ইউক্রেনে কি যুদ্ধ হবেই!

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন | Feb 13, 2022 03:59 pm
ইউক্রেনে কি যুদ্ধ হবেই!

ইউক্রেনে কি যুদ্ধ হবেই! - ছবি : সংগ্রহ

 

পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলছে টানটান উত্তেজনা। যেকোনো মুহূর্তে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে। বেলারুশে রুশ সেনাদের সামরিক মহড়া শুরু হয়েছে। পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার পর আয়তনের দিক দিয়ে ইউক্রেন সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র। অপর দিকে ইউক্রেনে রুশ হামলার আশঙ্কায় ন্যাটো সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়ার দখল করে নেয়। গোয়েন্দারা মনে করেন, মুখে অস্বীকার করলেও রাশিয়া ইউক্রেন দখল করতে চায়। রাজনীতি ও সমর নীতির কূটচালে ভ্লাদিমির পুতিন বেশ চৌকস ও অভিজ্ঞ।

ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে আট হাজার সৈন্য প্রস্তুত রেখেছে এবং ৯০ টন ওজনের প্রাণঘাতী অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অতিরিক্ত তিন হাজার সৈন্য পূর্ব ইউরোপে প্ররণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। সৈন্যদের প্রথম বহর পোল্যান্ডে পৌঁছে গেছে। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র রাজধানী কিয়েভ থেকে তাদের দূতাবাসের স্টাফ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছে।

রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন আসলে কী চান সেটা স্পষ্ট নয়। ইউক্রেন সঙ্কট সৃষ্টি করে হয়তো প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে চান যাতে তিনি কাজাখস্তানের নুরসুলতান আবিশুলি নাজারবায়েভ-এর মতো আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারেন। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে ফেলবেন। বিগত দুই দশক ধরে তিনি ক্ষমতায় রয়েছেন। অথবা ইউক্রেনকে যেন ন্যাটোর সদস্যভুক্ত না করা হয় তার জন্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে গ্যারান্টি আদায় করতে চান।

ব্রিটেন অভিযোগ করেছে যে, মুরায়েভ নামক এক সংবাদপত্রের মালিককে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্ষমতায় বসাতে চায়। সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য মুরায়েভ মস্কোপন্থী হিসেবে পরিচিত। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় এখনো সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। তবে আশঙ্কা রয়েছে, ইউরোপকে হয়তো আরেকটি ‘যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন’ দেখতে হতে পারে।

মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছেন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় অভিযান চালাতে রাশিয়া তার ৭০ শতাংশ সামরিক সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছে। যুদ্ধ যদি শুরু হয়ে যায় ৫০ হাজার বেসামরিক মানুষ মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হতে রাশিয়া কেনো বাদ সাধছে তার নেপথ্যে রয়েছে বিরাট কারণ। ইউক্রেন যদি ন্যাটো জোটভুক্ত হয় তাহলে সঙ্গত কারণে ন্যাটোবাহিনীর আনাগোনা বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার চলাফেরার গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। পূর্ব ইউরোপের আর কোনো দেশকে ন্যাটোভুক্ত করতে বাধা দেয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, রাশিয়া মনে করে, পশ্চিমারা ন্যাটো দিয়ে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলতে চায়।

রাশিয়া থেকে ইউরোপের অর্ধেক জ্বালানি আসে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে স্থাপিত পাইপলাইন দিয়ে। যুদ্ধ যদি বাধে রাশিয়া জ্বালানির পাইপলাইন বন্ধ করে দিতে পারে। এতে ইউরোপের ঘরে ঘরে জ্বালানির জন্য হাহাকার উঠবে। আবার যুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তি রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ইউক্রেন সঙ্কট নিরসনে কূটনৈতিক প্রয়াসও বন্ধ হচ্ছে মনে হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সম্প্রতি ইউক্রেন সফর করে সে দেশের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে উদ্ভূত সঙ্কট নিয়ে আলোচনায় মিলিত হন। তিনি ক্রিমিয়ার তাতার নেতাদের সাথেও বৈঠক করেন। এরদোয়ানের সাথে পুতিনের সম্পর্ক ভালো। সঙ্কট নিরসনে তিনি কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারেন তা বলার সময় এখনো আসেনি। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ইউক্রেন সঙ্কট সমাধানে আলোচনায় বসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই বৈঠকের পর ম্যাক্রোঁ দাবি করেছেন, ইউক্রেনে সঙ্কট যাতে আর না বাড়ে, সেই ব্যাপারে পুতিনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তবে পুতিন বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন করে সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হবে না- এমন কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি দেননি। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ অবশ্য ভিন্ন কথা বলেছেন, ইউক্রেন সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে নেয়া বা সেখানে সেনা উপস্থিতি কমানো হবে, এমন তথ্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা কখন চলে যাবেন, সেই বিষয়েও কোনো প্রতিশ্রুতি পুতিন দেননি। বেলারুশে মহড়ার পরে কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী পরিস্থিতি।

ওয়াশিংটন এখন হুমকি দিচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি তার বাহিনীকে ইউক্রেনে প্রবেশের নির্দেশ দেন তাহলে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। রাশিয়া একটি লাল রেখা এঁকেছে এবং বলেছে যে, ইউক্রেন যদি মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হয় তবে তারা ‘সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ’ করবে। ১৯৯০ সালে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকার তৎকালীন রাশিয়ান নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, মস্কো যদি জার্মানির পুনর্মিলনের অনুমতি দেয় তবে ন্যাটো এক ইঞ্চি পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে না। তাদের দ্বৈত প্রকৃতির জন্য সত্য, আমেরিকানরা হাস্যকর অজুহাত ব্যবহার করে এই অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিখিতভাবে এটি দেয়নি!

