এরপর কী হবে?

গৌতম দাস | Feb 26, 2022 04:10 pm
এরপর কী হবে?

এরপর কী হবে? - ছবি : সংগ্রহ

 

শেষ পর্যন্ত রাশিয়ান সৈন্য ইউক্রেন অভিযান শুরু করে দিয়েছে। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে এক ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালানোর জন্য নির্দেশ দেয়ার পরেই এই অভিযান শুরু হয়ে যায়। তিন দিক থেকে ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। গত কয়েক মাস ধরেই ইউক্রেন নিয়ে সামরিক উত্তেজনা চলছিল। এক দিকে পশ্চিমা দেশ ও তাদের ন্যাটো জোট আর বিপক্ষে রাশিয়া, এভাবে হুমকি পাল্টা হুমকি চলার মধ্যেই এই সামরিক অভিযান সত্যি হয়ে যায়।

বৃহত্তর দিকটা দেখে বললে, পুরান সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে। ভেঙে গেলে পরে তা আপসে রাশিয়াসহ মোট পনেরোটা রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছিল। ইউক্রেন ওই পনেরো ভেঙে-গড়া রাষ্ট্রের একটা। আর সেই থেকেই মূলত রাশিয়া বাদে ১৪ রাষ্ট্রকে নিয়ে আরেক ধরনের ভাঙা গড়া শুরু হয়েছিল। আর সম্ভবত তার শেষ-কাণ্ডই এখন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। আলাদা আলাদা ১৪ রাষ্ট্র বাধাহীন স্বাধীন হয়ে জন্ম নেয়ার পরেও তারা থিতু না হয়ে উল্টো অস্থিরতার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল মূলত কিছু বাইরের উপাদান হয়ে হাজির হওয়ার কারণে। সেই বাইরের উপাদান হয়ে জাহির হয়েছিল ‘পশ্চিমা দেশ’ মানে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ (সংক্ষেপে এখন থেকে একে ‘পশ্চিম’ বলব)। অথবা অন্যভাবেই বলা যায় ন্যাটোকেন্দ্রিক পশ্চিমা দেশ এরা, তাদের ব্যাপক খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেসব মারাত্মক ভুলগুলো করেছিল তার মাশুল দেওয়ার শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া ধরনের ঘটনাটাই বোধহয় এবার ঘটল।

পুতিনের রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ইউক্রেনকে তিন দিক থেকে ঘিরে ধরে আক্রমণ শুরু করেছে, লক্ষ্য রাজধানী কিয়েভ অভিমুখে। পুতিন ঘোষণা করেই বলছেন, ‘ইউক্রেনকে ডি-মিলিটারাইজ করা’ মানে তার সব সামরিক সক্ষমতা বিনাশ করে দেয়া আর ইউক্রেনের মনে হিটলার-গিরির ভাবনা, মানে ইউক্রেনের উগ্র চরম জাতিবাদী অবস্থান ছেয়ে গেছে সেটা ছেঁটে দেয়া এই অভিযানের লক্ষ্য। ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রুশ আর্মি রাজধানী কিয়েভের প্রবেশ মুখ পার হয়ে গেছে। এখন কার্যত সবাই কমবেশি নিশ্চিত যে, পুতিনের রাশিয়া কবে ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ফিরে যাবে সেটা একমাত্র সে নিজেই নির্ধারণ করবে। তবে ইউক্রেনকে রাশিয়া নিজ দখলে নিয়ে নেবে এমন কোনো পরিকল্পনা এখানে নেই বলে জানা যাচ্ছে। এটা অনেকটা, ১৯৬২ সালে চীনের ভারতে আক্রমণ করে পুরো নর্থ-ইস্ট (আসাম) দখল করে নেয়া, এরপর কয়েক দিন এটা দখলে রেখে নিজের সক্ষমতা কতদূর এর একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠার পরে নিজ ইচ্ছাতেই আবার সেনা প্রত্যাহার করে চলে যাওয়া- সেরকম। আর এরই প্রভাব-প্রতিক্রিয়ায় সে যাত্রায় ভারত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল, পরে নতুন করে চীনকে ভাব-ভালোবাসার মেসেজ পাঠানো এমনকি তার এক গালভরা নামও ছিল ‘পঞ্চশীলা নীতি’ বলে। তাতে চীন-ভারত ‘ভাই ভাই’ হয়ে গিয়েছিল। এটা তেমনি একটা কিছুর দিকে যাবে হয়তো।

