আল-কুরআনের ব্যতিক্রমী নান্দনিক শিল্প-সম্ভার
আল-কুরআনের ব্যতিক্রমী নান্দনিক শিল্প-সম্ভার - ছবি : সংগ্রহ
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এমন একটি গ্রন্থ এবং আরবি এমন একটি ভাষা যাকে কেন্দ্র করে নানাপ্রকার নান্দনিক ও মননশীল শিল্পের বিকাশ ঘটে চলেছে। আরবি একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা হলেও প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে বিশ্বব্যাপী আরবির প্রচার ও বিস্তার ঘটেছে মূলত কুরআন মাজিদকে কেন্দ্র করেই। ফলে মুসলিম মানসে আরবি কেবল একটি ভাষা হয়েই থাকেনি- তাদের প্রিয়তম কিতাব কুরআন মাজিদের বাহন হিসেবেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আল-কুরআন মূলত একটি পথনির্দেশমূলক গ্রন্থ হলেও এই কুরআনকে কেন্দ্র করে এক বিস্ময়কর নান্দনিক শিল্প-সম্ভারও গড়ে উঠেছে। যেমন- এসবের মধ্যে রয়েছে সাধারণ তিলাওয়াত বা পাঠ, হেফজ তথা মুখস্থকরণ, কিরায়াত তথা বিশুদ্ধ পাঠ, লিপি শিল্প, ক্যালিগ্রাফি শিল্প, মুদ্রা ও শিলালিপি, সুর বা কণ্ঠশিল্প, ভাষা-অলঙ্কার ও বর্ণনা শিল্প, আরবি বর্ণ ও ভাষা চর্চা, গবেষণা ও সাহিত্য, অনুবাদ ও তাফসির প্রভৃতি। এসব বিষয় ও অনুসঙ্গগুলো বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রতিনিয়ত ব্যবহারিক ও আলোচনার অংশ হয়ে রয়েছে। এখানে সংক্ষেপে এগুলোর একটা পরিচিতি তুলে ধরা হচ্ছে :
সাধারণ তিলাওয়াত
প্রতিদিন দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ এই গ্রন্থের কোনো না কোনো অংশ তিলাওয়াত করেন। বিশেষ করে এর তিলাওয়াত ছাড়া নামাজ না হওয়ার শর্তের কারণে এর পঠন অপরিহার্য হয়ে গেছে। তা ছাড়া কুরআনের একেকটি অক্ষরের জন্য ১০টি করে সওয়াব বা বিনিময় লেখা হয়- এই ঘোষণার কারণে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে অবস্থানরত মুসলমান তাদের বয়স, শ্রেণী, পেশা ও স্থানের পার্থক্য নির্বিশেষে তিলাওয়াত জানা মানুষ সাধারণভাবে কুরআন পাঠে ব্রতী থাকেন।
হেফজ শিল্প
হেফজ করা বলতে কোনো কিছু মুখস্থ রাখা বা মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করা বুঝায়। বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের বেলায় এটি বিশেষভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। সারা দুনিয়ার কয়েক কোটি মানুষ এটি পুরোটাই মগজে গেঁথে রেখেছেন। এদের ‘হাফিজ’ বলা হয়। অন্য কোন পবিত্র বা কোনো সাধারণ গ্রন্থ এমন মর্যাদার অধিকারি হয়নি।
হাফিজের বাংলা প্রতিশব্দ রক্ষক। তবে হাফিজ বলতে বুঝানো হয় যার সমস্ত কুরআন (৩০ পারা) মুখস্থ আছে এমন মানুষকে। হাফিজা হাফেজ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ।
নবী মুহাম্মাদ (স:) সপ্তম শতাব্দীতে এমন এক আরবে বসবাস করতেন যেখানে খুব কম মানুষই শিক্ষিত ছিল। আরবরা তাদের ইতিহাস, বংশবিস্তার এবং কবিতা কণ্ঠস্থ করে রাখত। যখন মুহাম্মদ (সা:) কুরআনের আয়াতগুলো বলতেন, তখন সাহাবিরা সেগুলি মুখস্থ করে ফেলতেন। মুহাম্মাদ (সা:) এর ইন্তেকালের পরেও প্রায় ১০-১৫ হাজার হাফেজ ছিলেন বলে ধারণা করা হয়, যা কুরআনের সত্যতা প্রমাণ করে। সঠিকভাবে লিখার কোনো পদ্ধতির সাধারণ প্রচলন না থাকায়, লিখার চেয়ে মুখস্থ উৎসই বেশি নির্ভরযোগ্য ছিল সে সময়। সে সময় হাফেজদেরকে তেলওয়াতকারী বা আবৃত্তিকারী হিসেবেও খুব সম্মান করা হতো এবং যারা পড়তে জানতেন না তারা এভাবে কুরআনের দ্বারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হতেন। একজন হাফেজ হওয়ার জন্য পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করা আবশ্যক।
