রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি অনিবার্য
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি অনিবার্য - ছবি : সংগৃহীত
ইউক্রেন সীমান্তের কাছে রাশিয়ার সেনা মোতায়েন এবং মস্কো আদৌ আক্রমণ করবে কি না তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেই পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাতের জন্য শান্তি চুক্তি আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০১৫ সালে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আলোচনা করতে রাশিয়া, ইউক্রেন, ফ্রান্স ও জার্মানির শীর্ষ কর্তারা বৃহস্পতিবার বার্লিনে বৈঠক করেছেন। এখানে প্রতিবেদনে আমরা এই চু্ক্তির মূল পয়েন্ট এবং এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বাধাগুলোর বিষয়ে জানব।
পূর্বে দ্বন্দ্ব
৩০ বছর আগে স্বাধীনতা পাওয়া ইউক্রেন জনগণের বিশাল একটা অংশ রুশ ভাষাভাষী, জাতিগতভাবেও তারা রুশ। রাশিয়ার সাথে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক যোগাযোগ। তাই ইউক্রেনের একটি অংশ চায় দেশটি রাশিয়ার ছায়াতে থাকুক। আরেকটি অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সঙ্গী হয়ে এককভাবে এগিয়ে যাওয়ার দাবিতে অনড় থাকে। এমন পরিস্থিতিতেই ২০১৪ সালের শুরুতে পূর্ব ইউক্রেনে সংঘাতের সূচনা। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং ডনবাস নামে পরিচিত এলাকায় বেশিরভাগ রাশিয়ান-ভাষী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিদ্রোহকে সমর্থন করে। ইউক্রেন সরকার এবং দেশের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যায়। ইউক্রেন এবং ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে সেনা ও অস্ত্র দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয়ার অভিযোগ করেছে। মস্কো এই অভিযোগ খারিজ করে জানিয়েছে যে কোনো রাশিয়ান, যারা পূর্বে যুদ্ধ করেছে তারা সবাই স্বেচ্ছাসেবক।
যুদ্ধ চলাকালীন ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের একটি বিমানে হামলা হয়। বিমানে থাকা ২৯৮ জনেরই মৃত্যু হয়। এরপরই মস্কোর সমালোচনায় সরব হয় আন্তর্জাতিক মহল। দাবি করা হয় যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বিমানটিকে লক্ষ্য করে মিসাইল ছোড়া হয়, আর তাতেই বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। আরো অভিযোগ যে মিসাইলটি রাশিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে ইউক্রেনে সরবরাহ করা হয়েছিল। তবে মস্কো স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে তারা কোনো ভাবেই এই কাজে জড়িত নয়। ওই ঘটনার পর ফ্রান্স এবং জার্মানির নেতারা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরুর চেষ্টা শুরু করেন। ২০১৪ সালের জুন মাসে ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে তারা মিলিত হন, যা নরম্যান্ডি ফরম্যাট হিসাবে পরিচিত।
লড়াই এবং আলোচনা
২০১৪ সালের অগাস্টে ইউক্রেনের সেনাদের পরাজয়ের পর কিয়েভের প্রতিনিধিরা এবং বিদ্রোহীরা সেপ্টেম্বর মাসে মিনস্কে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে। মিনস্কে এই শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি এ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ বা ওএসসিই। সাবেক ইক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট, বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী নেতারা এবং রুশ প্রতিনিধিরা এই আলোচনায় যোগ দেন। মিনস্ক ওয়ান নামক নথিতে যুদ্ধবিরতি, বিদেশী যোদ্ধাদের প্রত্যাহার, বন্দী ও আটকদের বিনিময়, বিদ্রোহীদের ক্ষমা এবং বিদ্রোহী অঞ্চলগুলোর প্রতিনিধি সরকারে থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। যদিও এই চুক্তি দ্রুতই ভেঙে পড়ে এবং বড় আকারের যুদ্ধ আবার শুরু হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন সেনা আরেকটি বড় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়।
