শ্বশুরবাড়ি

ফাবিহা ফেরদৌস | Feb 19, 2022 05:50 pm
শ্বশুরবাড়ি

শ্বশুরবাড়ি - ছবি : সংগ্রহ

 

আমার ছোট জায়ের বাপের বাড়ি থেকে ভালো ভালো জিনিসপত্র এলে আমার শাশুড়ি আমার দিকে আড়চোখে তাকান।
এই তাকানোটা যে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি সেটা আমি ঠিকই বুঝতাম।
আমার স্বামী আর দেবর দুজনই পিটাপিঠি। বয়সের পার্থক্য মাত্র এক বছর।
আমার বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমার দেবরের বিয়ে হয়ে যায়। ঘরে আসে নতুন জা।

শাশুড়ির ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির আরো অনেক অর্থ ছিল। আমি সাংসারিক কাজে খুব একটা পটু না। বিশেষ করে মেয়েলি কাজে। এসব ক্ষেত্রে আমার জা আমার থেকে অনেক এগিয়ে।

যেমন বিভিন্ন ধরনের সেলাইয়ের কাজ, পিঠা বানানো আরও খুটিনাটি হাতের কাজ এসব আমি একদমই পারতাম না।
এর আরও একটা কারণ আমি ব্রোকেন ফ্যামলির মেয়ে। আমি আমার বাবার কাছেই বড় হয়েছি বান্দরবানে। মা কোথায় সেটা আমি জানি না। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি এই প্রশ্ন আর বাবাকে করা হয়নি। যতটুকু জানার তা একটা ডায়রী থেকে জেনেছি।

আমার স্বামী আদিবের সাথে পরিচয় ভার্সিটিতে। সেখান থেকে পরিচয় প্রণয় অতঃপর বিয়ে। আদিবের পরিবারের কিছু অমত থাকলেও ছেলের জেদের কাছে হার মানেন।

ও আরো একটা বিষয়। দেবরের বিয়ের ছয় মাস পর থেকে আমার জায়ের জন্য ওর বাপের বাড়ি থেকে কিছু এলে ঠিক সেরকম কিছু আমার জন্যও থাকত। হোক শাড়ি কিংবা থ্রিপিস।

আমার জায়ের মা বেশ শিক্ষিত মার্জিত ভদ্র অমায়িক মহিলা। যেদিন থেকে জানতে পারলেন আমার মা নেই। মা ছাড়া শুধু বাবার কাছে বড় হয়েছি তখন থেকে একটু বেশি স্নেহ করতে লাগলেন আমায়।
এসব নিয়ে আমার জায়ের কোন অভিযোগ নেই। বরং ওর মা আমায় এমন স্নেহ করেন বলে আমিই ওর একটু বাড়তি খেয়াল রাখতাম।

বাবা আমার বাড়িতে খুব একটা আসতেন না। আসলে নাকি এখান থেকে একা একা ফিরে যেতে কষ্ট হয়। কষ্ট হওয়ারই কথা আমি ছাড়া বাবার আর কেউ নেই। আর কেউ নেই বললেও ভুল হবে। বাবা একটু ভাবুক টাইপের মানুষ।

সারাদিন প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়িয়ে কিংবা কোনো পাহাড়ের চূড়ায় বসে কোন বই হাতে সারা দিন কাটিয়ে দিতে পারেন দিব্যি।

কিংবা সন্ধ্যায় বাসার পাশে শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে রাতের খোলা আকাশের নিচে বসে কত রূপকথার গল্প বলতেন আমায় তার হিসেব নেই। আমি সেই রূপকথার স্বপ্নপুরীতে মায়াজালের স্বপ্ন বুনতাম।
অসম্পূর্ণ পরিবারে বেড়ে উঠা আমার। আমি স্বপ্ন দেখতাম একটা হাস্যউজ্জ্বল সম্পূর্ণ সুখী পরিবার।

সেতারা বাজিয়ে চোখ বন্ধ করে আমার মায়াজালকে স্পর্শ করতাম নিজের কণ্ঠ দিয়ে। ভার্সিটিতে আমার এই সেতারার সুরের মায়ায় আটকা পড়ে আদিব।

বাবা এক হাত মাথায় রেখে অন্যহাত দিয়ে চোখের জল মুছে দিতেন।
বাবা বলতেন, কষ্ট পাচ্ছিস মা?
আমি তখনি চোখ খুলে বলতাম কই না তো বাবা!

