ইউক্রেনে কী নিয়ে বিরোধ

গৌতম দাস | Feb 26, 2022 04:06 pm
ইউক্রেনে কী নিয়ে বিরোধ

ইউক্রেনে কী নিয়ে বিরোধ - ছবি : সংগ্রহ

 

অল্প কথায় বললে ‘রাশিয়ার নিজ নিরাপত্তাবোধ’। কারণ ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এ থেকেই রাশিয়ার নিরাপত্তা চিন্তা শুরু। এর শুরু যদি এ কালের ঘটনা হিসেবে দেখি, তবু এর শুরু কম করে ২০১৪ সাল থেকে। কিন্তু এ নিয়ে আপস আলোচনার ডায়লগের পথে কখনো দুপক্ষ যায়নি, যেতে পারেনি; যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজধানী কিয়েভে রাশিয়ান সেনারা পৌঁছানোর মুহূর্তে চীন-রাশিয়ার মধ্যে এক তথ্য বিনিময় ঘটেছে, আর তাতে চীনের দিক থেকে রাশিয়াকে এক প্রকাশ্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির এক নিউজে বলা হয়েছে, চীন ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে এখন ‘নিগোশিয়েশন’ করে নিতে আহ্বান জানিয়েছে; যদিও আপাতত এদিকে যাবার জন্য কোনো পক্ষ থেকেই কোনো নড়াচড়ার কোনো আভাস নেই।

নিজ নিরাপত্তাবোধের অভাব- সব সমস্যার শুরু এখান থেকেই। আর বিষয়টা অনেক অনেক পুরোনা। আর সেখানেই এই নিরাপত্তাবোধে অভাব ব্যাপারটা ঢুকে আছে। অটোমান সাম্রাজ্য এর সময়কাল (১২৯৯-১৯২২) যার তুলনায় রাশিয়ান জার সাম্রাজ্যের বয়স (১৮৯২-১৯১৭) অনেক কম। কিন্তু দুটা সাম্রাজ্যের আয়ু শেষ হয়েছিল কাছাকাছি সময়েই। সাম্রাজ্য মানে তার কিছু কলোনি বা উপনিবেশ থাকে। আর জার সাম্রাজ্যের আমলে নানা পথ ঘুরে ইউক্রেন রাশিয়ার উপনিবেশ হয়েছিল আর তা থিতু হয়েই ছিল। তবে অস্থির হয়ে যায় ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় লেনিনের কমিউনিস্ট বিপ্লব থেকে।

অনেকেই হয়তো খেয়াল রেখেছেন জারের রাশিয়ায় লেনিনের বিপ্লব হয়েছিল কেবল রাশিয়ায়, ওর সংশ্লিষ্ট উপনিবেশগুলোতেও না। ব্যাপারটা অনেকটা, আমরা যখন ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে ছিলাম তখন যদি ইংল্যান্ডে কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লব ঘটত তবে তখন কলোনি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াতে কি কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়েছে; ফলে তা কল্পিত ইংল্যান্ডের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের অংশ হয়ে যেত? নাকি তা ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াকে কলোনিমুক্ত করে দেয়া হতো? আলোচ্য ক্ষেত্রে যেন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে নয়া কমিউনিস্ট দেশ হয়ে গিয়েছিল।
ইউক্রেনের বেলায় ঠিক এটাই ঘটেছিল। তারা জারের উপনিবেশ ছিল বলে লেনিনের বিপ্লবের পরে কমিউনিস্ট রাশিয়ার সাথে যুক্ত করে নিলে তা সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে হাজির হয়, ১৯২২ সাল থেকে। অর্থাৎ একা ইউক্রেন নয়, জারের সব উপনিবেশকে অন্তর্ভুক্ত করে নয়া সোভিয়েত রিপাবলিক বলে রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। এতে ইউক্রেনও রাশিয়ান কর্তৃত্বের সোভিয়েত রিপাবলিক হয়ে যায়। বিপ্লব রাশিয়াতে হলেও রাষ্ট্র হিসাবে এর নাম হয়ে যায় ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ (১৯২২ সাল থেকে) আর রাশিয়ান ভূখণ্ডের তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন কয়েক গুণ বড় হয়ে যায়।

অনেকে এটাকে নয়া নামে লেনিনের উপনিবেশ এক্সটেনশন বলতে পারেন হয়তো। কিন্তু পেছনের মূল কারণ ছিল রাশিয়ান কমিউনিজমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দুনিয়ায় প্রথম কমিউনিস্ট বিপ্লব বলে আর খোদ ইউরোপের ঘটনা আর ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত এই সুযোগে ফাঁক গলে লেনিনের ক্ষমতা দখল করে নেয়ার ঘটনা ছিল সেটা। ফলে পরে তারা প্রচণ্ড ভীত ছিল যে ইউরোপের কলোনিমালিকেরা (তখনকার ব্রিটেন ফ্রান্স এরা ) কখন জানি হামলা করে। ম্যাপের দিকে তাকালে দেখব, মূল রাশিয়ার মোটামুটি চার পাশে বেষ্টন করে আছে সাবেক সোভিয়েতের ইউক্রেনসহ বাকি উপনিবেশগুলো। অর্থাৎ তাদের পেরিয়ে গেলে তবেই বাইরে থেকে রাশিয়া আক্রমণ করা যাবে। আবার ইউক্রেন হলো সবচেয়ে বড় ভূখণ্ড যার অপর দিকেই হলো পশ্চিম ইউরোপ। রাশিয়াকে যার ভয়ে সারাজীবন কাটাতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এরাই ইউরোপের মূল কলোনি দখলদার যারা এককালে আজকের আমেরিকাসহ সারা দুনিয়াকেই কলোনি করে রেখেছিল ১৯৪৫ সালের আগে পর্যন্ত।