বাংলাদেশের প্রধান মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতে স্বাভাবিকভাবে ইউক্রেন ইস্যু আছড়ে পড়েছে যদিও সেসব আলোচনার বেশির ভাগই ন্যায়-অন্যায় কার কতটা এদিকটাই ভারী করে। শুধু ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে অনেকেই যাবে অবশ্যই। কিন্তু কেন ঘটল এমন ঘটনা বা ঘটনাটা এদিকে গেল কেন তা বুঝতে হলে আরো গভীর অন্যদিকেও যেতে হবে। আবার এমন ঘটনা দুনিয়ায় নতুন নয়। আরেকটা সতর্কতা; এটা কমিউনিস্ট-অকমিউনিস্ট ইস্যুও নয়। ফলে কমিউনিস্টরা ভালো কিনা এই চোখে কোনো তর্ক তুলে আনাও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত না বুঝার অযোগ্যতা ও অহেতুক তর্ক।

আমেরিকান ফ্লোরিডা উপকূলের ৯০ মাইলের মধ্যে কিউবায় ক্যাস্ত্রো এক কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটিয়ে বসলে আমেরিকার তাতে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল। এখান থেকে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস বলে ১৩ দিনের কাহিনী শুরু হয়েছিল। কারণ, তাতে হুমকি পাল্টা হুমকিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় মিসাইল স্থাপন ও আমেরিকার দিকে তাক করে বসিয়ে দিলে তা এক চরম উত্তেজনাকর অবস্থা তৈরি করেছিল। মূল ইস্যু ‘নিজ নিরাপত্তাবোধ’। আমেরিকা ‘নিজ নিরাপত্তাবোধ’ এর অভাব থেকে আপত্তি করাতে এর সব শুরু। আর তাতে এর শেষ হয়েছিল ‘কোনো যুদ্ধ নয়’ ভাবে। মানে আমেরিকা কিউবা থেকে আক্রান্ত হবে না আর বিপরীতে আমেরিকাও কিউবান বিপ্লব ভেঙে দিতে যাবে না আক্রান্ত হবে না এই প্রতিশ্রুতিতে ওই বিরোধের সমাপ্তি ঘটেছিল। এ বাইরে কোনো ন্যায়-অন্যায় থেকে এরা সঠিক-বেঠিকতা নিয়ে আলোচনা করতে বসে নেই।

ইউক্রেনে কী নিয়ে বিরোধ
অল্প কথায় বললে ‘রাশিয়ার নিজ নিরাপত্তাবোধ’। কারণ ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এ থেকেই রাশিয়ার নিরাপত্তা চিন্তা শুরু। এর শুরু যদি এ কালের ঘটনা হিসেবে দেখি, তবু এর শুরু কম করে ২০১৪ সাল থেকে। কিন্তু এ নিয়ে আপস আলোচনার ডায়লগের পথে কখনো দুপক্ষ যায়নি, যেতে পারেনি; যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজধানী কিয়েভে রাশিয়ান সেনারা পৌঁছানোর মুহূর্তে চীন-রাশিয়ার মধ্যে এক তথ্য বিনিময় ঘটেছে, আর তাতে চীনের দিক থেকে রাশিয়াকে এক প্রকাশ্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির এক নিউজে বলা হয়েছে, চীন ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে এখন ‘নিগোশিয়েশন’ করে নিতে আহ্বান জানিয়েছে; যদিও আপাতত এদিকে যাবার জন্য কোনো পক্ষ থেকেই কোনো নড়াচড়ার কোনো আভাস নেই।

