত, প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধুর সুবাদে দেশের রাষ্ট্রপ্রতি নিয়োগ দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়া, যেখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয় বরং জন-দরদিদের নিজ নিজ যোগ্যতায় জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে সংসদে এসে দেশের জন্য কাজ করতে হবে, সেনার বাংলা গড়তে। এটা করতে হলে শেখ হাসিনাকে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং ভুলে যেতে হবে তিনি আওয়ামী লীগের লোক। একই সাথে বিরোধী দলদের মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামতে সমমানের সুযোগ দিতে হবে। পারবে বঙ্গবন্ধু কন্যা এমন একটি গণতন্ত্রের পরিচয় দিতে? তিনি না পারলে অন্য কেউ যে পারবে না সেটা আমরা সবাই জানি। যদি তিনি পারেন তবে সম্ভব হবে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সম্ভব হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণ।
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com