কেরায়াত
বিশুদ্ধ বা সহি তেলাওয়াত শিল্প- একমাত্র কুরআনই এই মর্যাদা লাভ করেছে- যেটি বিশুদ্ধভাবে পাঠ করার জন্য একটি পৃথক পদ্ধতি ও কৌশল গড়ে উঠেছে। এই পদ্ধতি-কৌশল যারা রপ্ত করেছেন তারা ‘কারি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এই বিশেষ বিশুদ্ধ পাঠের জন্য বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয় যেখানে কুরআন মুখস্থ করানোর সাথে সাথে সঠিক উচ্চারণরীতিও শেখানো হয়। মুসলিম সমাজে হাফেজ ও কারিগণ বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন।
বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিক্ষা করার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করে ও অপরকে তা শিক্ষা দেয়। (আবু দাউদ) তিনি আরো বলেন, যারা সহি বা শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে, তারা নেককার, তারা সম্মানিত ফেরেশতাদের সমতুল্য মর্যাদা পাবে এবং যারা কষ্ট সত্ত্বেও কুরআন সহি শুদ্ধভাবে পড়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়, তাদের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। (আবু দাউদ)।
সুর বা কণ্ঠশিল্প
কুরআন তেলাওয়াতকে কণ্ঠশিল্পের মাধ্যম হিসেবেও গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সুর লহরি দিয়ে এর মাধুর্য ও লালিত্য প্রকাশ বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সুর দিয়ে কুরআন পাঠের প্রতি রাসূল (সা:) গুরুত্ব দিয়েছেন। বারা ইবনে আজেব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহকে (সা:) এশার নামাজে সূরা ত্বিন পড়তে শুনেছি। আমি তাঁর চেয়ে সুন্দর কণ্ঠে আর কাউকে তেলাওয়াত করতে শুনিনি।’ (বুখারি ও মুসলিম)। সুর-সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করা সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াতের অংশ। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘সে আমার উম্মত নয়, যে সূর-সহযোগে কুরআন পড়ে না।’ (বুখারি, আবু দাউদ)
আল্লাহ কুরআন তেলাওয়াত শুনে থাকেন। রাসূল (সা:) বলেন, ‘আল্লাহ তা’য়ালা কোন বিষয়ের প্রতি এরূপ কান লাগিয়ে শুনেন না যেরূপ তিনি নবীর সুমধুর তেলাওয়াত শুনেন’। (বুখারি ও মুসলিম)। রাসূল (সা:) আরো বলেন, ‘তোমরা সুললিত কণ্ঠে কুরআনকে সুসজ্জিত করে পাঠ কর’। তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর। কারণ সুমিষ্ট স্বর কুরআনের সৌন্দর্য বাড়ায়’। সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াত করা কুরআনের সৌন্দর্য। রাসূল বলেন, ‘সুন্দর আওয়াজ (কণ্ঠস্বর) কুরআনের সৌন্দর্য’। তবে উল্লেখ যে, গানের সুরে ও বাজনার তালে তালে কুরআন তেলাওয়াত করা যাবে না।
আরবি বর্ণ ও ভাষা চর্চা
ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে আরবি বর্ণ ও ভাষা চর্চা পৃথক একটি স্থান লাভ করেছে। এখানে তাজবিদ, নাহু, সরফ, বালাগাহ প্রভৃতি নামে বিশেষ একটি শাস্ত্রসৌধ গঠিত হয়েছে। এর একটি বৃহৎ অংশ হয়ে গেছে কুরআন শরিফ।
সাইফুল ইসলাম তার গবেষণায় উল্লেখ করেন, শাস্ত্রীয় আরবি ব্যাকরণের জন্য ব্যাকরণ-বিজ্ঞান পাঁচটি শাখায় বিভক্ত :
১. আল-লুগাত (ভাষা/অভিধান), ২. আত-তাসরিফ বা আস-সরফ (রূপতত্ত্ব বা শব্দতত্ত্ব), ৩. আন-নাহু (বাক্য গঠন), আল-ইশতিকাক (শব্দের উৎস বা ধাতু নির্ধারণ) এবং আল-বালাগাত (অলঙ্কারশাস্ত্র)।
