অ্যান্টি-ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট : কানাডার আন্দোলন যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী?
অ্যান্টি-ভ্যাকসিন ম্যান্ডেট : কানাডার আন্দোলন যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী? - ছবি : সংগ্রহ
করোনাভাইরাস প্রতিষেধক বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে জানুয়ারি মাসের শেষ থেকে উত্তাল কানাডা। প্রভাব পড়েছে দেশের রাজধানী ওটাওয়াতেও। হাজার হাজার ট্রাকচালক এবং অন্যদের বিক্ষোভ এখন কানাডা-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তেও ছড়িয়ে পড়ছে এবং যার কারণে বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। উইন্ডসরে বিক্ষোভকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অ্যাম্বাসেডর ব্রিজ সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসায়। উইন্ডসরের মেয়র জানিয়েছেন, পুলিশ প্রয়োজনে বিক্ষোভকারীদের জোর করে ওই জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিভাবে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল?
করোনা অতিমারীরুখতে জাস্টিন ট্রুডো সরকার কানাডায় প্রতিষেধক বাধ্যতামূলক করেছে। নয়া নিয়মে আমেরিকা-কানাডা সীমান্ত পারাপারের সময় ট্রাক চালকদের টিকাকরণের শংসাপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর পরেই দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। সেই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বহু সাধারণ মানুষও। ট্রাক চালকদের ফ্রিডম কনভয় জানুয়ারির শেষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানী ওটাওয়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। যদিও, বেশিরভাগ ট্রাকার এই কনভয়কে সমর্থন করেন না৷ ট্রাক মালিকদের সংগঠন কানাডিয়ান ট্রাকিং অ্যালায়েন্স বলেছে যে তারা রাস্তায় বিক্ষোভের বিরোধিতা করে এবং কানাডিয়ান ট্রাকচালকদের বেশিরভাগকেই টিকা দেওয়া হয়েছে।
কোথায় কোথায় প্রভাব পড়েছে : দুটি সীমান্ত অবরোধ হয়ে যাওয়াতে কানাডা-মার্কিন বাণিজ্যে প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিক্ষোভকারী সংগঠকদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেছেন এবং কনভয় শহরে প্রবেশ করার পরই তিনি ওটাওয়ার বাইরে একটি অজ্ঞাত স্থানে চলে গিয়েছিলেন। যদিও পরে তিনি ওটাওয়াতে ফিরে আসেন এবং বলেছেন যে অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বোত্তম উপায় হল স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশ মেনে চলা।
এই বিক্ষোভবিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ইরিন ও'টুলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অবদান রাখতে পারে। যিনি প্রাথমিকভাবে বিক্ষোভ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। যার কারণে তাঁর দলের জনপ্রতিনিধিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আলবার্টা, সাসকাচোয়ান এবং কুইবেক-সহ কয়েকটি প্রদেশে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে কোভিড বিধিনিষেধ শিথিল করেছে।
কর্তৃপক্ষ কী করছে?
কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ ওটাওয়া দখলের চেষ্টা রুখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা আশা করছে অপরাধমূলক অভিযোগ, ট্রাফিক টিকিট এবং জ্বালানি না পাওয়ার কারণে এই বিক্ষোভ থেমে যাবে। দেশের একটি আদালত এই সপ্তাহে একটি অন্তর্বর্তী আদেশে জানিয়েছে, ওটাওয়া শহরের কেন্দ্রস্থলে হর্ন বাজানো যাবে না। যদিও, বিক্ষোভকারীদের দাবি যে তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে। তবে, ওটাওয়ার বাসিন্দারা বলেছেন যে তাদের হয়রানি করা হয়েছে।
গোলমাল করা এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা না মানার জন্য ওটাওয়াতে পুলিশ প্রায় ২ ডজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে। কার্লটন ইউনিভার্সিটি ক্রিমিনোলজিস্ট জেফরি মোনাঘান বলেছেন, জানুয়ারির শেষে যখন প্রথমবার কনভয় শহরে প্রবেশ করে তখনই ওটাওয়া পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। যদিও সেই সুযোগ তারা কাজে লাগাতে পারেনি। তিনি বলেন, 'শুরু থেকেই ব্যাপক ভুল ছিল। অনুমতিই দেওয়া উচিত হয়নি। আমরা জানতাম যে সেখানে ডানপন্থী লোকেরা রয়েছে, তারা উত্তেজনা ছড়াবে। কিন্তু মোকাবিলা করার অনিচ্ছার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারণে পুরো শহর ওদের দখলে চলে যায়।'
পুলিশের হাতে অন্য বিকল্প কী কী আছে?
