যে ভুলের ভয়াবহ খেসারত দিতে হচ্ছে পুতিনকে
যে ভুলের ভয়াবহ খেসারত দিতে হচ্ছে পুতিনকে - ছবি : সংগ্রহ
পুতিনের অতীতের কাজ দেখে মনে হতো, তিনি খুব ভেবে চিন্তে কাজ করেন। যেই সিদ্ধান্ত নেন তাতে জয় নিশ্চিত। কিন্তু এবার বোধ হয় কোনখানে তার চালে কিছু ত্রুটি আছে। তার বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তিনি রিয়েলিটি থেকে দূরে সরে গেছেন।
আমার কাছে তার যেই ত্রুটিগুলো ধরা পড়েছে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমেরিকায় যখন ডেমোক্র্যাটিক সরকার ক্ষমতায় তখন ইউক্রেনের মতো দেশকে এমন খোলাখুলিভাবে আক্রমণ করা। পুতিন যদি এই আক্রমণ দুই বছর আগে ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে করত, তাহলে দেখতাম আমেরিকার ট্রাম্প সরকার রাশিয়ার বিরোধিতা দূরে থাক, বরং চুপ করে বসে তামাশা দেখত। অথবা এই আক্রমণ পরবর্তী রিপাবলিক্যান সরকারের আমলে করত, তাহলেও পুতিন আমেরিকাকে অনেকটা নিরপেক্ষ অবস্থায় পেত। কারণ আমেরিকান রিপাবলিকানেরা এখন আর রিগ্যানের আমলের রিপাবলিক্যানদের মতো নয়। এরা আমেরিকার ডেমোক্র্যাটদের চাইতে রাশিয়ার পুতিনকে বেশি সাপোর্ট করে।
দ্বিতীয়ত, বাইডেনকে দুর্বল ভাবা। বরঞ্চ বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বাইডেন পশ্চিমা দেশগুলোকে অতি দ্রুত, কেবল তিন দিনের মধ্যে, এক কাতারে নিয়ে এসেছেন। যে কাতারে শামিল হয়েছে ভিক্টর ওবানের হাঙ্গেরি পর্যন্ত। ইউরোপের প্রতিটি ডিসিশানের পেছনে হোয়াইট হাউজের হাত আছে। বাইডেনের ডিপ্লোম্যাসিতেই জার্মানি-ইতালি-হাঙ্গেরি শেষ পর্যন্ত সুইফটে রাশিয়ান অনেক ব্যাংকের এক্সেস নিষিদ্ধ করেছে।
তৃতীয়ত ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সাথে আমেরিকার সমন্বয় দুর্বল তা মনে করা। ট্রাম্প আমেরিকাকে কেবল ন্যাটো নয়, অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশে থেকেও দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বাইডেন সরকার পশ্চিমা দেশগুলোকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। তাদের মাঝে নজিরবিহীন সমন্বয় দেখা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমেরিকা খুব শক্তভাবে পেছন থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অসবাই মিলে যেন একটা কো-অপেরেটিভ সিস্টেম চালাচ্ছে।
চতুর্থত, প্রথমেই সর্বশক্তি দিয়ে ইউক্রেনের আকাশ দখল করে, নিচে ইউক্রেনের সকল মিলিটারি কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টারগুলো ধ্বংস করে, ৭২ ঘন্টার মধ্যে কিয়েভ দখল নিয়ে জেলেন্সকির পতন ঘটাতে পারলে, রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি অত্যন্ত কম হতো। কী কারণে পুতিন একটু একটু করে, অল্প কিছু সেনা পাঠিয়ে আগাচ্ছে, আমার বুঝে আসছে না। এতে করে ইউক্রেন ঘুরে দাঁড়িয়ে গেছে, পশ্চিমের শক্তিগুলো সমন্বয় করে জেলেন্সকির হাত শক্তপোক্ত করার সময় পেয়ে গেছে।