বাবা আবার বলতেন, ভেতরে কষ্ট জমা না থাকলে কণ্ঠে এমন সুর আসে না রে মা আমি জানি! এই বাবার কাছে লুকাবি?

আমি তখনি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম না বাবা আমার সবকিছুই তুমি। আমার পরিবার বাবা মা ভাইবোন সবই তুমি।

আমার পুরো পৃথিবী বলতে ওই একটা মানুষ। রাগ সুখ দুঃখ হাসি কান্না সব সব ওই আমার বাবা নামক মানুষটা।
বান্দরবানে খুব কাছের রক্তের সম্পর্কের বলতে আমার কেউ নেই। বাবা খুব ছোটখাট একটা সরকারি চাকরি করেন। খুলনা নিজ বিভাগ হতে দুই যুগ হতে চলল তিনি এখানে এসেছেন।

প্রথম প্রথম খুলনায় যেতেন বছরে একবার। দাদা দাদি মারা যাওয়ার পর আর যাওয়া হয় না বললেই চলে।
কেন যাওয়া হয় না তা অবশ্যই বলব।

খুব ভোরে উঠে পড়া আমার অভ্যাস ছোটোবেলা থেকেই। নামাজ, চা খাওয়া সব শেষ করে রুম থেকে বাড়ির গেট অব্দি হাটাহাটি করে। বাকিরা একটু দেরি করেই উঠেন। তখন দেখি রাস্তায় অনেক মহিলারা সকালে হাঁটাহাটি করেন স্বাস্থ্য বিধি মেনে। কখনো মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে থাকলে কারো কারো সাথে কথা হয়।
কুশল বিনিময় হয়।

এটা আমার শাশুড়ি মোটেও পছন্দ করতেন না।
আমি প্রকৃতিতে বড় হওয়া মেয়ে কেমন জানি বন্দি বন্দি লাগে চার দেয়ালের মাঝে। শহুরে জীবনে খুব একটা অভ্যস্ত নই। ভার্সিটিতেও আমি এমন ছিলাম।
আমার কোল জুড়ে যখন রাফিন আসে তখন একমাত্র শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছাড়া আমাকে দেখাশোনা করার মত কেউ ছিল না।

মেয়েরা মা হলে সন্তান জন্মদানের পরের কদিন নতুন মা হওয়া মেয়ের মায়েরা এসে নিজের মেয়ের যত্ন নেন নাতি/নাতনির যত্ন নেন রোজ রোজ আসা যাওয়া করেন। বেশি জরুরি হলে ২/১ দিন মেয়ের সাথে থাকেন। আমার তেমন কিছুই নেই।
শ্বশুরবাড়িতেও খুব বেশি লোকজন নেই।
বাবা সপ্তাহে ২/১ বার আসতেন। এরবেশি সম্ভব হত না। বাবার চাকরি আর রাস্তার দূরত্বটাও অনেক। বয়স হচ্ছে জার্নি করতে পারেন না খুব বেশি।

অথচ আমার জা যখন মা হলো! তখন আমি দেখলাম একজন মা কত আয়োজন করে মেয়ের বাড়ি আসে। কত যত্ন করে নিজের মেয়ে আর সদ্য জন্ম শিশুর!
মাঝে মাঝে আফসোস হলেও ভাগ্যকে মেনে নিই।
মা হওয়ার সময় একটা মেয়ের অন্যরকম ভরসা হয় নিজের মা সেই শূন্যতাটা আমি খুব করে অনুভব করেছি।
আমার বাবার বাড়িতে আমার সাথে খুব বেশি কেউ যেতেন না।