পুলিশ বাহিনী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে দমন করতে অনেকাংশেই অক্ষম বা অনিচ্ছুক। বিক্ষোভকারীদের অনেকের সঙ্গে শিশুরাও রয়েছে। পুলিশ তাই বলেছে যে তারা খুব আক্রমণাত্মক হলে হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হবে। বাণিজ্যিক যানবাহনের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে এর জন্য তাদের প্রথমে অভিযোগ দেখাতে হবে। আইন লঙ্ঘন করলে বাণিজ্যিক গাড়ির রেজিস্ট্রেশন স্থগিত বা বাতিল হয়ে যেতে পারে। সরকার শনিবার বলেছে যে অবরোধ অবশ্যই তুলে নিতে হবে। তারা সতর্ক করে দিয়েছে যে তথাকথিত 'ফ্রিডম কনভয়কে' শেষ করার জন্য প্রতিটি বিকল্প প্রয়োগ করা হবে। শনিবার পুলিশের আসল লক্ষ্য ছিল কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য একটি প্রধান ধমনী অ্যাম্বাসাডর ব্রিজে অবরোধ মুক্ত করার। সেই লক্ষ্য কিছুটা সফলও হয় তারা। সেতুটি কানাডার অন্টারিও প্রদেশের উইন্ডসর ও যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়টের মধ্যে। রাস্তা অবরোধ করে রাখা যানবাহনগুলি অন্টারিও প্রাদেশিক পুলিশ এবং রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ সরিয়ে দেয়। ইতিমধ্যেই ওটাওয়া ও অন্টারিও প্রদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
এদিকে, কানাডার তথাকথিত 'ফ্রিডম কনভয়' আন্দোলনের আঁচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়িয়ে ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড ও নেদারল্য়ান্ডসে পৌঁছে গিয়েছে। কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী শনিবার সকালে প্যারিসের আশপাশে অবস্থান নিয়েছে। সারা দেশ থেকে গাড়ির কনভয় রাজধানী প্যারিসে ঢোকার চেষ্টা করবে। যদিও, প্যারিস পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানী অবরোধ ঠেকাতে কমপক্ষে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। শনিবার প্যারিস পুলিশ টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটিয়ে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেওয়া শুরু করে এবং শত শত লোককে জরিমানা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি রাল্ড ডারমানিন বলেন, তিন শতাধিক বিক্ষোভকারীকে জরিমানা করা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছেন ৫৪ জন। সব বাধার পরও গতকাল কিছু গাড়ি আর্ক দ্য ত্রিয়োমফ শহরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। পার্শ্ববর্তী চ্যাম্পস এলিসি এলাকায় বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজধানীতে এই ধরনের গাড়ির কনভয়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়াম। শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে অবরোধ দ্রুত শেষ করতে বলেন। বাইডেনকে দ্রুত সংকট সমাধানের আশ্বাস দেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী।
বিক্ষোভ সম্পর্কে কানাডিয়ানরা কী ভাবছেন?
একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৬২ শতাংশ কানাডিয়ান ফ্রিডম কনভয়ের বিরোধিতা করেছে। কানাডিয়ানরা মূলত সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনুসরণ করেছে এবং যোগ্য জনসংখ্যার প্রায় ৭৯ শতাংশ টিকার দু'টি ডোজ পেয়ে গিয়েছে। কিছু কানাডিয়ান এই বিক্ষোভকে সমর্থন করে। তাদের দাবি, সরকারের অতিরিক্ত বিধিনিষেধে তারা ক্লান্ত, শঙ্কিত। তবে কিছু অংশ এটাও জানিয়েছে যে পুলিশ বেআইনি অবরোধ শেষ করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম।
সূত্র : নিউজ ১৮