করোনা ভবিষ্যতে জীবাণু যুদ্ধের অস্ত্র হবে!
করোনা ভবিষ্যতে জীবাণু যুদ্ধের অস্ত্র হবে! - ছবি : সংগ্রহ
হিটলার, উইন্সটন চার্চিল, ওশো ওরফে রজনীশ- অনুসন্ধান করলে এদের মধ্যে একটা মিল পাওয়া যাবে। বিভিন্ন কন্সপিরেসি থিওরিতে তারা ছাড়াও পৃথিবীর তাবড় তাবড় নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জৈব রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা বা তা প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে তৈরি কোনো জীবাণু বা রাসায়নিককে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া এবং গণহত্যার চেষ্টা! একেই বলা হয় বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার! একুশ শতকের করোনা মহামারী সারা পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছে। একের পর এক ঢেউ, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট। এত পরীক্ষা নিরীক্ষা। যা দেখে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে যে তাহলে কি করোনা ভাইরাসকেও একটা বায়োলজিক্যাল এজেন্ট হিসেবে মানব জাতির ধ্বংস সাধনে ব্যবহার করা হতে পারে? আর সেটা সম্ভব হলেও কিভাবে তা আটকানো যেতে পারে?
১৯২৫ সালে জৈব অস্ত্রের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে তৈরী হয়েছিল জেনেভা প্রোটোকল। সেখানে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর ক্ষেত্রে ধরনের অস্ত্রের প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু তা নিয়ে গবেষণার উপর কোনো রকম বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়নি। পরে ১৯৭৫ সালে বায়োলজিক্যাল ওয়েপন কনভেশন-এ অবশ্য এই ধরনের অস্ত্র নিয়ে গবেষণা, তৈরির চেষ্টার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
এখন পর্যন্ত ১৯৭টি দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিছু কিছু দেশের ক্ষেত্রে আবার স্বাক্ষর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন করোনা ভাইরাসকে কি কেউ ব্যবহার করে জীবাণু যুদ্ধ ঘটাতে পারে?
২০১৮ সালে নয়েস আর এস এবং ইভান্স ডি এইচ নামে কানাডার দুই বিজ্ঞানী এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। কী সেটা? তারা বাজার থেকে আইনত ডিএনএ কিনে গবেষণাগারে তা থেকে সিন্থেটিক ডিএনএ বানিয়ে একটা হর্সপক্স ভাইরাস (ঘোড়ার বসন্তের ভাইরাস) তৈরি করেন যা দীর্ঘদিন আগে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আর এই কাজটা করতে মাত্র এক লাখ টাকার মতো। আসলে এই গবেষণার মাধ্যমে তারা এটাই দেখিয়েছিলেন যে আজকে আমাদের কাছে যে প্রযুক্তি রয়েছে, তার সাহায্যে একটা সাধারণ মানের গবেষণাগারে বসেও অত্যন্ত কম খরচায় একটা যে কোনো রকম সাংঘাতিক ভাইরাস তৈরি করা সম্ভব। তার মানে উদাহরণ স্বরূপ ধরে নেয়া যেতে পারে যে আমরা এইভাবে খুব সহজেই ১৯৮০ সালে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া স্মল পক্সের (গুটি বসন্ত) ভাইরাসও তৈরি করতে পারি।
যাবতীয় জীবাণুকে মূলত চারটে বিএসএল (বায়ো সিকিওরিটি লেভেল) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। ‘বিএসল ৪’ পর্যায়ে সবথেকে বেশি ক্ষতিকারক ও সংক্রমণ ঘটাতে পারে বা যে ভাইরাসের চিকিৎসা জানা নেই বা কোনো টিকা নেই সেরকম জীবাণুদের রাখা হয়। এইডস ক্ষতিকারক হলেও তার সংক্রমণের হার কম হওয়ায় সেটা কিন্তু এই পর্যায়ে নেই। অন্যদিকে ইবোলা, মারবার্গ বা নিপার মতো ভাইরাস দ্রুত সংক্রমণ ঘটায় বলে তাদের এই চতুর্থ পর্যায়ে রাখা হয়েছে। মজার বিষয় সংক্রমণ বেশি হলেও কোভিড ভাইরাস কিন্তু ‘বিএসল ৩’ পর্যায়ে রয়েছে। কারণ কোভিডে মৃত্যুর হার খুবই কম।
আমি এটাই বলতে চাইছি যে আজকে কোনো উন্নত গবেষণাগারে বসে সহজেই ‘বিএসল ৪’ পর্যায়ের একটি ভাইরাসও তৈরি করা সম্ভব।
সার্সকোভ-১-এর তুলনায় মার্স-কোভ করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি। ২০১২ সালে পশ্চিম এশিয়ার হজ যাত্রীদের মধ্যে উট থেকে এই ভাইরাসের সংক্রামণ ঘটেছিল। কিন্তু খুব বেশি ছড়ায়নি বলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ সঠিক সময়ে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কোভিডের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে ওমিক্রনে যখন বিএ.২ ভ্যারিয়েন্টটি তৈরি হল, তখন এটা আরো দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছিল। সেই সংক্রমণের হার ডেল্টার তুলনায় প্রায় ৭০ গুণ বেশি।
