ইউক্রেন হবে রাশিয়ার আফগানিস্তান!
ইউক্রেন হবে রাশিয়ার আফগানিস্তান! - ছবি : সংগৃহীত
ইতিহাস থেকে দেখা গেছে যুদ্ধ শুরু করা যত সহজ শেষ করা ততটা সহজ নয়। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণ এবং ২০০৩-এ ইরাকে আক্রমণের ক্ষেত্রে। ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অভিযানের পরিণতিও একই হতে পারে।
পুরনো একটা কথা চালু আছে যে শত্রুর সাথে প্রথম মুখোমুখি সংঘাতের পর সামরিক পরিকল্পনা কখনই পরিকল্পনা মাফিক এগোয় না। ইউক্রেনেও রাশিয়ার বাহিনীর ক্ষেত্রে সেটা সত্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসের ইন্সটিটিউট (রুসি)-এর ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এড আর্নল্ড রাশিয়ার প্রথম আক্রমণকে বর্ণনা করছেন 'ততটা চমকপ্রদ নয়' এবং 'প্রত্যাশার তুলনায় ধীরগতির' বলে।
এর কয়েকটি কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। সামরিক আক্রমণের নীতি হলো, তিনি বলছেন, সাধারণত 'শুরুতেই বিশাল একটা ধাক্কা দেয়া।' রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে দেড় লাখ থেকে এক লাখ ৯০ হাজার সৈন্য সমাবেশ করলেও, এখন পর্যন্ত তাদের সবাইকে মাঠে নামায় নি।
রাশিয়ার জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতি?
যুদ্ধের প্রারম্ভিক আক্রমণে কিছু সৈন্যকে বসিয়ে রাখার কারণ সম্ভবত রাশিয়া তাদের আক্রমণের পরবর্তী ধাপে ব্যবহারের জন্য এই সেনাদের প্রস্তুত রাখতে চায়। সামরিক বাহিনী যখন তাদের মূল পরিকল্পনা যুদ্ধের প্রয়োজনে বদল করে, তখন সৈন্যদের সংরক্ষিত রাখা একটা স্বাভাবিক বিষয় বলে বলছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এড আর্নল্ড।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা অনুমান করছেন যে রাশিয়া সীমান্তে যে সৈন্যদের জড়ো করেছিল, তাদের প্রায় অর্ধেককে তারা আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ চালানোর কারণে তাদের আক্রমণের প্রারম্ভিক পর্যায় কিছুটা জটিল ছিল।
এছাড়াও, রাশিয়া তাদের গোলাবর্ষণ এবং বিমান হামলা যতটা তীব্র মাত্রায় করবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল ততটা জোরেসোরে সেটা চালায়নি। তবে আর্নল্ড বলছেন : 'একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা ইউক্রেনের দিক থেকে শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে- যেটা আমার ধারণা রাশিয়া প্রত্যাশা করেনি।'
তবে এরপরও এড আর্নল্ড মনে করছেন, রাশিয়ার সমর-অধিনায়করা পরিবর্তিত পরিস্থিতি বা কোনোরকম বিপর্যয়ের মোকাবেলা করতে খুব দ্রুতই তাদের পরিকল্পনা বদলে নেবে।
সাবেক ব্রিটিশ সেনা অধিনায়ক জেনারেল সার রিচার্ড ব্যারনস্ বলছেন, এখনো মনে হচ্ছে যে রাশিয়ানরা 'বেশ দ্রুতই তাদের সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে সফল হবে।'
লক্ষ্য অর্জনের পথ বাধাগুলো
জেনারেল ব্যারনস্ বলছেন, এটা বেশ স্পষ্ট যে রাশিয়ার আক্রমণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো 'ইউক্রেনের সামরিক কাঠামোর ওপর আঘাত করে সেটা ভেঙে দেয়া, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারকে অপসারণ করা এবং ইউক্রেনের কিছু অংশ নিজের দেশের আওতায় এনে সেই অংশগুলো বৃহত্তর রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা।'
এই উদ্দেশ্যগুলোর বিচারে বলা যায়, রাশিয়া তার লক্ষ্য কার্যত কিছু অংশে অর্জন করেছে। রাশিয়া অগ্রসর হয়েছে ইউক্রেনের দক্ষিণ দিক থেকে। রুশ সামরিক বাহিনী ক্রিমিয়া থেকে ইউক্রেনে ঢোকার জন্য এখন একটা স্থল বাহিনী তৈরী করেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়ায় অভিযান চালায়।
এড আর্নল্ড এটাকে একটা 'মাঝারি মাপের একটা উদ্দেশ্য' বলে বর্ণনা করছেন। তিনি বলছেন, কিন্তু এখান থেকে রাশিয়া যেটা করতে পারে সেটা হলো, ইউক্রেনের যে সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চল প্রতিরোধের জন্য লড়াই করছে, তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে পারে।
ইউক্রেন বাহিনীর সবচেয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিছু সৈন্যকে ওই এলাকার রণাঙ্গনে মোতায়েন করা হয়েছে, যেখানে তারা গত আট বছর ধরে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে লড়াই করছে।