তবে আরব অঞ্চল ও ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন আরবি পাঠকেন্দ্রগুলোতে (যেমন মাদরাসা) মূলত আরবি ব্যাকরণের দু’টি শাখাকে প্রধান ধরা হয়, এগুলো হলো, প্রথমত, ইলমুস সরফ বা শব্দতত্ত্ব এবং দ্বিতীয়ত, ইলমুন নাহু বা বাক্যতত্ত্ব।
ভাষা-অলঙ্কার ও বর্ণনা শিল্প
আল কুরআনের রচনা ও বর্ণনাশৈলীও খুবই আকর্ষণীয় শিল্পসম্ভার। এর উল্লেখযোগ্য আলোচ্যবিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে আখ্যানভাগ বর্ণনা, শব্দ চয়ন, চরিত্র-চিত্রায়ন, ধ্বনির উত্থান-পতন, প্রতীক-উপমার ব্যবহার, অন্ত্যমিল ও ছন্দ, সম্বন্ধ অলঙ্কার, অনুকল্প, প্রতিরূপক, কল্পনালঙ্কার, ব্যক্তিত্ব আরোপ, সম্বোধন অলঙ্কার, বিপরীত অলঙ্কার, বক্রাঘাত, সুভাষণ, শব্দালঙ্কার, ভাষালঙ্কার, অনুপ্রাস, ব্যঙ্গ ও কৌতুকরস, রহস্যময়তা, খণ্ডবাক্য প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়। এর প্রতিটি বিষয়বস্তু পৃথক পৃথকভাবে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
লিপি শিল্প
কুরআনের আয়াত ও আরবি লিপিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিপি শিল্প। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই হস্তলিপির চর্চা হয়ে থাকে। আরবি লিপিমালার মধ্যে মুদাওয়ার, মুসাল্লাস, তাইম, মাবসুত প্রভৃতি লিখন পদ্ধতি বা লিপির কথা প্রচলিত ছিল। পরে সুল্স, নাসখ, মুহাক্কাক, রায়হান, তাহকি এবং রিকা নামক ছয়টি আরবি লিখনপদ্ধতির আবিষ্কার করা হয়।
ড. এ কে এম ইয়াকুব আলী বলেন, গজনির সুলতান ইবরাহীম বিন মাসউদ স্বহস্তে অতি সুন্দর লিপিতে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করে প্রত্যেক বছর মক্কায় প্রেরণ করতেন। দিল্লির মামলুক সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ প্রতি বছর অতি মনোরম হস্তাক্ষরে দু’টি করে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন। মোগল সম্রাট বাবর বিশেষ হস্তলিখন পদ্ধতিতে কুরআনের অনুলিপি তৈরি করে প্রত্যেক বছর একটি করে কপি মক্কায় প্রেরণ করতেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর সুন্দর হস্তাক্ষরে নিজের হাতে কুরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করে এবং মনোরমভাবে বাঁধাই করে দু’টি করে কপি মদিনায় পাঠিয়ে দিতেন। প্রতিটি কপির মূল্য ছিল পাঁচ হাজার টাকা। এই উদাহরণ হতে ক্যালিগ্রাফি বা সুন্দর হস্তলিখন শিল্পের উন্নত মান সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
ক্যালিগ্রাফি শিল্প
লিপি শিল্পেরই আরেক নান্দনিক ও বিস্তৃত শিল্প হলো ক্যালিগ্রাফি। প্রাচীনকাল থেকেই ক্যালিগ্রাফি শিল্পের বিকাশ হতে থাকলেও আধুনিককালে মূর্তচিত্রের বিপরীতে বিমূর্ত শিল্পের বিকল্প হিসেবে ক্যালিগ্রাফি শিল্প বিকশিত হয়েছে। এতে প্রধানত কুরআনের আয়াত বা আরবি লিপি ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই শিল্পের ধারাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ কুফি, নাসিখ, মাগরিবি, তা’লিক, নাস্তালিক, দিওয়ানী, তুঘরা প্রভৃতি।
কালিগ্রাফি শিল্পীরা অন্য মাধ্যমের চেয়ে কুরআনের আয়াতকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং এর জনপ্রিয়তাও বেশি। ইসলামী শিল্পচেতনার প্রতি আগ্রহী মানুষেরা তাদের ড্রয়িংরুমে ক্যালিগ্রাফিসংবলিত চিত্রকে স্থান দিতে বেশি পছন্দ করে থাকেন।