আমাদের কাছে এখন যে ধরনের প্রযুক্তি রয়েছে তা ব্যবহার করে ডেল্টার মতো মারণশীল এবং বিএ.২ এর মতো সংক্রামক একটা ভাইরাস খুব সহজেই তৈরি করা সম্ভব। তাই পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য তাত্ত্বিক করোনা ভাইরাসকে ভবিষ্যতে জৈব সন্ত্রাসের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে মনে করছেন না।
মনে রাখতে হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন (হু) বা আমেরিকার অধীনে তৈরি বিভিন্ন অনুসন্ধানকারী দল এখনও কিন্তু করোনা নিয়ে চীনকে সম্পূর্ণভাবে ক্লিনচিট দেয়নি।
এখনও বহু দেশের বৈজ্ঞানিক মহল ও তাত্ত্বিক মনে করেন যে করোনা ভাইরাস চীনের উহানের গবেষণাগারেই তৈরি করা হয়েছিল।
এবারে কতকগুলো কথা বলা প্রয়োজন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে সরকার এখনও যথেষ্ট সচেতন নয়। খোলা বাজারে এখনও ডিএনএ কিনতে পাওয়া যায়। ডিএনএ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য ব্যবহৃত ক্রিসপার-ক্যাসনাইন (CRISPR-Cas9) প্রযুক্তি আজকে সহজলভ্য। এই ধরনের জিন এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটা জিনের অংশ কেটে অন্য একটি জিনে আটকে দেয়া যায়। ফলে আপাত ভীতিহীন একটা ভাইরাসকে ইচ্ছানুযায়ী মারণশীল করে তোলা সম্ভব। আজকে কেউ চাইলে প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের ক্লোনিং সম্ভব। কিন্তু সেখানে আইনের বিধিনিষেধ রয়েছে। তাই ভাইরাসের ক্ষেত্রে উপরে আলোচিত বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো প্রয়োজনীয় কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত। কিছু দেশে এক্ষেত্রে আইন থাকলেও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এই ধরনের কোনো আইন নেই।
প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কোভিড আমাদের অনেকটাই সময় দিয়েছে। ভবিষ্যতে মিউটেশনের ফলে আরও নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা ঢেউ আসতেই পারে। আবার হতেই তো পারে যে ভবিষ্যতে এমন কোনও মারাত্মক অজানা ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটল যা অনেক বেশি মারণশীল। তাই সেদিনের কথা চিন্তা করে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নেগেটিভ প্রেসার আইসোলেশন ইউনিট কলকাতায় প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু অজানা ভাইরাসের মোকাবিলায় এই ধরনের ইউনিটের সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। করোনা আসার পর চারিদিকে ল্যাবরেটরির সংখ্যা বেড়েছে। করোনা শেষ হলেও যেন ল্যাবরেটরিগুলো তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখাটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষে আসছে ভ্যাকসিন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে করোনা ভ্যাকসিন মৃত্যুর হার কমাতে পারলেও রোগটাকে সম্পূর্ণভাবে আটকাতে পারছে না। কারণ সময়ের সঙ্গে এই ভাইরাসটা তার গতিপ্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। তাই এখন সেকেন্ড জেনারেশন ভ্যাকসিন তৈরির সময় এসেছে। অর্থাৎ বলতে চাইছি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন যেমন বছর বছর বদলায়, সেরকমই করোনা ভ্যাকসিনকেও উন্নত করার সময় এসেছে। আমার মতে শুধু একটা জিন দিয়ে ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড) না তৈরি করে পুরো ভাইরাসটাকে মেরে তার থেকে ভ্যাকসিন (কো-ভ্যাকসিন) তৈরি করা উচিত।
শেষ সর্বাপেক্ষা মারণশীল ও সর্বাপেক্ষা সংক্রামক এই দুটি ভাইরাসকে নিয়ে তার থেকে এই ধরনের ভ্যাকসিন তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে আরো গবেষণা করা উচিত। তাই আগামী দিনে করোনা মোকাবিলায় ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিনের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।
লেখক : সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, পরামর্শে কল্যাণী এইমস
সূত্র : বর্তমান