অতিরিক্ত হুমকির মধ্যে রয়েছে রাশিয়াকে ঝডওঋঞ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, যাতে অর্থ-বার্তা প্রেরণব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। মস্কো সতর্ক করেছে যে, এ ধরনের পদক্ষেপ হবে যুদ্ধ ঘোষণা এবং রাশিয়া পূর্ণ শক্তি নিয়ে কাজ করবে। রাশিয়া এবং চীন ইতোমধ্যেই ঝডওঋঞ বাইপাস বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছে. এগুলো বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যবহৃত হয়; তবে রাশিয়ার সিস্টেমটি অন্য দেশগুলোও গ্রহণ করেছে। সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফাইন্যান্সিয়াল মেসেজ (ঝচঋঝ) নামে পরিচিত, এটি ২০১৭ সালে চালু হয়। এক বছরের মধ্যে, ৪০০টিরও বেশি রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান, প্রধানত ব্যাংকগুলো এটি ব্যবহার করছে এবং ২০২০ সালের শেষ নাগাদ, ২৩টি বিদেশী ব্যাংক আর্মেনিয়া থেকে ঝচঋঝ-এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে, রাষ্ট্রের মধ্যে বেলারুশ, জার্মানি, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং সুইজারল্যান্ড (ঞযব ঈৎবংপবহঃ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ, ঈধহধফধ, ঔঁসধফধ ধষ-অশযরৎধ ২৯, ১৪৪৩ ঐ.)।

চীন ও রাশিয়াও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও হুমকির মুখে পড়েছে। আমেরিকা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে হুমকি দিয়ে আসছে। চীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দেশ। রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে তার সীমান্তে সরাসরি সামরিক হুমকির সম্মুখীন। ফলস্বরূপ, চীন ও রাশিয়া উভয়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে ইরানকে খুঁজে পেয়েছে।
রাশিয়া, চীন ও ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোবৃত্তিকে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে একটা জোট তৈরি করার চেষ্টায় রত আছে। বিগত ৪০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়েছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করার সব শক্তি প্রয়োগ করে। ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞা সাধারণ ইরানিদের জন্য অপরিসীম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে এবং এর ফলে অনেক প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু হয়েছে। অবৈধ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইরানের তেল বিক্রি থেকে প্রাপ্ত বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আটকে দিয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ আমদানিতে বাধা দিয়েছে যাকে অর্থনৈতিক সন্ত্রাস হিসাবে বর্ণনা করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। চীন এবং রাশিয়াও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির।

মার্কিন আগ্রাসনের মোকাবেলায় তেহরান, বেইজিং এবং মস্কোর মধ্যে মতের মিল রয়েছে। এটি একটি ত্রিপক্ষীয় জোটের আকার নিতে শুরু করেছে যা কেবল মোকাবেলা করবে না কিন্তু ইউরেশীয় অঞ্চল থেকে আমেরিকা ও এর মিত্রদের বিতাড়িত করবে। শক্তির বৈশ্বিক ভারসাম্য স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই অঞ্চলের দিকে সরে গেছে। এই তিনটি দেশই নতুন উদীয়মান শক্তিব্লকের কেন্দ্রবিন্দু।

আন্তর্জাতিক বিশ্লষকরা মনে করেন, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া থেকে যত তাড়াতাড়ি এই আগ্রাসী শক্তি নির্মূল করা হবে, ততই এই অঞ্চলের সব মানুষের জন্য মঙ্গল। ইরান-চীন-রাশিয়া সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্ব একটি স্বাগত উন্নয়ন যা তাদের জনগণকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া
যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দুর্বল দেশকে দখল করে নিয়েছে, আধিপত্য বিস্তার করে সম্পদ লুটে নিয়েছে। এতে সম্পদ ও মানবহানি হয়েছে প্রচুর। রাশিয়া আফগানিস্তানে তাণ্ডব চালিয়েছে ১০ বছর।
১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে রুশ বা সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ আরম্ভ হয়, আর ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধে প্রায় শিশু ও নারীসহ ২০ লাখ আফগান প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো শক্তি নিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে দেশটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে সামরিক এবং নিরাপত্তা তৎপরতার জন্য বিশেষ করে আমেরিকাকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে। এ ছাড়া আমেরিকা ভিয়েতনামে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও রক্ষা পায়নি। সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এ যুদ্ধে ৩.৮ মিলিয়ন ভিয়েতনামী সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। এগুলো তাদের আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এখন ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে নতুন খেলা শুরু করেছে।

পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় এবং এর পরিণতি কী হয় তা দেখার জন্য হয়তো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক

drkhalid09@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us