কোক স্টুডিও ও গানের বাণিজ্য
কোক স্টুডিও - ছবি : সংগ্রহ
গত ১৯৪৭ সাল থেকে ভাগ হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের গানের ভিত্তি এক হওয়া সত্ত্বেও আমরা কে কেমন কতদূর এসেছি, অর্জন করেছি তা মাপার এক সহজ উপায় এসে গেছে। সেটা হলো কোক স্টুডিও। এখানে স্টুডিও বলতে মূলত গানের রেকর্ডিং স্টুডিও। অর্থাৎ রসুইখানা যেখানে ফাইনাল প্রডাকশনটা তৈরি হয়েছে। আর কোক বলতে বহুজাতিক পানীয় প্রস্তুত কোম্পানি ‘কোক’ এর কথাই বলা হচ্ছে, অবশ্যই। তবে এখানে এর ভূমিকা কেবল অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করা সূত্রে যাতে জোগানো তাদের অর্থের বিনিময়ে এই গানের তৎপরতা ও প্রচারের সাথে জুড়ে থাকার কারণে এই কোক কোম্পানিও প্রচার ও প্রসার পায়। এথেকেই ব্রান্ড নাম ও শব্দটা হয়ে দাঁড়ায় কোক স্টুডিও। এর শুরু পাকিস্তান থেকে। সাধারণত এমন গানের আয়োজন মানে, সংস্কৃতিতে গান এই শিল্পকলা সৃষ্টির আয়োজনে এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ও অর্গানাইজার বা সংগঠক লাগে। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, কোক স্টুডিওতে এমন সংগঠক হচ্ছেন যারা তাদের টেকনিক্যাল গুণ হলো তারা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড- অন্তত বুঝেন ভালো; আর সাথে সেন্স অব মিউজিক। স্বভাবতই তা নিশ্চয় পশ্চিমা-কালচারাল গানের বোধ বুঝাচ্ছি না। সেটা থাকলে তা বাড়তি ভালো, তুলনা করে তারা নিজের বোধগম্যতা বাড়াতে পারবে। কিন্তু মূল জিনিস হলো, নিজের এথনিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও ইতিহাস সম্পর্কে একটা ভালো রকমের বোধ থাকতে হবে।
পাকিস্তানে গত ২০০৮ সালে পাকিস্তান-কোক স্টুডিও শুরু হয়েছিল এমন যে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের হাত ধরে তার নাম রাহিলো হায়াত। কাদের কাদেরকে বেছে তুলে এনে রাহিলো তার গানের ধরন ও বৈচিত্র্য বা কম্বিনেশনের ডালি সাজাচ্ছে। সেদিকটা খেয়াল করলে তার ওজন বুঝা যাবে। এর তিন বছর পরে ভারতে একই আইডিয়াতে ইন্ডিয়ান কোক স্টুডিও শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে; দক্ষিণী কম্পোজার বা সুরকার লেসলি লুইসের হাত ধরে। আরেক দক্ষিণী গায়ক হরিহরণকে সাথে নিয়ে ১৯৯৬ সালে তার বহুল আদর পাওয়া অ্যালবামের নাম ‘কলোনিয়াল কাজিন’। এনামেই লুইসকে বেশি মানুষ চেনে।
দুই কোক স্টুডিও-এর তুলনা আমাদেরকে আমাদের একই প্রাচীন উৎস এবং একই সাথে আমাদের ভিন্নতা সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারে, পরিচয় তুলে ধরতে পারে। আগেই বলেছি অবিভক্ত ইন্ডিয়ান ধারার সংস্কৃতিতে এক বড় কমন চিহ্ন হলো ক্লাসিক মিউজিক যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আমাদের কালচারাল উৎস একখানে। ক্লাসিক গান বা রাগ-প্রধান গান শুনে সচেতনরা ছাড়া অন্যদের বুঝা মুশকিল যে, সেটা ভারত না পাকিস্তানের উপস্থাপন।
কিন্তু এরপর যদি ভারত-পাকিস্তান কোক স্টুডিওর মধ্যে ফারাক তুলনা করে বুঝতে চাই তা হলো, ভারতের কোক স্টুডিও দেখে বুঝা যাবে ভারতের গানের জগত বাণিজ্যিক ভিত্তি খুঁজে নিতে পেরেছে। বাণিজ্যিক ভিত্তি মানে মডার্ন ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি ভারতে যার সবচেয়ে বড় প্রকাশ হলো ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমা। অর্থাৎ ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এক সিনেমা জগতকেন্দ্রিক। ফলে ভারতীয় কোক স্টুডিওতে এর গান, অর্জন ও পারফরমেন্সে এটা মডার্ন এবং সিনেমাকেন্দ্রিকতার ছাপে ভরপুর।
তুলনায় পাকিস্তান কোক স্টুডিওর বৈশিষ্ট্য হলো, সে দেখিয়েছে সে পাকিস্তান এলিট ঘরের কিন্তু গভীর মিউজিক সেন্সের তরুণ যারা পপ বা রক ধরনের মিউজিক থেকে ক্লাসিক খুঁজতে গেছে; আর রাহিলো এদের সাথে শেষে একেবারে ক্লাসিক কাওয়ালি বা বুল্লেহ শাহকে পর্যন্ত একাকার করে করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। একই ক্লাসিক কালচারাল অরিজিনের ভারত ও পাকিস্তান মধ্যে গানের শক্তিমত্তার দিক থেকে পাকিস্তান সম্ভবত এগিয়ে কিন্তু আবার এই শিল্পকলাকে পেশা হিসাবে নেয়ার ক্ষেত্রে, বাণিজ্যিক ভিত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত অতুলনীয় উঁচুতে উঠে গিয়েছে। যে ভারতে শিল্পকলার মুখ্য বা ফোকাস প্রতিষ্ঠান ঠিক গান অথবা নাটক থিয়েটার নয়, সিনেমা।
স্বভাবতই এ কারণে দেশগুলো যার যার বাড়তি সুবিধার বা অর্জনের দিক অথবা অসুবিধা বা অবিকশিত নেতিদিকও অবশ্যই আছে ও তৈরি হয়েছে।