নিজ নিরাপত্তাবোধের অভাব- সব সমস্যার শুরু এখান থেকেই। আর বিষয়টা অনেক অনেক পুরোনা। আর সেখানেই এই নিরাপত্তাবোধে অভাব ব্যাপারটা ঢুকে আছে। অটোমান সাম্রাজ্য এর সময়কাল (১২৯৯-১৯২২) যার তুলনায় রাশিয়ান জার সাম্রাজ্যের বয়স (১৮৯২-১৯১৭) অনেক কম। কিন্তু দুটা সাম্রাজ্যের আয়ু শেষ হয়েছিল কাছাকাছি সময়েই। সাম্রাজ্য মানে তার কিছু কলোনি বা উপনিবেশ থাকে। আর জার সাম্রাজ্যের আমলে নানা পথ ঘুরে ইউক্রেন রাশিয়ার উপনিবেশ হয়েছিল আর তা থিতু হয়েই ছিল। তবে অস্থির হয়ে যায় ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় লেনিনের কমিউনিস্ট বিপ্লব থেকে।

অনেকেই হয়তো খেয়াল রেখেছেন জারের রাশিয়ায় লেনিনের বিপ্লব হয়েছিল কেবল রাশিয়ায়, ওর সংশ্লিষ্ট উপনিবেশগুলোতেও না। ব্যাপারটা অনেকটা, আমরা যখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে ছিলাম তখন যদি ইংল্যান্ডে কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটত তবে তখন কলোনি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াতে কি কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছে; ফলে তা কল্পিত ইংল্যান্ডের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের অংশ হয়ে যেত? নাকি তা ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াকে কলোনিমুক্ত করে দেয়া হতো? আলোচ্য ক্ষেত্রে যেন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে নয়া কমিউনিস্ট দেশ হয়ে গিয়েছিল।
ইউক্রেনের বেলায় ঠিক এটাই ঘটেছিল। তারা জারের উপনিবেশ ছিল বলে লেনিনের বিপ্লবের পরে কমিউনিস্ট রাশিয়ার সাথে যুক্ত করে নিলে তা সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে হাজির হয়, ১৯২২ সাল থেকে। অর্থাৎ একা ইউক্রেন নয়, জারের সব উপনিবেশকে অন্তর্ভুক্ত করে নয়া সোভিয়েত রিপাবলিক বলে রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। এতে ইউক্রেনও রাশিয়ান কর্তৃত্বের সোভিয়েত রিপাবলিক হয়ে যায়। বিপ্লব রাশিয়াতে হলেও রাষ্ট্র হিসাবে এর নাম হয়ে যায় ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ (১৯২২ সাল থেকে) আর রাশিয়ান ভূখণ্ডের তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন কয়েক গুণ বড় হয়ে যায়।

অনেকে এটাকে নয়া নামে লেনিনের উপনিবেশ এক্সটেনশন বলতে পারেন হয়তো। কিন্তু পেছনের মূল কারণ ছিল রাশিয়ান কমিউনিজমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দুনিয়ায় প্রথম কমিউনিস্ট বিপ্লব বলে আর খোদ ইউরোপের ঘটনা আর ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত এই সুযোগে ফাঁক গলে লেনিনের ক্ষমতা দখল করে নেয়ার ঘটনা ছিল সেটা। ফলে পরে তারা প্রচণ্ড ভীত ছিল যে ইউরোপের কলোনিমালিকেরা (তখনকার ব্রিটেন ফ্রান্স এরা ) কখন জানি হামলা করে। ম্যাপের দিকে তাকালে দেখব, মূল রাশিয়ার মোটামুটি চার পাশে বেষ্টন করে আছে সাবেক সোভিয়েতের ইউক্রেনসহ বাকি উপনিবেশগুলো। অর্থাৎ তাদের পেরিয়ে গেলে তবেই বাইরে থেকে রাশিয়া আক্রমণ করা যাবে। আবার ইউক্রেন হলো সবচেয়ে বড় ভূখণ্ড যার অপর দিকেই হলো পশ্চিম ইউরোপ। রাশিয়াকে যার ভয়ে সারাজীবন কাটাতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এরাই ইউরোপের মূল কলোনি দখলদার যারা এককালে আজকের আমেরিকাসহ সারা দুনিয়াকেই কলোনি করে রেখেছিল ১৯৪৫ সালের আগে পর্যন্ত।