বিয়ের পর নতুন নতুন কয়েক দিন শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন নিয়ে বাড়ি গিয়ে ছিলাম এরপরে আর যাইনি।
আমার শাশুড়িই তেমন কাউকে যেতে মানা করতেন। কারণ বাড়িতে বাবা একা।

কোনো মেহমান আসার কথা থাকলে বাবার উপরেই একটু চাপ পড়ে যায়। পাশের বাড়ির পরিচিত চাচিরা কিংবা পরিচিত বোনরা রান্নার জোগাড় সহ টুকটাক কাজ করে দিলেও বাকিগুলো বাবাকে করতে হত একা। কাজের লোকদের কাজও বাবা খুব একটা পছন্দ করেন না। বাবা নিজের কাজ নিজেই করেন।

এই বিষয়টা আমার শাশুড়ি লক্ষ্য করার পর থেকে আমার সাথে তেমন কাউকে যেতে দিতেন না বাবার কষ্ট হবে ভেবে। মায়ের এই বিষয়টা আমারও খুব ভালো লেগেছে।
এরপর যদিও আমি ২/১ জনকে নিয়ে যেতাম তখন বাবাকে আগে বলে রাখতাম শুধু বাজার করে রাখতে আমি এসে রান্না করব। আর কিচ্ছু করা লাগবে না।

খুব অনুভব করতাম মায়ের অনুপস্থিতি সংসারে কেমন হয়!
ছোটো থেকে বড়ো হতে এতটা অনুভব করিনি যখন বিয়ের পর বাবাকে একা ছেড়ে আসি তখন যতটা অনুভব করেছি।
আমার জায়ের ছেলের আকিকা।

খুব কাছের আত্মীয়রা বাসায় এসেছেন। বাবাও এলেন।
আমার জায়ের মা তো আর এলেনই। নিজের নাতির জন্য যেমন জামা এনেছেন ঠিক তেমন আমার ছেলের জন্যও এনেছেন। আমার গালে হাত রেখে সবসময় উনি বলেন, 'তোমার চেহারাটা খুব মায়াবি, ভীষণ আপন আপন লাগে।'
কথাটা শুনলে ভালো লাগে আবার খারাপও লাগে। নিজের একজন মা থাকলে হয়ত আরো কত আদুরে কথা বলতেন!
বাবার সাথে উনার পরিচয় নেই বললেই চলে। আমার দেবরের বিয়ের সময় বাবা খুব অসুস্থ ছিলেন তাই আসেননি আর পরিচয়ও হয়নি। এরপরে বাবা এসেছেন ঠিক তবে দেখা হয়নি কারোর। তাই আমি বাবাকে উনার কথা বললাম। বাবা খুব খুশি হয়ে বললেন উনি পরিচিত হতে চান তার সাথে।

খাবার টেবিলে যাওয়ার আগে সবাই ড্রয়িংরুমে বসা ছিলেন। তখনই জায়ের রুম থেকে আন্টিকে ডেকে আনলাম বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে।

দুজন মুখোমুখি হওয়ার পরই যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
কারো মুখে কোন কথা নেই! শুধু অপলক দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে আছেন। সেই দৃষ্টি যে একে অপরের পরিচিত দৃষ্টি খুব ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল।
আমি তখন বলে উঠলাম বাবা তুমি কি আগে থেকেই আন্টিকে চেনো?
বাবা তখন সব নীরবতা ভেঙে বললেন, মাহেদা তুমি এখানে? আমার মেয়ে রিমির জা সৃষ্টি কি তোমার মেয়ে?
আন্টির দিকে তাকাতেই দেখলাম উনার চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে!

এই অশ্রুর মানে তো অনেক কিছু!

মাহেদা আন্টি তখন আবারো আমার গাল স্পর্শ করে শুধু বললেন! এত বড় হয়ে গেছে! তাও এতদিন ধরে আমার সামনেই ছিলো! তাই তো মনের মধ্যে কোথাও একটা টান অনুভব করতাম মা তোর জন্য!
আমি এই কথার কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না! নাকি...

