টপাটপ প্যারাসিটামল? হতে পারে যেসব বিপদ
টপাটপ প্যারাসিটামল? হতে পারে যেসব বিপদ - ছবি : সংগ্রহ
সামান্য গা গরম হলে, কিংবা মাথা ধরায় সঙ্গে সঙ্গে প্যারাসিটামল খাওয়া কতটা নিরাপদ?
একটা আপ্তবাক্য প্রথমেই বলে রাখি, কোনো ওষুধই সম্পূর্ণ ‘সেফ’ বা ‘নিরাপদ’ নয়। প্যারাসিট্যামলও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন কোনো ওষুধ নেই যার কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া নেই। কম আর বেশি, তফাত এটুকুই। ল্যানসেট প্রত্রিকায় ২০১৪-এর একটা লেখার কথা এই প্রসঙ্গে খুব মনে পড়ছে। আমাদের শরীরকে যদি পানি বা খাবারও প্রয়োজন ছাড়া দিই, তাহলে তারও একটা ক্ষতিকর দিক আছে। মনে রাখবেন, কম ক্ষতিকর মানেও কিন্তু সে ক্ষতি করে। তবে কম। আর এই কম ক্ষতির নিদান না মেনে তাকে মুড়িমুড়কির মতো খেয়ে গেলে তা আর কম ক্ষতির বা কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ড্রাগ হিসেবে ব্যবহার করে না। শরীরের সঙ্গে তখন তার মানিয়ে চলায় নানা সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে একটা কথা আছে- একটা ওষুধ যা রোগীর সইবে, সেটাই তাকে দিতে হবে। ঠিক সময়ে, ঠিক ডোজ এবং ঠিক সময়ের গ্যাপেই দিতে হবে। এই কথাগুলো মনে না রেখে জ্বর বা সর্দিকাশি বা গা-হাত-পা ব্যথায় মুঠো মুঠো প্যারাসিটামল খাওয়া পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক ও ক্ষতিকর।
প্যারাসিটামল আসলে কী?
প্যারাসিটামল নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি গ্রুপের ড্রাগ। এই ওষুধ ব্যথা, জ্বর, প্রদাহজনিত ফুলে যাওয়া ইত্যাদি কমায়। এনএসএআই গ্রুপের বিভিন্ন ড্রাগ আছে। তার মধ্যে প্যারাসিটামল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আমাদের দেশে যেমন এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় জ্বর কমানোর জন্য। বিদেশে আবার ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসেবেই এর ব্যবহার বেশি।
এই ওষুধ এত ঘন ঘন খেয়ে ফেলার প্রবণতা কেন তৈরি হল?
অনুন্নত বা আধা উন্নত দেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণের দিকটি বেশ দুর্বল। এর নানা কারণ আছে। রোগীর সচেতনতার অভাব তো বটেই, সঙ্গে প্রচারের অভাব, কিছুক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও সময়ের অভাবে বোঝাতে পারেন না। অসচেতন থাকাও একটা কারণ। আর আমাদের দেশে তো দোকানে গিয়ে প্রেশক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কেনার একটা অভ্যেস আছেই। ফলে এগুলি নিয়ন্ত্রণে না এলে যেকোনো ড্রাগের অবৈজ্ঞানিক ব্যবহার চলতে থাকবে।
প্যারাসিটামল শরীরে কাজ করে কেমন করে?
প্যারাসিটামল আর পাঁচটা ওষুধের মতো খাওয়ার পর পাকস্থলীতে যায়। পৌঁছে গুলে যায়। তারপর পাকস্থলী থেকে তা রক্তে মিশে যায়। সেখান থেকে রক্ত প্রথম যায় লিভারে। তারপর লিভার থেকে তা হার্টে পৌঁছয়। রক্ত হার্টের মাধ্যমে পাম্প হওয়ার পর পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে। আমাদের শরীরে হাইপোথ্যালামাস অংশে পোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামের একটা এন্ডোজেনাসাস সাবস্ট্যান্স শরীর নিজেই তৈরি করে। শরীর যখন অপ্রচলিত কিছু দেখে বা প্রদাহের সম্মুখীন হয়, তখন এই পোস্টাগ্ল্যান্ডিন বেড়ে যায়। প্যারাসিটামল সেই পোস্টাগ্ল্যান্ডিনের বৃদ্ধিটাকে নিয়ন্ত্রণ করে জ্বরকে কমিয়ে ফেলে।
তাহলে প্যারাসিটামল খাওয়া তো ভালো, জ্বর কমে!