রাশিয়ার নিরাপত্তাবোধের প্রশ্ন কবে থেকে
তাহলে কমিউনিস্ট রাশিয়ার আমল থেকেই নিরাপত্তাবোধের অভাব প্রসঙ্গটা তুঙ্গে উঠেছিল যে, তারা নতুন ধরনের (কমিউনিস্ট) রাষ্ট্র বলেই পড়শিদের থেকে বা তাদের মাধ্যমে অন্যের হাতে হামলার শিকার হয়। এমনকি এই নিরাপত্তাবোধের অভাব প্রশ্নটা এতই সিরিয়াস ছিল যে, এ থেকে নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব পর্যন্ত হাজির হয়ে ছিল যে, ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র’ করে তা টিকানো সম্ভব কিনা; সম্ভব করতে গেলে কী করতে হয় ইত্যাদি। এ নিয়ে তাদের নেতৃত্বে বিভক্তিও হয়েছিল সে সময়। সারকথায় ওই ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ার মূল কারণ ছিল নিরাপত্তাবোধের অভাব মিটানো। আর ইউক্রেন-রাশিয়ার বিশেষ নিরাপত্তা সম্পর্ক সেই থেকে। কারণ ইউক্রেন পশ্চিম ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে প্রটেক্ট করা সবচেয়ে বড় ও মূল ভূখণ্ড।

পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সাল থেকে আইসেনহাওয়ার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই ‘হকিশ’ বা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে সব কেড়ে নিয়ে যাওয়ার খারাপ দেশ হিসাবে পরিচিতির আমেরিকার জন্ম হয়। এটাকেই কমিউনিস্টদের ভাষায় আমেরিকার ‘সাম্রাজ্যবাদ’ হয়ে ওঠা বলা যায়। এমনকি তা কোল্ড-ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের কালের শুরু ধরা হয় যার অন্য একটা বড় কারণ হলো ‘পারমাণবিক অস্ত্রের’ জমানার শুরুও সেটা। সোভিয়েত ও আমেরিকা দুপক্ষই সেটার ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিল পরের ষাটের দশকজুড়েই। পারমাণবিক অস্ত্রের কথা ইউক্রেন নিয়ে আলাপে কেন তুললাম?

কারণ ওসব পারমাণবিক অস্ত্রের একটা বড় অংশই রাশিয়া মোতায়েন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মুখ ভূমি, ফ্রন্টাল স্টেট হিসাবে ইউক্রেনে। কারণ পশ্চিম ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করতে ইউক্রেনে বসেই তা ব্যবহার করা হবে। পরে সোভিয়েত ভেঙে গেলে, ইউক্রেন স্বাধীন হয়ে গেলে আস্তে আস্তে সেসব পারমাণবিক অস্ত্র তুলে বা খুলে ফেলা হয়।

এখন অনেকে যুক্তি তুলছে, সেসময় ওসব অস্ত্র রেখে দিলে আজ ইউক্রেনকে রাশিয়ার হাতে মার খেতে হতো না। এমন কথা ফ্যাক্টস নজরে না থাকার কারণে বলা হচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্র নিজেই এক বিরাট বোঝা- প্রধান কারণ অহেতুক বিরাট খরচ; যে খরচের পক্ষে সাফাই জোগাড় করা কঠিন। এ ছাড়া টেকনিক্যালি সাউন্ড স্টাফ লাগে প্রচুর আর এমন মোতায়েন থাকা অস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করা আরেক বাড়তি খরচ। কথাগুলো এভাবে বলা হছে এজন্য যে, অস্ত্রগুলো ইউক্রেনের ভূখণ্ডে মোতায়েন হলেও এর মালিক-কর্তা ও খরচ বহনকারী ছিল খোদ রাশিয়া। ফলে সোভিয়েত ভেঙে গেলে এটা ইউক্রেনের জন্য দায় হয়ে উঠেছিল। মোতায়েন অস্ত্রে জং ধরিয়ে তো কারো কোনো স্বার্থ নেই। তবে উল্টা স্বার্থ ছিল ন্যাটোর। অস্ত্রগুলো পশ্চিম ইউরোপের দিকে, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি- এসব দেশের দিকে তাক করা। কাজেই তাদেরই বড় স্বার্থ ছিল ইউক্রেনকে যেন পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করে দেয়া হয়। এখানে নেপথ্যে বলে রাখি, এখন পাঠকেরা বুঝবেন ইউক্রেনে হামলা স্রেফ ন্যায়-অন্যায়ের ইস্যু না। শুধু হামলার ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা দিয়ে এর সমস্যা বা সমাধান কিছু বুঝা যাবে না।