এ বিষয়ে ড. এবনে গোলাম সামাদ উল্লেখ করেন, মানুষ ও জীবজন্তুর মূর্তি গড়া মুসলমান সমাজে উৎসাহ পেতে পারেনি। অন্য দিকে লিপিকলার ক্ষেত্রে ইসলামী শিল্পকলা দেখিয়েছে এক চরম উৎকর্ষ। এই উৎকর্ষ দেখার অন্যতম কারণও হলো ধর্মবিশ্বাস। কুরআনে বলা হয়েছে, “পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন; যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়, কারণ তোমার প্রভু, পরম দয়ালু; তিনিই মানুষকে শিখিয়েছেন লেখনির ব্যবহার। তিনিই মানুষকে শিখিয়েছেন, মানুষ যা জানতো না” (সূরা ৯৬, আয়াত ১-৪)। তাই সুন্দর হস্তাক্ষর মুসলমান সমাজে বিশেষভাবে আদৃত হতে পেরেছে বিশেষ অনুশীলনের বিষয়। ইসলামী শিল্পকলা নামটির যথেষ্ট সার্থকতা আছে। কারণ, মুসলমান ধর্ম এই শিল্পকলার মূল চরিত্রকে একাধিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে; একটি সাধারণ ঐক্য বা সমরূপতা প্রদানে সক্ষম হয়েছে।
মুদ্রায় কুরআনের আয়াত
মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে প্রচলনকৃত মুদ্রায় কুরআনের আয়াত তথা আরবি লিপি উৎকীর্ণ করার বিষয়টি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ইসলামী খিলাফতের প্রাথমিক যুগেই এর সূচনা হতে দেখা যায়। হজরত উসমান ইবনে আফ্ফান (রা:) খিলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর (২৩ হি./৬৪৪ ইং) মুদ্রা হিসেবে ‘দিরহাম’ তৈরি করেন এবং এতে ‘আল্লাহ আকবার’ লিখে নকশা করা হয়। পরবর্তীকালে হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর কার্যক্রম শুধু ‘দিরহাম’ তৈরি করার মধ্যেই থেমে ছিল না, তিনি ৪১ হিজরি/৬৬১ ইং সনে ‘দিনার’ও তৈরি করেন। জানা যায়, চীন প্রজাতন্ত্রের ‘সিয়ান’ নামক গোরস্থানে তিনটি আরবি স্বর্ণের টুকরা আবিষ্কৃত হয়। এতে পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওই মুদ্রাটির ব্যাস ১/৯ সেমি, ওজন ছিল ৪.৩ গ্রাম, পুরু এক মিলিমিটার। এক পিঠের মধ্যস্থানে তিন লাইনে আরবিতে লেখা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু’, ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ, আরছালাহু বিল-হুদা ওয়া দিনিল-হাক্ক’। প্রত্যেক মুদ্রার অপর পিঠে কুফি অক্ষরে নকশা বিদ্যমান ছিল, সেখানে লেখা এ দিনারটি তৈরি করা হয়েছিল হজরত মুয়াবিয়ার (রা:) সময়।
খলিফা আবদুল মালিক দিনারের উপর এক দিকে ‘কুল হু আল্লাহু আহাদ’ খোদাই করেন এবং অপর দিকে ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু’ নকশা করেন। দিনারের চার দিকে চান্দীর একটি গোল বৃত্ত ছিল। এ বৃত্তের উপর ভাগে ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ...’ লেখা ছিল।
প্রত্নবস্তুতে কুরআন
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণগুলো মূলত ইতিহাসের অলিখিত উপাদানভুক্ত। যেমন- শিলালিপি, তাম্রলিপি, স্তম্ভলিপি প্রভৃতি। এসব বস্তুতে বিভিন্ন স্থাপনার পরিচিতিমূলক লিপি প্রাধান্য পেলেও অনেক লিপিতেই কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত থাকতে দেখা যায়। মোহাম্মদ আবদুর রহীম বাংলায় লিপি শিল্পের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, বাংলায় সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠার পরই শৈল্পিক আবহ ও পটভূমির আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করে। নবাগত মুসলিম সুলতানদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও স্থাপত্য অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলায় নতুন আঙ্গিকের ইমারত, দালান-কোঠা ও নির্মাণ প্রকল্প স্থাপন হতে লাগল। যেখানেই ইমারত বা