বাবা আমার হাত ধরে টেনে উনার কাছে নিয়ে এসে বললেন, এই সন্তান শুধু আমার। তোমার কোনো অধিকার নেই ওর উপর। যখন সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে গিয়েছিলে তখন সব অধিকারও হারিয়ে ফেলেছ।
আমার শাশুড়ি স্বামী দেবর সবাই তখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।
আমি ভাবছিলাম কিসের কার বন্ধন আর কোথাকার অধিকার!

আমি যতটুকু জানি তা হলো-
আমার বাবা মৌলভী বংশের ছেলে। গ্রামের অত্যন্ত সম্মানী আর সচ্ছল পরিবার। ওই বংশের সবাই মাদরাসা লেভেলে পড়াশোনা করেছেন একমাত্র বাবা ছাড়া।

তিনি একটু জেদি আর একরোখা টাইপের ছিলেন সেই ছোটোবেলা থেকে।
পরিবারের সবার বিপরীতে উনার পড়াশোনা। পড়াশোনায়ও অনেক ভালো ছিলেন। পুরো গ্রামের মধ্যে প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া মানুষটি আমার বাবা!

পরিবারের অমত থাকলেও নিজ জেলার বাইরে চলে যান তিনি। আর সেখানেই পরিচয় হয় মায়ের সাথে। একই ডিপার্টমেন্ট এর স্টুডেন্ট। বাবা প্রেম ভালোবাসা নামক বিষয়গুলো তে উদাসীন থাকলেও মায়ের আগ বাড়িয়ে ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশটা বাবার উপর বেশ ভালো ভাবেই প্রভাব ফেলে।
প্রথম একটু এড়িয়ে চললেও ভার্সিটি ফাংশনে মায়ের নজর কাড়া নৃত্য বাবাকে বেশ আকৃষ্ট করে। এরপর থেকে দুজনের প্রণয়!

কিন্তু বিপত্তি বাঁধে বাবা যখন মাকে উনার পারিবারিক অবস্থার কথা জানান!
খুব ভালো করেই বলেন যে বাবার পরিবারে এরকম নাচ গান মোটেও গ্রহণ যোগ্য না । বিয়ে না হয় কোনরকম সবাইকে ম্যানেজ করে মানিয়ে নিলেন কিন্তু ঘরের বউয়ের এমন শখ বা পেশা কেউ কখনো ভুল করেও মানবে না।
মা নাকি এটা শোনার পর বেশ কয়েক দিন বাবার সাথে যোগাযোগ করেনি।
এই বিরহ মুহূর্তে বাবা লিখেছিলেন অনেকগুলো কবিতা যার ছায়াপট শুধু মাকে নিয়ে!
কিন্তু সেগুলো মা অব্দি পৌঁছাননি!

কারণ কারো ব্যক্তিগত কিছু বিসর্জন দিয়ে জোর করে কাউকে জীবনে আনতে চান না। এতে সেই মানুষটির অস্তিত্ব বিসর্জনও হয়ে যেতে পারে!

মা-বাবা দুজনই ইংরেজি সাহিত্যের স্টুডেন্ট আর একটু ভাবুক স্বভাবের ছিলেন বাবা আগে থেকেই।
দীর্ঘ দু মাস পর মা নাকি ছুটে এসেছিলেন বাবার কাছে পাগলের মত!
সব ছেড়ে এই ভাবুক টাইপ নির্ভেজাল শান্ত মানুষটিকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চান বাকিটা জীবন।
অনেক মতের অমিলের পরেও দুজনের বিয়ে হয়। ভালোই চলছিল সব।
একটু পর্দাশীল সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়ে ছিলেন মা।

বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। আমার বয়স যখন তিন ছুইছুই তখন শহর থেকে কোন এক বান্ধবীর মারফতে খবর আসে ভার্সিটি থেকে সব পুরনো স্টুডেন্টদের মধ্য থেকে তিনজনকে সিলেক্ট করা হয় 'বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম' এর জন্য। সেখান থেকে বিজয়ীকে অনেকে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। এমনকি আরও ভালো হলে দেশের বাইরেও যাওয়ার সুযোগ।
মানে মোটামুটি নিজের একটি পরিচয় তৈরি করার মতো একটা সুযোগ বলা যায়!
এটা শোনার পর থেকে মা খানিকটা বিষন্ন হয়ে পড়েন। আবার অনেক দিনের লালিত স্বপ্নটা আবার জেগে উঠতে শুরু করে!