রাশিয়ার নিরাপত্তাবোধের প্রশ্ন কবে থেকে
তাহলে কমিউনিস্ট রাশিয়ার আমল থেকেই নিরাপত্তাবোধের অভাব প্রসঙ্গটা তুঙ্গে উঠেছিল যে, তারা নতুন ধরনের (কমিউনিস্ট) রাষ্ট্র বলেই পড়শিদের থেকে বা তাদের মাধ্যমে অন্যের হাতে হামলার শিকার হয়। এমনকি এই নিরাপত্তাবোধের অভাব প্রশ্নটা এতই সিরিয়াস ছিল যে, এ থেকে নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব পর্যন্ত হাজির হয়ে ছিল যে, ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র’ করে তা টিকানো সম্ভব কিনা; সম্ভব করতে গেলে কী করতে হয় ইত্যাদি। এ নিয়ে তাদের নেতৃত্বে বিভক্তিও হয়েছিল সে সময়। সারকথায় ওই ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ার মূল কারণ ছিল নিরাপত্তাবোধের অভাব মিটানো। আর ইউক্রেন-রাশিয়ার বিশেষ নিরাপত্তা সম্পর্ক সেই থেকে। কারণ ইউক্রেন পশ্চিম ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে প্রটেক্ট করা সবচেয়ে বড় ও মূল ভূখণ্ড।

পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সাল থেকে আইসেনহাওয়ার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই ‘হকিশ’ বা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে সব কেড়ে নিয়ে যাওয়ার খারাপ দেশ হিসাবে পরিচিতির আমেরিকার জন্ম হয়। এটাকেই কমিউনিস্টদের ভাষায় আমেরিকার ‘সাম্রাজ্যবাদ’ হয়ে ওঠা বলা যায়। এমনকি তা কোল্ড-ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের কালের শুরু ধরা হয় যার অন্য একটা বড় কারণ হলো ‘পারমাণবিক অস্ত্রের’ জমানার শুরুও সেটা। সোভিয়েত ও আমেরিকা দুপক্ষই সেটার ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিল পরের ষাটের দশকজুড়েই। পারমাণবিক অস্ত্রের কথা ইউক্রেন নিয়ে আলাপে কেন তুললাম?

কারণ ওসব পারমাণবিক অস্ত্রের একটা বড় অংশই রাশিয়া মোতায়েন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মুখ ভূমি, ফ্রন্টাল স্টেট হিসাবে ইউক্রেনে। কারণ পশ্চিম ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করতে ইউক্রেনে বসেই তা ব্যবহার করা হবে। পরে সোভিয়েত ভেঙে গেলে, ইউক্রেন স্বাধীন হয়ে গেলে আস্তে আস্তে সেসব পারমাণবিক অস্ত্র তুলে বা খুলে ফেলা হয়।

এখন অনেকে যুক্তি তুলছে, সেসময় ওসব অস্ত্র রেখে দিলে আজ ইউক্রেনকে রাশিয়ার হাতে মার খেতে হতো না। এমন কথা ফ্যাক্টস নজরে না থাকার কারণে বলা হচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্র নিজেই এক বিরাট বোঝা- প্রধান কারণ অহেতুক বিরাট খরচ; যে খরচের পক্ষে সাফাই জোগাড় করা কঠিন। এ ছাড়া টেকনিক্যালি সাউন্ড স্টাফ লাগে প্রচুর আর এমন মোতায়েন থাকা অস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করা আরেক বাড়তি খরচ। কথাগুলো এভাবে বলা হছে এজন্য যে, অস্ত্রগুলো ইউক্রেনের ভূখণ্ডে মোতায়েন হলেও এর মালিক-কর্তা ও খরচ বহনকারী ছিল খোদ রাশিয়া। ফলে সোভিয়েত ভেঙে গেলে এটা ইউক্রেনের জন্য দায় হয়ে উঠেছিল। মোতায়েন অস্ত্রে জং ধরিয়ে তো কারো কোনো স্বার্থ নেই। তবে উল্টা স্বার্থ ছিল ন্যাটোর। অস্ত্রগুলো পশ্চিম ইউরোপের দিকে, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি- এসব দেশের দিকে তাক করা। কাজেই তাদেরই বড় স্বার্থ ছিল ইউক্রেনকে যেন পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করে দেয়া হয়। এখানে নেপথ্যে বলে রাখি, এখন পাঠকেরা বুঝবেন ইউক্রেনে হামলা স্রেফ ন্যায়-অন্যায়ের ইস্যু না। শুধু হামলার ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা দিয়ে এর সমস্যা বা সমাধান কিছু বুঝা যাবে না।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us