এখন পর্যন্ত, দোনেৎস্ক এবং লুহানস্কের অধিকৃত অঞ্চল থেকে সীমানা অতিক্রম করার রুশ প্রচেষ্টা তারা শক্তহাতে বাধা দিতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেললে তাদের জন্য লড়াই অনেক কঠিন হয়ে যাবে বলে আর্নল্ড মনে করছেন।
প্রকৃত বিষয়টা হলো যে, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইতোমধ্যেই লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের নতুন করে অন্যত্র মোতায়েন করা তাদের জন্য কঠিন হবে।
রাশিয়াও কিয়েভ অভিমুখে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়ার অন্য প্রধান লক্ষ্যটি হলো রাজধানীর দখল নেয়া। এর একটা প্রধান কারণ অবশ্যই - কিয়েভই সরকারের মূল কেন্দ্র এবং সেখান থেকেই প্রতিরোধ আসছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন চান, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সরকারকে উৎখাত করে সেখানে তার নিজস্ব পছন্দের এবং তার সমর্থক একটা শাসক গোষ্ঠী বসানো। রুসির এড আর্নল্ড বলছেন, 'কাজেই রাশিয়া যদি কিয়েভ দখল করতে না পারে, তাহলে রাশিয়া তার আসল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।'
এখন প্রশ্ন হলো, সেটা কতটা সহজ হবে? দেখে মনে হচ্ছে রুশ বাহিনী শহরটি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা কিয়েভের যত ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে প্রতিরোধ ততই কঠিন হবে এমন সম্ভাবনা এখন দেখা যাচ্ছে।
শহরের মধ্যে লড়াই- কার পক্ষে?
শহরের মধ্যে লড়াইয়ে প্রায়ই দেখা যায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে প্রতিরোধ বাহিনী। কারণ আক্রমণকারী সৈন্যদের জন্য রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ পরিচালনা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে বিভিন্ন ভবন প্রতিরোধী অবস্থান তৈরিতে সাহায্য করে।
শহরের নাগরিকরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা পালন করে। কারণ তারা সম্ভাব্য টার্গেট হয়ে পড়ে। ফলে শহরের ভেতরে লড়াই করা খুবই কঠিন এবং তা খুবই রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠার আশংকা থাকে। সেখানে অগ্রসরমান সৈন্যদের কাজ অনেক কঠিন এবং শহরে লড়াইয়ের জন্য অনেক বেশি সংখ্যক সৈন্যর প্রয়োজন হয়।
পূর্ব এবং পশ্চিম ইউক্রেনের মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে দেশটির দ্যনেইপার নদী। রুশ বাহিনীর জন্য এই নদীকে একটা সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা হিসাবে বর্ণনা করছেন এড আর্নল্ড।
আর্নল্ড বলছেন, রাশিয়া যদি কিয়েভ এবং দেশের বাদবাকি অঞ্চল দখল করতে পারে, তাহলে তার মতে দেশের পশ্চিমে লড়াই চালানোর খুব একটা প্রয়োজন রাশিয়ান বাহিনীর হবে না। তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো আশা করবেন, তার বাহিনী কিয়েভ দখল করতে পারলে এবং ইউক্রেন সেনা বাহিনীকে পরাজিত করতে পারলেই, ইউক্রেনের প্রতিরোধ শক্তি ভেঙে পড়বে।
'হিসাব ভুল প্রমাণিত হতে পারে'
রাশিয়ার এক লাখ ৯০ হাজার সৈন্য হয়তো একটা আক্রমণ চালানোর জন্য পর্যাপ্ত, কিন্তু সমর বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম একটা দেশ দখলের জন্য তা যথেষ্ট কি না।
জেনারেল ব্যারনস, যিনি ইরাকে ব্রিটিশ সেনা অধিনায়ক ছিলেন, তিনি বলছেন : 'পুতিন যদি প্রায় দেড় লাখ সৈন্য নিয়ে পুরো ইউক্রেন দখলের পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে সেটা একমাত্র কাজ করা সম্ভব যদি দেশটির জনগোষ্ঠীর তাতে মত থাকে।'
তিনি বলছেন, যদিও ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে জনগোষ্ঠীর একটা অংশ রাশিয়ার সমর্থক, কিন্তু দেশটির প্রায় চার কোটি মানুষের জনমত যদি রাশিয়ার বিপক্ষে থাকে, তাহলে রাশিয়ার বসানো একটা সরকারের জন্য দেশ চালানো খুবই কঠিন হবে।
জেনারেল ব্যারনস মনে করেন ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে দেবার জন্য রাশিয়া যদি যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করে এবং তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনও করে, তারপরেও সেই বাহিনীকে 'খুবই দৃঢ়চেতা বিদ্রোহের' মোকাবেলা করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন গোটা ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করার আশা নিয়ে যদি এই অভিযান চালিয়ে থাকেন, জেনারেল ব্যারনস বলছেন, 'সেটা তার হিসাবে বড় ধরনের একটা ভুলে পরিণত হতে পারে।'
সূত্র : বিবিসি