দুটানায় পড়ে যান। যার জন্য সব ভুলে এক পথ বেছে নিয়ে ছিলেন তাকে তো পাওয়া হয়ে গেছে সে আছেও সাথে। এখন যা পাওয়া হয়নি তার প্রতি আকর্ষণ যেন দূর্নিবার!
বাবাকে এই কথা জানালে বাবা প্রথমেই অমত করলেন। তিনি এসব নিয়ে আগেও কথা বলেছেন আর কোনো কথা হবে না। এটাই শেষ।

অন্যদিকে শহরে থেকে মায়ের কাছে খবর আসতে থাকে। বাবা শেষমেষ বলেন উনি উনার মা বাবার কাছে পারমিশন নেবেন, তারপর যা হয় করবেন।

কিন্তু পরিবার এসব বিষয়ে শুনতেই নারাজ। আমার দাদা ছিলেন মুফতি। আর মুফতির ছেলের বউ স্টেজে উঠে নেচে সবার মনোরঞ্জন করবে- এটা ভাবাই পাপ মনে করেন!
বাবার তখনো আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি স্বল্প বেতন। ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন চাকরি পরিক্ষা দিতে লাগলেন।

লাস্ট যখন ঢাকায় ভাইবা দিতে যান সেই জবটা হয়ে যায়! বাবা এতটা খুশি ছিলেন! উনার পোস্টিং ছিল ঢাকায়। যতই হোক প্রিয় মানুষটার আবদার স্বপ্ন বা ইচ্ছা কখনো ইগনোর করা যায় না আর করা ঠিকও না। যেহেতু বাবার এখন ঢাকায় থাকবেন স্ত্রী সন্তান নিয়ে সেহেতু লুকিয়ে মাকে প্রোগ্রামে পার্টিসিপেট করাতে পারবেন।
আর এমনটাই ভেবে রাখলেন।

যখন এই খুশির খবর নিয়ে গ্রামে পা রাখলেন তখনই খুব বাজে একটা সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। মুফতি সাহেবের ছেলে জিহাদের বউ কার সাথে নাকি পালিয়ে গেছে!
এই খবরটা বাবাকে যেন একদম বোবা বানিয়ে দিলো! এতটুকু ভরসা ছিল সংসারে বিশ্বাসের ঘাটতি হবে না কারো। হয়ওনি কিন্তু এমন খবর যেন বাবাবে একদম ভেঙ্গেচুরে দিলো।

তবে মায়ের রেখে যাওয়া একটা চিঠিতে এতটুকু স্পষ্ট হয় উনি কারো সাথে পালাননি, শুধু নিজের জীবনের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি বলে এই সিদ্ধান্ত নিলেন।
এরপর বাবাও মাকে খুঁজেননি কিংবা কোনো খবরও নেননি।
বাবা অনেক অভিমানী মানুষ!

