কী করতে যাচ্ছেন পুতিন?
ভ্লাদিমির পুতিন -
রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তিকে বিশেষ সতর্কাবস্থায় রাখার জন্য রুশ সামরিক বাহিনীকে আদেশ দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। এখন প্রশ্ন তিনি কি এই যুদ্ধে পরমাণু শক্তি প্রয়োগ করবেন? হয়তো ‘পুতিন এমন কাজ করবেন না।’ কিন্তু তারপর দেখা গেলো তিনি ঠিকই কাজটি করেছেন।
‘তিনি কোনো দিন ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করবেন না,’ তিনি সেটা করলেন। ‘তিনি ডনবাসে যুদ্ধ শুরু করবেন না,’ সেটাই তিনি করলেন।
‘ইউক্রেন দখল করতে পুরোদমে তিনি কোনো দিনই হামলা চালাবেন না, কিন্তু তিনি সেটাও করলেন। ফলে পুতিন ‘কোনো দিন করবেন না’- এমন কথা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য প্রযোজ্য নয় এবং এর ফলে একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন তৈরি হয়। আর সেটা হলো- ‘তিনি কখনোই শুরুতে পারমাণবিক বোমার বোতামে চাপ দেবেন না,’ তাই কি?
এটি কোনো তাত্ত্বিক প্রশ্ন নয়। ইউক্রেন প্রশ্নে ন্যাটোর নেতাদের আগ্রাসী বক্তব্যের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করে রাশিয়ার নেতা ইতোমধ্যেই তার দেশের পারমাণবিক শক্তিকে ‘বিশেষ সতর্কাবস্থায়’ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
পুতিন ঠিক কী বলে আসছেন। গত বৃহস্পতিবার যখন তিনি টেলিভিশনে বিশেষ সেনা অভিযানের ঘোষণা দেন, তিনি একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন; যার বাস্তব রূপ হলো ইউক্রেন দখলে নিতে পুরোদমে হামলা।
‘যে কেউই বাইরে থেকে হস্তক্ষেপের চিন্তা করুক না কেন, আর যদি হস্তক্ষেপ করেই ফেলে, তাহলে তাকে এমন পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে, ইতিহাসে এর আগে কেউ কখনো এমন পরিণতির মুখোমুখি হয়নি।’
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং নোভোয়া গেজেটা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ বিশ্বাস করেন, ‘পুতিনের শব্দ চয়নকে মনে হয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধের সরাসরি হুমকি।’
‘টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে পুতিন ক্রেমলিনের প্রভু নয় বরং নিজেকে যেন পুরো গ্রহের প্রভু হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। খুব দামি গাড়ির মালিক যেমন গাড়ির চাবিটা আঙুলে চক্কর দিয়ে ঘুরিয়ে ভাব নিতে থাকেন, ঠিক তেমনি করেই পুতিন যেন পারমাণবিক বোমার বাটনটিই ঘুরাচ্ছিলেন। তিনি অনেকবারই বলেছেন, যদি রাশিয়াই না থাকে, তাহলে এই গ্রহের দরকার কি? তার কথা আমলে নেয়নি কেউই। কিন্তু এটা এমন এক হুমকি, যে তিনি যা চান, সেইভাবে যদি রাশিয়ার সাথে আচরণ করা না হয়, তাহলে তিনি সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।’
২০১৮ সালে এক তথ্যচিত্রে প্রেসিডেন্ট পুতিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘কেউ যদি রাশিয়াকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, তার জবাব দেয়ার আইনি অধিকার আমাদের রয়েছে। হ্যাঁ, পৃথিবী এবং মানবজাতির জন্য সেটা হবে একটা মহাবিপর্যয়। কিন্তু আমি রাশিয়ার একজন নাগরিক ও রাষ্ট্রপ্রধান। রাশিয়া ছাড়া একটি পৃথিবীর কী প্রয়োজন আছে আমাদের?’
এখন একটু যদি সামনের দিকে অগ্রসর হই, পুতিন পুরোদমে ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী তা কঠোরভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে, ক্রেমলিনকে অবাক করে দিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলার মতো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব।
‘পুতিন খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন’, মনে করছেন মস্কোভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ পাভেল ফেলজেনহাওয়ার। ‘তার সামনে তেমন কোনো পথ খোলা নেই। পশ্চিমা বিশ্ব যদি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ জব্দ করে ফেলে, সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতন হবে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার জন্য একটি উপায় হতে পারে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া। আর একটি বিকল্প হতে পারে ব্রিটেন ও ডেনমার্কের মাঝামাঝি নর্থ সির কোনো এক জায়গায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাতে কী ঘটে সেটা পর্যবেক্ষণ করা।’
পুতিন যদি পারমাণবিক বোমাকে বিকল্প হিসেবে বেছে নেন, তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কেউ কি তাকে বুঝিয়ে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করবে, থামানোর চেষ্টা করবে?
‘রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী কখনোই জনগণের পক্ষ নেয় না’, বলছিলেন দিমিত্রি মুরাতভ। ‘তারা সব সময় শাসকদের পক্ষে।’ আর পুতিনের রাশিয়াতে শাসকই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাশিয়া এমন একটি দেশ যেখানে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। সেখানে ক্রেমলিনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
‘পুতিনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সেখানে কেউই প্রস্তুত নন’, বলছেন পাভেল ফেলজেনহাওয়ার। ‘আমরা এখন এক বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছি।’
ইউক্রেন যুদ্ধ, পুতিনের যুদ্ধ। ক্রেমলিনের নেতা যদি তার অভীষ্ট সামরিক লক্ষ্যে পৌঁছতে সফল হন, সেক্ষেত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ সন্দেহের মুখে পড়বে। তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন যদি এরকম কোনো উপলব্ধি তৈরি হয় এবং তিনি যদি মারাত্মক হতাহতের সম্মুখীন হন, সেক্ষেত্রে আশঙ্কা হচ্ছে ক্রেমলিন মরিয়া কোনো পদক্ষেপ নিয়ে ফেলবে কিনা।
বিশেষ করে ‘কোনো দিন করবেন না’, এমন কথা যদি পুতিনের জন্য প্রযোজ্য না হয়।
সূত্র : বিবিসি