খেয়াল করে দেখুন কিরকম দ্রুত পশ্চিমা দেশগুলো এক সাথে সমন্বয় করে চলছে। কে কী পাঠাবে সেটাও নিজেদের মাঝে আলোচনা করে ঠিক করছে, যাতে সবাই মিলে ইউক্রেনের যা যা দরকার তা অতি দ্রুত পাঠাতে পারে। কেউ জ্যাভেলিন মিসাইল বিধ্বংসী অস্ত্র, তো কেউ স্টিঙ্গার। কেউ নাইট ভিশন গগলস, তো কেউ মেডিসিন। কেউ র্যাডার জ্যামার তো কেউ গোলা বারুদ। এমনকি আজারবাইজান পর্যন্ত তেল পাঠাচ্ছে। আর তুরস্কর কাছ থেকে কেনা ড্রোন অলরেডি ইউক্রেনের আকাশে তার কার্যকারিতা শুরু করে দিয়েছে।
ইউক্রেনীয়দের হাতে অস্ত্রের কোনো কমতি হবে না সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমার জানা মতে ১৮ বছরের উপরে সকল ইউক্রেনিয়ানরা মিলিটারি ট্রেইনিংপ্রাপ্ত। অতএব, পুতিনের বাহিনীর ইউক্রেনে ধরা খাওয়ার চান্স অত্যন্ত বেশি। হয়তো ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বিতীয় আফগানিস্তান হবে। রাশিয়া-আফগান যুদ্ধের জেরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়া পুতিনকেই ছুঁড়ে ফেলতে পারে। এই সব অবশ্য সম্ভাবনার কথা, কোথাকার পানি কোথায় যাবে তা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন।
জেলেন্সকির কূটনীতি আর যোগাযোগ ক্ষমতাও অভূতপূর্ব। টুইটের মাধ্যমে তিনিও পশ্চিমা বিশ্বকে চাপে রেখেছেন ইউক্রেনকে যেন ছেড়ে না যায়। প্রাথমিকভাবে তার আশা ছিল আমেরিকাসহ, ব্রিটেন, ফ্রান্স হয়তো সেনা পাঠাবে, যাকে আমরা বলি বুটস অন দ্যা গ্রাউন্ড। পশ্চিমা দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে তা করেনি। হাজার হোক পুতিন এখন আনহিঞ্জড আর ডেসপারেট, যার হাতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আর্সেনাল। ইউরোপ তার মাটিতে আরেক বিশ্বযুদ্ধ চায় না। বিশ্বযুদ্ধ এড়িয়ে, যুদ্ধটাকে কেবল এক দেশের মাটিতে সীমাবদ্ধ রাখতে তারা দরকার হলে ট্রিলিয়ন্স অফ ডলার খরচ করবে, এবার জত বছর লাগে লাগুক।
ন্যাটো এখন পর্যন্ত সরাসরি এই যুদ্ধে না জড়ালেও, ন্যাটোভুক্ত প্রতিটি বড় বড় দেশ ইউক্রেনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর ডিফেন্স আর সারভেইলেন্স এক্টিভ করেছে। একতা আর সমন্বয় কাকে বলে তার এক অনন্য উদাহরণ আমরা দেখছি এই মুহূর্তে।
আর সেটা দেখে আমার বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব কেবল সমন্বয়হীন নয়, এদের নিজেদের ক্ষমতার লালসা মুসলিম বিশ্বকে রক্তের সাগরে পরিণত করেছে। কোথায় সবাই মিলে ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু করবে, তা না করে সিরিয়া-ইরান-হাউছি-হিজবুল্লাহ গেছে একদিকে, আরেক দিকে সৌদি-আমিরাত-মিসর, তো আরেক দিকে তুরস্ক-কাতার। তার ওপর যোগ হয়েছে আইসিস। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া।
অথচ এদের মাঝে যদি সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ব থাকত, সমন্বয় থাকত, ন্যাটোর মতন সামরিক সংগঠন থাকত তাহলে এভাবে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বাইরের দেশগুলো হেজেমনি খেলতে পারত না। বিশ্বের যে অঞ্চল থেকে সিভিলাইজেশানের শুরু, আজ তাদেরকেই বাইরের লোক বলে আনসিভিলাইজড। এই অঞ্চলকে বাইরের শক্তি এসে যেমন মারে, তেমন নিজেরাও নিজেদের মারে। ক্ষমতার মধু খেয়ে এরা একেকজন বিষধর সাপ। একজন আরেকজনকে গিলে খেতে চায়।