না, বিষয়টা এত সহজ নয়। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। সব ওষুধেরই নির্দিষ্ট কিছু কার্যকারিতা আছে। ওষুধ সবসময়ই একটা বাইরের বস্তু। তাই বেশিমাত্রায় খেলেই বিপদ।
বেশি মাত্রায় প্যারাসিটামল থেকে কী কী ক্ষতি হতে পারে?
প্যারাসিটামল অনেক সময়ই বমিভাব বাড়ায়। আমরা অনেক রোগী পাই, যারা প্যারাসিটামল খেতেই পারেন না। কোনও কোনও ব্যক্তি আবার অ্যান্টাসিড ছাড়া প্যারাসিটামল খেতে পারেন না। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত প্যারাসিটামল সেবন থেকে পেটের উপরের অংশে ব্যথা হতে পারে। দেখা দিতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও। এছাড়া পেটের ভিতর রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। এগুলি তো বটেই, এছাড়া মেটাবলিজমের মাধ্যমে প্যারাসিটামল ভেঙে গেলে অসংখ্য বিপাকীয় উপাদান তৈরি করে রক্তের মধ্যে। তার মধ্যে কিছু জিনিস লিভারের ক্ষতি করতে পারে। কিডনির ক্ষতি করে। এমনকী, ইদানীং বহু রোগীর ডায়ালিসিস করতে হয়। কারণ তারা একটা সময় মুড়িমুড়কির মতো প্যারাসিটামল খেয়েছেন। যারা অতিরিক্ত অ্যালকোহলিক, তাদের লিভারের ফাংশন এমনিই খারাপ থাকে। তাই এর উপর মাত্রাতিরিক্ত প্যারাসিটামল দিলে লিভার আরও বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আচ্ছা, কী করে বুঝব কতটায় ‘মুড়িমুড়কির মতো’ হবে? কতটা বেশি হলে সমস্যা?
প্রতিটা ড্রাগের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডোজ আছে, শারীরিক ওজনের উপর নির্ভর করে তা ঠিক হয়। এই ডোজ বুঝে ওষুধ খেতে হয়। এটা রোগী একা বুঝবেনও না। এখানেই চিকিৎসকের কেরামতি। তিনিই ঠিক করবেন কোন রোগীকে কী ওষুধ কতটা দিতে হবে। রোগী কোনও অবস্থাতেই নিজে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাবেন না। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তির প্রতি কেজি দৈহিক ওজন পিছু প্যারাসিটামলের মাত্রা হবে সর্বোচ্চ ১৫০ মিলিগ্রাম। ছোটদের ক্ষেত্রে ১৫ মিগ্রা/কেজি। এই হিসেব ভাঙা চলবে না। এর উপরে গেলে কিন্তু দুঃখ আছে। আর হ্যাঁ, শিশুদের চট করে প্যারাসিটামল দেওয়াও উচিত নয় খুব দরকার না পড়লে। তবে সবটাই কিন্তু চিকিৎসকের সঙ্গে খেতে হবে। স্বচিকিৎসা কোনওমতেই নয়।
তাহলে জ্বর এলে প্যারাসিটামল খাব না?
প্রথমেই নয়। আগে গরম জলে গা স্পঞ্জ করে নিতে হবে। খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার। নিতে হবে বিশ্রাম। জ্বর ধীরে ধীরে নামবে। একান্ত না নামলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি যা পরামর্শ দেবেন, সেটাই করবেন।
ওষুধের ডোজ কেমন হয়?
আমরা সাধারণত একজন পূর্ণবয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে গড়ে একদিনে ৬৫০ মিলিগ্রাম করে চারবার ওষুধ খেতে বলি। এর বেশি না নেয়াই উচিত।
দিনে তাহলে ৪টা করে টানা ১ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে?
চিকিৎসক বললে তবেই একটানা খাওয়া উচিত। নইলে নয়। আর সাধারণত কোনও চিকিৎসকই একটানা প্যারাসিটামল খেতে বলেন না। দিনকয়েক লিখে এসওএস অর্থাৎ প্রয়োজন পড়লে খেতে বলেন। সেই নিয়ম না মানলে বিপদ হবেই।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ফার্মাকোলজি বিভাগ, কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
সূত্র : বর্তমান