তবে এখানে কার দোষ কতটা সেটা পরিমাপ করাটাও বেশ কঠিন। মা ছিলেন স্বাধীন চেতনার মানুষ।
এসব বদনামে বাবা যেন আর থাকতে পারছিলেন না। নতুন চাকরিতে যোগদান করে আমাকে নিয়ে ঢাকায়ও থাকেননি। সোজা দেশের অন্যপ্রান্তে সব ছেড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক কষ্টে বদলির ব্যবস্থা করেন। বাবা চান না মানুষের এসব কথার খোটা শুনে আমি বড় হই। এরপর থেকে সেখানে জীবন নির্বাহ! আর আমার বেড়ে উঠা।
আজ সামনাসামনি হয়ে বাবার অনেক অভিযোগ রয়েছে উনার চোখের ভাষায়। শুধু একটি কথা বললেন তিন বছরের একটা সন্তানকে ছেড়ে যে আমার ঘর ছেড়ে চলে যেতে পারে সে কখনো আমার অর্ধাঙ্গিনী হতে পারে না।
আর এখন তো তোমার সব আছে হয়ত! সংসার সন্তান!

মা তখন বললেন আমি জানি আমি যাই বলব এসবের এখন কোন মানে নেই। কিন্তু বিশ্বাস করো আমিও পারিনি। কিছু অন্যায়ের কারণে হয়ত সেই স্বপ্নটাও আমার পূরণ হয়নি। যখনই সব হারিয়ে ফিরতে চেয়েছি তখনি বান্ধবীরা বললো, 'আবার ফিরে গেলে আগে যে সম্মানটুকু পেতাম সেটুকুও এখন থাকবে না বরং কত রকমের ট্যাগ লাগবে তোর সাথে যা তুই করিসওনি। আর তোর কথাগুলো বুঝবে না বুঝতে চাইবে না। ওরা অন্য মাইন্ডের মানুষ! বরং নিজের জীবন নিজের মতো গড়ে নে।'

আমার দুর্বল মস্তিষ্কে এই কথাগুলো খুব এ্যাটাক করল। হা, আমি তো নিজের কিছু চাই নিজের পরিচয় চাই। যখন একবার পা বাড়িয়ে ফেলেছি ঘরের বাইরে সেই পুরনো পথে আর না ফেরাই উত্তম তবে নিজের মেয়ের কথা খুব মনে পড়ত।

অনেকবার টেলিফোনে কল দিয়েছি তোমাকে পাইনি। তুমি ওখানে নেই।
এরপর নিজের মত চলা শুরু করলাম। দুজন বান্ধবী মিলে একটা নাচের স্কুল খুললাম। অনেক শ্রমের বিনিময়ে আজকের এই পরিচয় আমার। কিন্তু মাঝপথে বান্ধবী আর ওর স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়!
আর ওদের সৃষ্টি নামক সন্তানকে নিজের আরেক অস্তিত্ব বানিয়ে ফেললাম। ওর মাঝেই নিজের সন্তানকে খুঁজতে লাগলাম! আর কেটে গেল কতটা বছর!

মায়ের সব কথা শুনে আমি বোবা হয়ে গেছি। আজ নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে ফিরছি আমি। এত কিছুর মাঝে আমি কোথায়? আমার মায়ের মাঝে আমার স্থানটা কোথায়।
খুব রাগ হচ্ছিল! খুব খুব!

বাবা তখন বললেন, জীবন থেকে বসন্তগুলো যখন চলে যেতে শুরু করে তখন বসন্তের আর কোনো রঙ মনে দাগ কাটে না বরং শেষ বিকেলের গৌধূলী বিকেলটাই ভালো লাগে। শেষ সময়ের শেষ নিশ্বাস!
আর কিছু ফিরে পেতেও ইচ্ছে করে না।

আমার গর্ভধারিনী মা হাতজোর করে মাটিতে বসে পড়লেন। এই শেষ ভুলটুকু শেষবারের মতো মাফ করে দিতে! বাকিটা সময় একসাথে শেষ বিকেলের পথে রওনা হতে চান।
আমার যে ধরে রাখার কিংবা আটকে রাখার শক্তি বা ইচ্ছা কোনো সময়ই ছিল না সেটা তো জানো!

ধরে রাখতে তো হবে না! আমি জড়িয়ে থাকব আজীবন।
বাবা আমার দিকে তাকালেন।
আমি চুপচাপ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছি।

মায়ের নামে আমার যে অনেক অভিযোগ জমা হয়ে আছে! এক সন্তানের অভিযোগ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us