ফ্রান্স এবং জার্মানি আরেকটি শান্তি চুক্তি স্থাপনের জন্য এগিয়ে আসে। ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন, রাশিয়া এবং বিদ্রোহীদের প্রতিনিধিরা একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। যা একটি নতুন যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা করে করা হয়েছিল। চুক্তির মধ্যে সীমান্ত থেকে ভারী অস্ত্রের প্রত্যাহারের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। সেনা এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য চুক্তির সমর্থনে রাশিয়া, ইউক্রেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির নেতারা স্বাক্ষর করেছিলেন।
মিনস্ক চুক্তির বিধান
মিনস্ক ২ নামে পরিচিত এই চুক্তির মধ্যে অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি এ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ-এর পর্যবেক্ষণে যুদ্ধবিরতি, লাইন অফ কন্টাক্ট থেকে ভারী অস্ত্র এবং বিদেশী যোদ্ধাদের প্রত্যাহার, বন্দী বিনিময় অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দিতে ইউক্রেনকে বাধ্য করেছিল এই চুক্তি। বলা ছিল যে বিচ্ছিন্নবাদী অঞ্চলগুলি নিজস্ব পুলিশ বাহিনী গঠন করতে এবং স্থানীয় প্রসিকিউটর এবং বিচারক নিয়োগ করতে পারবে। এতে স্থানীয় নির্বাচনের জন্য বিদ্রোহী নেতাদের সাথে বিস্তারিত আলোচনার কথাও বলা হয়। এতে বলা হয়েছিল যে ইউক্রেন কেবলমাত্র বিদ্রোহী অঞ্চলে থাকা রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্তের উপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে পারবে, যখন বিদ্রোহীরা স্বায়ত্বশাসনের অধিকার পাবে। স্থানীয় নির্বাচনের পর মস্কোপন্থী বিদ্রোহীদের ক্ষমতায় রাখার কথাও বলা হয় চুক্তিতে।
চুক্তির নথিতে রাশিয়ার পক্ষে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। তারা জানিয়েছিল যে মস্কো লড়াই বা যুদ্ধের পক্ষ নয় এবং এটিকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের অংশ হিসেবে তারা তুলে ধরে। ইউক্রেনের অনেকেই এই চুক্তিকে জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং দেশের অখণ্ডতার জন্য আঘাত হিসেবে দেখেছিল ওই সময়ে। জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন কার্যকরভাবে চুক্তির বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
মস্কো এবং কিয়েভ বাণিজ্য সমস্যা
যদিও মিনস্ক চুক্তিটি বৃহৎ মাপের যুদ্ধের অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছিল। তবুও উভয় পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করে ঘন ঘন সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন মঞ্চে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনও কিছু লাভ হয়নি। রাশিয়ার সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইউক্রেন। মস্কো যদিও ওই সব এলাকায় তাদের সেনাদের উপস্থিতি কঠোরভাবে অস্বীকার করেছে। তারা বরং পাল্টা ইউক্রেনে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক মোতায়েনের দিকে ইঙ্গিত করেছে। পূর্ব ইউক্রেনে কোনো সামরিক সাহায্যে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও রাশিয়া বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং এই অঞ্চলের সাত লাখেরও বেশি বাসিন্দাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। রাশিয়া, ইউক্রেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির নেতারা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে শেষবার মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে মিনস্ক চুক্তি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা। যদিও, এরপরও চোখে পড়ার মতো কোনো কিছুই অগ্রগতি হয়নি।