সোভিয়েত ভেঙে যাবার পরে
বেশির ভাগ মানুষই কোল্ড-ওয়ার বলতে সেকালে সোভিয়েত-আমেরিকার রেষারেষি-টেনশন যেটা যেকোনো দুটো দেশের মধ্যে হয়েই থাকে তা বুঝে থাকে। এটা ভুল। কোল্ড-ওয়ারের মূল বিষয় ছিল দুই ধরনের অর্থনীতি। না, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বা ম্যাক্রো অর্থনীতির কথা বলছি না। বলছি আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বা গ্লোবাল বাণিজ্যের দিক থেকে গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্থে। কোল্ড-ওয়ার বলতে মূল বিভক্তিটা হলো, একদল দেশ, গ্লোবাল বাণিজ্যের প্রয়োজনে এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেম চালু করে সবাই তাতে যুক্ত হয়ে পড়েছে। আরেক দল (এরা কমিউনিস্ট বা সোভিয়েত ব্লকের) বলছে, গ্লোবাল বাণিজ্য দূরে থাক, আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যও দরকার নেই। প্রথম দল আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক গড়ে এর মাধ্যমে এটা চালু করেছে। যদিও এটা বৈষম্যমূলক, এর মাখন যায় মাতবর রাষ্ট্রের ঘরে কিন্তু অন্যদের জন্য তবু তা মন্দের ভালো; না খেয়ে মরার চেয়ে। তাই সোভিয়েত ব্লকের রাষ্ট্রগুলো আইএমএফের সদস্য হয় নাই, কোনো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যে যোগ দিতে চাইলেও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

পরে সোভিয়েত ভেঙে গেলে সবার আগে এখানেই পরিবর্তনটা ঘটেছিল। এরা সবাই আইএমএফের সদস্য হয়ে যায়, এমনকি রাশিয়াও। অর্থাৎ তখন থেকে দুনিয়ার প্রায় সব রাষ্ট্র একই গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেমের অংশ হয়ে যায়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যও সম্ভব হয়ে ওঠে তাতে। কিন্তু তাহলে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমাদেশগুলোরও উচিত ছিল বিষয়টাকে গঠনমূলকভাবে দেখার, পরিকল্পিত ও সহযোগিতামূলক ভাবে দেখার।

আমেরিকার নেতৃত্বের পশ্চিম এখানেই ব্যর্থ আর তা থেকেই বর্তমান সঙ্ঘাত। কী করে পুরোনা ১৫ রাষ্ট্রকে একই গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেমের অংশ করে বাধাহীনভাবে সম্পন্ন করবে এজন্য কোনো স্ট্রাটেজিক পরিকল্পনা আমেরিকা করেনি। অথবা না করলেই বা চাপ ফেললেই তাদের বেশি লাভ এমন অনুমান কাজ করেছিল।
অনেক সময় আপনি যাকে শত্রু মনে করেন, তা সত্ত্বেও দেখা যায় তাকে কিছু ট্রেনিংয়ের ভিতরে যদি নিতে পারেন তবে সেটা উভয়েরই ভালো হতে পারে। অহেতুক স্বার্থ সঙ্ঘাত তাতে লোপ পেতে পারে।