নয়া স্থাপনা হলো, সেখানে একটি করে শিলালিপি স্থাপনার সাথে জুড়ে দেয়া হলো। সেটি শুধু তথ্য সংরক্ষণ তা নয়, বরং তাতে অত্যাশ্চর্য শিল্প সৌকার্য ফুটিয়ে তোলা হতো। এতে স্থাপনাটি ভিন্ন একটি রূপ পেল। অন্য দিকে ভাস্কর্য শিল্প বা মূর্তি নির্মাণে শিল্পীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। ধারণা করা হয় যে, মূর্তি শিল্পের গ্রাহক ব্যাপকসংখ্যক মাত্রায় হ্রাস পাওয়ায় এ শিল্পে ধস নেমেছিল। সুলতানি শিলালিপির (১২০৪-১৫৭৬ খ্রি:) ব্যাপকতার প্রবল প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলা মুলুকে। দেশের আনাচে-কানাচে যেখানে কিছু নির্মাণ করা হতো, তার সাথে একটি আরবি-ফারসি শিলালিপি দিয়ে শোভা বর্ধন করতে হবে- এমন রীতি গড়ে উঠল। এভাবে বাংলায় সুলতানি শিলালিপির একটি বিশাল ও সমৃদ্ধ ভাণ্ডার তৈরি হলো। এই ভাণ্ডারের আরবি-ফারসি লিখনশৈলীর বিচিত্র ও নয়নাভিরাম রীতিগুলো গবেষক, দর্শক ও পাঠককে আকর্ষণ ও মুগ্ধ করেছে।
গবেষণা ও সাহিত্য
কুরআনের বিপুল ভাণ্ডারকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে অসংখ্য গবেষণাপত্র ও গ্রন্থ রচিত হয়েছে। একে কেন্দ্র করে সাহিত্য-ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ এককভাবে এমন সুযোগ পেয়েছে বলে জানা যায় না। বিশেষত পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এর অনুবাদ ও তাফসিরগ্রন্থ রচিত হয়েছে- যা এই গ্রন্থকে বিশ্বব্যাপী বিপুলভাবে পরিচিতি প্রদান করেছে।
এ ধরনের তাফসির গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে :
তাফসির ইবনে কাসির, তাফহিমুল কুরআন, তাফসির আল মাতুরিদি, মাআরিফুল কুরআন, বয়ানুল কুরআন, তাওযিহুল কুরআন, দ্য মেসেজ অব দ্য কুরআন, তানবির আল মাকবাস, তাফসির ইমাম জাফর আস সাদিক, তাফসির আল তাবারি, তাফসিরে কাবির, আহকামুল কুরআন, তাফসির ইবনে আব্বাস, তাফসিরে কুরতুবি, আহকাম আল কুরআন, তাফসির আল জালালাইন, তাফসির ফাতহুল মাজিদ, তাফসিরে আশরাফী ইত্যাদি। এ ছাড়াও কুরআনের অনুবাদ করতে গিয়ে কাব্য ও ছন্দের আশ্রয় নেয়ার বিষয়টিও কম উল্লেখযোগ্য নয়।
কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্ট এসব শিল্পকর্ম সম্পর্কে আলোচনার করতে গিয়ে এটি প্রতীয়মান হয়েছে যে, পৃথিবীর একমাত্র গ্রন্থ হিসেবে কুরআনই একমাত্র বহুমাত্রিক ব্যবহারের সুযোগ লাভ করেছে। তবে এই বিষয়গুলোর চেয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল বিষয়ই হলো- কুরআনের বাণীর মর্ম উপলব্ধি করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর অনুসরণ ও অনুশীলন করা। এই কার্যক্রম থেকে বিচ্যুত হলে এর কোনো শিল্পমূল্যই কাজে আসবে না। কুরআনের জিকির ও হেদায়তই হলো এর আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
তথ্যসূত্র :
১. উইকিপিডিয়া।
২. এ কে এম ইয়াকুব আলী : মুসলিম মুদ্রা ও হস্তলিখন শিল্প, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৯।
৩. এবনে গোলাম সামাদ : ইসলামী শিল্পকলা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৮।
৪. সাইফুল ইসলাম : আল-কুরআনের বর্ণনাশৈলী ও ভাষালঙ্কার, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০২১।
৫. মুফতি মাহমুদ হাসান : কালের কণ্ঠ, ৩ জুলাই, ২০১৫।
৬. মোহাম্মদ আবদুর রহীম : দৈনিক সংগ্রাম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
৭. মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, যুগান্তর, ৫ নভেম্বর ২০২১।