মাইগ্রেনের ব্যথার চিকিৎসা
মাইগ্রেনের ব্যথার চিকিৎসা - ছবি : সংগ্রহ
মাথাব্যথা খুবই কমন একটি জিনিস। মাথাব্যথা হয়নি এমন লোক এ জগতে পাওয়া দুষ্কর। মাথাব্যথাকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাইমারি মাথাব্যথা বলতে টেনশন টাইপ মাথাব্যথা, মাইগ্রেন, ক্লাস্টার মাথাব্যথা ও সেকেন্ডারি মাথাব্যথা হলো মস্তিষ্কের অন্য কোনো রোগ যেমন টিউমার, আঘাত, ইনফেকশন, রক্তক্ষরণজনিত। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হলো মাইগ্রেন।
যত প্রাইমারি মাথাব্যথা হয় এর প্রায় ১৬ শতাংশ মাইগ্রেন। মাইগ্রেন কতটা অস্বস্তিকর তা ভুক্তভোগীরাই বলতে পারেন। মাথাব্যথার কারণে তিন-চার দিন পর্যন্ত কোনো স্বাভাবিক কাজ, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে যেতে পারেন না। মাইগ্রেনের মাথাব্যথা সাধারণত কিছু দিন পরপর হতে থাকে। মাথাব্যথা মাথার এক পাশে শুরু হয়, তীব্র ব্যথা হতে থাকে যা আক্রান্তরা দপদপ বা চিলিকমারা ব্যথা বলে বর্ণনা করেন। কারো কারো মাথাব্যথা মাথার এক পাশে শুরু হয়ে মাথার চার দিকে ছড়াতে পারে। নড়াচড়া বেশি করলে ব্যথা বাড়ে। মাথাব্যথার সাথে বমি বমি ভাব বা বমি, আলো ও শব্দসহ্য করতে না পারার লক্ষণ থাকে। ব্যথা সাধারণত ৪-৭২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। কারো কারো মাথাব্যথা শুরুর আগে চোখে জোনাকি পোকা জ্বলার মতো জ্বলতে থাকে, কেউ কেউ আলোর ঝলকানি দেখে আবার কেউবা দেখে আলোর আঁকাবাঁকা লাইন। এর পরই শুরু হয় ব্যথা। এ লক্ষণগুলোকে বলে অরা। এ লক্ষণগুলো থাকলে ক্লাসিক মাইগ্রেন আর না থাকলে কমন মাইগ্রেন বলে। কিছু কিছু কারণে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়। এগুলোকে বলে মাইগ্রেন ট্রিগার। এগুলো হলো : ঘুমের অপর্যাপ্ততা, দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত থাকা, মানসিক ও শারীরিক চাপ। কিছু কিছু খাবার যেমন : চকলেট, অ্যালকোহল, পনির ইত্যাদি বেশি খেলেও শুরু হতে পারে ব্যথা। অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ ভ্রমণেও শুরু হতে পারে ব্যথা।
মাইগ্রেনের ব্যথার চিকিৎসায় বেশ ভালো ভালো ওষুধ আছে। সাধারণত ব্যথা শুরু হলে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। প্যারাসিটামল, ক্যাফেইনযুক্ত প্যারাসিটামল, ন্যাপ্রোক্সিন, আইবুপ্রোফেন, টলফেনামিক এসিড সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়। সাথে ওমিপ্রাজল, প্যানটোপ্রাজল সেবন করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যথা খুবই তীব্র হলে ট্রিপটান গ্রুপের ওষুধ যেমন সুমাট্রিপটান, জলমিট্রিপটান, এলিট্রিপটান সেবন করতে হয় বা ইনজেকশন আকারে দিতে হয়। তবে এ ওষুধ ব্যথা শুরুর দিকে বা শুরুর আগে দিলে ভালো কাজ করে। এ চিকিৎসাকে বলে অ্যাবোরটিভ চিকিৎসা।
মাইগ্রেনের ব্যথা যদি মাসে দুইবারের বেশি হয় বা অ্যাবোরটিভ চিকিৎসায় কাজ না হয় তাহলে ব্যথা প্রতিরোধ করার জন্য প্রিভেনটার ওষুধ চিকিৎসকরা প্রেসক্রাইব করেন। প্রিভেনটারের মধ্যে আছে বিটা ব্লোকার যেমন : প্রোপ্রানলল, এন্টিডিপ্রেসেন্ট যেমন অ্যামিট্রিপটাইলিন, নরট্রিপটাইলিন, এন্টিসাইকোটিক যেমন টপিরামেট, ভ্যালপ্রোয়েট, ফ্লুনারিজিন সেবন করার পরার্মশ চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন।
এ ওষুধগুলো প্রতিদিনই খেতে হবে। শুরু স্বল্পমাত্রা দিয়ে শুরু করতে হয়। এরপর রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী বাড়াতে হয়। ওষুধ কাজ করতে এক-দুই সপ্তাহ লাগে। ওষুধের ডোজ ঠিক করার পর নির্ধারিত মাত্রার ওষুধ একটানা ছয় মাস সেবন করতে হবে। ডোজ ঠিক করা মানে হলো ওই মাত্রার ওষুধ সেবনের মধ্যে মাইগ্রেনের ব্যথা না হওয়া। যদি ছয় মাস কোনো ব্যথা না হয় তাহলে আস্তে আস্তে ওষুধের ডোজ কমিয়ে দেখা যায় ওষুধ ছাড়া সুস্থ থাকা সম্ভব কিনা। যদি ওষুধের ডোজ কমানোর পরও ব্যথা না হয় তাহলে ধীরে ধীরে ওষুধ বন্ধ করার পরও ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে কারো কারো ওষুধ সেবন করে সুস্থ থাকতে হয়। অনেকেই আছেন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ বন্ধ করে দেন, শুরু করেন। এটা করলে সুস্থ থাকার সম্ভাবনা কম। আবার অনেকেই ঘন ঘন চিকিৎসক পরিবর্তন করেন।
এটাও ঠিক নয়। ধৈর্যসহকারে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে মাইগ্রেনের চিকিৎসায় ভালো ফলাফল আসার সম্ভাবনা বেশি। মাইগ্রেন প্রতিরোধে ঘুম পর্যাপ্ত হতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস করুন। অহেতুক রাত জাগবেন না। রাতের খাবার ঘুমানোর ২-৩ ঘণ্টা আগে সেরে ফেলুন। ঘুমানোর আগে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খান। কোনো বেলার খাবার মিস করবেন না। মানসিক চাপ ঝেড়ে ফেলুন। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন। অ্যালকোহল, সিগারেট, পনির, চকলেট পরিহার করুন।
লেখক : নিউরোলজিস্ট, ল্যাব এইড, গুলশান