সাধারণভাবে বললে, পশ্চিমের উচিত ছিল প্রথমে অর্থনৈতিকভাবে যতদূর সম্ভব ঘনিষ্ঠ ও পরস্পর নির্ভরশীল ও সহযোগিতায় এক বাণিজ্য সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া বা গড়ে তোলা। পরে রাজনৈতিক স্বার্থ অবস্থান ভিন্নতাগুলো কমানোর বিষয়ে কাজ করা। এতে পূর্ব-ইউরোপের সাথে ইন্ট্রিগেশন সহজ ও কম, বাধাহীন হতো। মূলত এটাকেই বলছি পরিকল্পিতভাবে কাজ করা। কিন্তু আমেরিকার নেতৃত্ব পশ্চিম ইউরোপ এ কাজটা করেছে অপরিকল্পিত হেলাফেলায়। তার চেয়েও চাপে ফেলে বাধ্য করায়, আর অপর পক্ষের উদ্বেগগুলোকে উপেক্ষা করে। সর্বোপরি এনজিও বা অন্য কোনো উপায়ে পাপেট সরকার বসিয়ে প্রভাবিত করা আর সাথে, যেকোনো উপায়ে ওসব দেশকে ন্যাটোতে ঢুকিয়ে নেয়া।

ন্যাটো হলো পশ্চিমাদের ঘোষিত রাশিয়াবিরোধী সামরিক জোট যার এক মারাত্মক নীতি হলো, এর কোনো এক সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে বাকি সদস্যের সবাইকে ওর পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনে যুদ্ধে যেতে হবে। তা থেকেই এখনকার ইউক্রেন দ্বন্দ্বের জন্ম যেটাতে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করে নিয়ে রাশিয়ার ওপর পাল্টা আধিপত্য কায়েম করে নিতে চাচ্ছে। আর রাশিয়ার আপত্তি হলো আমার নিরাপত্তা স্বার্থ উপেক্ষা করলে আর আমার ওপর রুস্তমি করতে চাইলে আমি সর্বাত্মক বাধা দেব। পশ্চিমের হুমকির মুখে ইউক্রেনকে রাশিয়া কিছুতেই ন্যাটোর সদস্য করে নিতে দেবে না।

এই হলো আমেরিকার অপরিকল্পিত ও হামবড়া দেখানোর সুবিধার উপর চালিয়ে দেয়া কাজ। আমেরিকার ধারণা, সে ন্যাটোতে যোগদান করা ইউক্রেনের ‘অধিকার’ বলে চালিয়ে দিতে পারবে। এটা ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপার বলে চালিয়ে দিতে পারবে।

প্রথমত আমেরিকা নিজের বেলায় এভাবে বিষয়টাকে দেখে নাই। অর্থাৎ ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস যেটাকে বলে তখন, আমেরিকা কিউবার মিসাইল মোতায়েনকে কিউবার ‘অধিকার’ হিসাবে দেখতে পারেনি কেন? ন্যায় হিসাবে দেখতে পারেনি কেন? কেন নিজের নিরাপত্তাবোধকে আপত্তির ইস্যু করেছিল?
আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপের প্রধান স্ববিরোধিতা হলো, পুরোনা সোভিয়েত ব্লককে ঘরে ডেকে নেয়া বা স্বাগত জানাতে না পারা। তারা সেটা তো করেইনি, উল্টা ন্যাটোকে শক্তিশালী করছে; তাও আবার সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোকে দিয়েই। অর্থাৎ এতে তাদের অবস্থান হয়ে গেছে ক্ষমতার দাপট দেখানো, আর এই আধিপত্যকে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহার করে মাখনটা তুলে নেয়া। ফলে পশ্চিমের উদ্দেশ্যটাই অসৎ হয়ে গেছে, সে রাশিয়ার জন্য উপযুক্ত পার্টনার নয়।

এ ছাড়া পুরোনা সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে এনজিওর তৎপরতাকে পাপেট সরকার বসানোর উপায় হিসাবে ব্যবহার করা আর পরিস্থিতিকে এমন দিকে ঠেলে দেয়া যেন এখন ইউক্রেনের মতো দেশগুলো হয়েছে রাশিয়া আর পশ্চিম দু’পক্ষেরই নিজ নিজ পাপেট সরকার বসানোর প্রতিযোগিতা। এটা পশ্চিমের জন্য কোনো যুক্তিতেই তাদের পলিসি হতে পারে না- তাদের দাবি অনুসারে তারা তো ডেমোক্রাসির বরপুত্র! নাকি? কোনো দায়িত্ববান ব্যবসায়ীও এমন অবস্থান নিতে পারে না।