সম্প্রতি রাশিয়া তাদের ইউক্রেন-সংলগ্ন সীমান্তে এক লাখেরও সেনা সমাবেশ করার পর যেকোনো সময় তারা ইউক্রেনে অভিযান চালাতে পারে বলে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তবে রাশিয়া বার বার এরকম কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাটো-র সম্প্রসারণে ক্ষুব্ধ রাশিয়া এবং তারা ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ লাভের বিরোধিতা করেছে। রাশিয়া আমেরিকার কাছ থেকে নিশ্চিত বার্তা দাবি করেছে যে ইউক্রেনকে কোনোভাবেই ন্যাটো-তে সামিল করা হবে না। এছাড়াও, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি কমাতে হবে। তবে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন ন্যাটো এমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে যোগ দেয় ও ক্রিমিয়া পুনর্দখল করার চেষ্টা করে, তাহলে পুরো ইউরোপ একটা বড় আকারের সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে। যদিও রাশিয়ার দাবি মানতে অস্বীকার করেছে আমেরিকা। তারা একই সাথে রাশিয়াকে সতর্ক করে বলেছে, ইউক্রেন আক্রমণ করলে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশরা বসে থাকবে না। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর কথাও বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ইউক্রেনে অস্ত্র সহায়তা পাঠানো হচ্ছে, পাশের দেশগুলোতে পাঠানো হচ্ছে সেনা।
ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আরেকটি শীর্ষ বৈঠকের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ক্রেমলিন বলেছে যে ইউক্রেন চুক্তির বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনও উদ্দেশ্য পূরণ করবে না। ইউক্রেনের কাছে রাশিয়ান সামরিক মোতায়েন নিয়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ফ্রান্স এবং জার্মানি বৃহত্তর সঙ্কটে উত্তেজনা কমানোর সম্ভাব্য উপায় হিসাবে আলোচনা করার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। চারটি দেশের প্রতিনিধিরা ২৬ জানুয়ারি প্যারিসে মিলিত হন, কোনো অগ্রগতি না হলেও তারা বৃহস্পতিবার বার্লিনে অধিবেশন করতে সম্মত হন মিনস্ক চুক্তির একটি সাধারণ ব্যাখ্যায় একমত হওয়ার লক্ষ্যে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এই সপ্তাহে মস্কো এবং কিয়েভ সফরের সময় মিনস্ক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এটিকে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
ইউক্রেনের উপর চাপ
মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পশ্চিমা দেশগুলো চাপ দিলেও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এনিয়ে সরব হচ্ছেন। ইউক্রেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিলের সেক্রেটারি ওলেক্সি ড্যানিলভ গত সপ্তাহে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-কে বলেছেন যে চুক্তিটি রাশিয়ান বন্দুকের নলের সামনে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে মিনস্ক চুক্তির বাস্তবায়ন মানে ইউক্রেনের ধ্বংস।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা যুক্তি দিয়েছেন যে মস্কো এই চুক্তিটি ব্যবহার করে বিদ্রোহী অঞ্চলগুলোকে ইউক্রেনে পুনরায় একীভূত করতে চাইছে। যাতে ইউক্রেন পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি বেশি না ঝুঁকে পড়ে। তিনি বলেছেন, 'আসলে এটি ঘটবে না।' প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি মিনস্ক চুক্তির প্রতিটি পয়েন্ট অপছন্দ করেন। পাল্টা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়ে দিয়েছেন যে পছন্দ হোক বা না হোক, ইউক্রেনকে এটাই মানতে হবে।
এদিকে, ইউক্রেনে রুশ অভিযানের আশঙ্কার মধ্যেই ১০ দিনের যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে রাশিয়া ও বেলারুশ। বেলারুশ ও রাশিয়ার এই যৌথ সামরিক মহড়াকে ফ্রান্স 'হিংস্র ইঙ্গিত' বলে আখ্যায়িত করেছে। এই মহড়া উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারে বলে জানিয়েছে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনে থাকা দেশের নাগরিকদের অবিলম্বে দেশ ছাড়ার আর্জি জানিয়েছেন। বাইডেন আরো বলেছেন যে পরিস্থিতি দ্রুত বদল হচ্ছে। তাই মার্কিন নাগরিকদের এখনই ইউক্রেন ছেড়ে চলে আসা দরকার। বাইডেন বলেন, 'আমরা বিশ্বের অন্যতম বড় সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হচ্ছি। এটি একটি বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি এবং যেটা আরো খারাপ হতে পারে।'
সূত্র : নিউজ ১৮