রাশিয়ান হামলার মুখে আমাকে একা ফেলে পালিয়েছে পশ্চিম

হামলার দ্বিতীয় দিন, মানে ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বোধোদয়! এই হলো পাপেটের করুণ দশা। এ কথার সোজা মানে হলো, সারা পশ্চিম তাকে ছেঁকা দিয়েছে; এতিম করে ফেলে পালিয়েছে এবং এজন্য পশ্চিম দায়ী অবশ্যই। কিন্তু প্রধান দায়ী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিজেই। কেন আগে চিনতে পারেননি? কাদের হাত ধরে ও উস্কানিতে জেলেনস্কি পুতিনের সাথে শত্রুতা করতে গিয়েছিলেন? লাগতে গিয়েছিলেন কেন?

তাহলে এক মাস আগে পোল্যান্ডে ও রোমানিয়ায় পর্যন্ত বাইডেন সেনা মোতায়েন করেছিল কেন? মোতায়েন করাতে রাশিয়া আক্রমণ করে বসলে এর আগেই সেনা প্রত্যাহার করে আমেরিকা ভেগে যায়। আর এখন বলছে আমেরিকা রাশিয়ার সাথে বা ইউক্রেনের ভূমিতে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করবে না। কী তামাসা! এ কথা আগে বলেনি কেন? এটা কি প্রতারণা?

কেন এমন পরিণতি
কারা কারা রাশিয়ার ওপর স্যাংশন দিয়েছে এটা বেশ মজার। এক কথায় এটা হলো বাইডেনের সাজানো অ্যান্টি-চায়না ব্লক; একেবারে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। মানে হলো বাইডেনের এই যদি তারা শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে থাকে তবে এটা হবে সবাইকে না খাইয়ে মারার বুদ্ধিতে গড়া এক ব্লক যাদের মূল বৈশিষ্ট্য তাদের আর ‘গ্লোবাল’ হবার মুরোদ নেই।

মানে হলো, তাদের যুদ্ধের খরচ বইবার অর্থেও কারো সাথে যথেষ্ট সারপ্লাস সম্পদ নেই অথচ গ্লোবাল নেতা হওয়া বা থাকার ক্ষেত্রে যা একনম্বর শর্ত। কিন্তু বাইডেনের পরামর্শক বা থিংকট্যাংকের ফেলোরা তবু বুদ্ধি দিয়ে যাচ্ছেন, আমেরিকা এখনো সামরিক দিক থেকে চীনের ছয়গুণ শক্তিশালী। কাজেই তারাই গ্লোবাল নেতা।’ এদের কে বুঝাতে পারবে গ্লোবাল সক্ষমতা বলতে প্রধানত অর্থনৈতিক সক্ষমতা বুঝায়। এরপরে সামরিক আসতে পারে, আগে নয়।

তাতে ফলাফল? এখন নিম্নচাপ! মানে?
মানে হলো, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ন্যাটোর খরচ কে দেবে? এর উত্তর নেই বলে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির রাস্তায় পড়ে থেকে কাতরাচ্ছে! পশ্চিম ইউরোপের কথা, আমেরিকা এ খরচ না দিলে তারা নড়াচড়া করবে না। তাই সাতমণ ঘি ঢালা হয়নি, আর তাতে রাধাও নাচেনি। আবার এটা এমনই লজ্জার কথা, তারা সেটা প্রধান কারণ মিডিয়ায় আনে নাই। অথচ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির অভিযোগ তাকে ভালুকের মুখে ফেলে পালিয়েছেÑ এই বক্তব্যের ফলে পশ্চিমের কার মুখ-সম্মান এখনো বেঁচে আছে?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

goutamdas1958@hotmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us