সত্যের পথে সারাক্ষণ
সত্যের পথে সারাক্ষণ - ছবি : সংগ্রহ
শনিবার ছিল ছুটির দিন। বন্ধু মাটস দাওয়াত করেছে তার নতুন ফ্লাটে। বর্তমান সুইডিশ জাতি আমার মতো বাড়ি বিক্রি করে ফ্লাট কিনছে। ফ্লাটগুলো অত্যাধুনিকভাবে তৈরী। তারপর সাগর বা লেকের ধারে, রয়েছে লন্ড্রি, রিলাক্স, সাওনা, পার্টি রুম, গেস্ট রুম, বার্বিকিউসহ নানা ধরণের ব্যবস্থা, যার ফলে সুইডিশ জাতি খোলামেলাভাবে মেলামেশার একটি সুযোগ পেয়েছে। এতে করে মনে হচ্ছে একাকিত্ব এবং নির্জনতার কারণে যে মানসিক অস্থিরতা, এমনকি মানসিক রোগব্যধি হয় তার কিছুটা হ্রাস পাবে। তবে সামাজিকতা বজায় রাখতে এককেন্দ্রিক হলে চলবে না পরস্পর পরস্পরের সাথে মেলামেশা করতে উভয় পক্ষের থেকে ইনিসিয়েটিভ নিতে হবে। যাই হোক যেতে যেতে পথে দেখা মিলল বড় এক দল করোনা ভ্যাক্সিনের ওপর প্রতিবাদমুখোর সুইডিশদের সাথে। তারা কিছুতেই ভ্যাকসিন নিতে রাজি নয়। আমাকে আমার মতামত দিতে বলল। আমি সুযোগটি যখন পেলাম তখন ভালোমতো জানিয়ে দিলাম আমার মতামত।
আমি বললাম, প্রতিদিন করোনায় যে সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে অনাহারে। কোটি কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার সংকটের মধ্য দিয়ে বসবাস করছে। একে তো মহামারীর তারপর অর্থনৈতিক সংকট। এই দুর্যোগে মানুষ অকল্পনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন। মানুষ যখন মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তখন যুদ্ধবাজরাও পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। এছাড়া আবহাওয়া বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক ধাক্কায়ও লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। মানুষ নিরাপদে যেমন বাস করতে পারছে না তেমনি খাবার খেতে পারছে না।
এর ফলে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হচ্ছে সহস্রাধিক মানুষের। তবে এর চেয়েও আরো গুরুতর কারণে প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে অনেক বেশি মানুষের, আর তা হলো– খেয়ে এবং না খেয়ে।
না খেয়ে মৃত্যুর হার বিশ্বে কিছুটা কমলেও খেয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। দুটি মৃত্যুই দুঃখজনক।
খাদ্যাভাসের কারণে অনেকের জীবনের আয়ু কমে যাচ্ছে। মানে প্রতিদিন লাখো লাখো মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু খাবারের কারণে। এতো কিছুর মাঝে বিশ্বের একদল মানুষ কোটিপতি হয়েছে নানা ধরণের দুর্নীতির সাহায্যে। জনগণের সেবা করার নামে অনেক দেশে নির্বাচনী লড়াইয়ে শত শত কোটি টাকা আমলা-মন্ত্রীদের পকেটে ঢেলে দিচ্ছে অথচ সে সব দেশের অসংখ্য মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার অভাবে মেরুদণ্ড সোজা করতে পারছে না সেদিকে কারো নজর নেই। মানুষের মাঝে বিরাট আকারে ব্যবধান দেখা দিয়েছে। করোনা ধনীদের জীবনকে কিছুটা অস্বস্তিকর করে তুলেছে। তাদের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতেই কিন্তু লক ডাউন, শাট ডাউন, আইসোলেশন। করোনা আর কিছু না করুক ধনীদের জীবনকে একটু নাড়া দিয়েছে তবে যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে গোটা বিশ্বে সেখানে গরিবের নয় বড়লোকদের এজেন্ডার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বেশি।
যাইহোক সব কথার শেষ কথা সেটা ছিল এরকম। বিশ্বের মানুষের মৌলিক চাহিদা নিবারণে রাস্তায় নামো, সাথে আছি। যেমন পারলে সবাই মিলে বরং আগে বলি, খাবারে বিষ নয়, হৃদয়ে দুর্নীতি নয়, বিবেকের অধঃপতন নয়। তারপর বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং নৈতিকতা ফিরে পেতে সংগ্রাম করি, সাথে আছি। এসব সমস্যার সমাধান করতে তোমাদের সঙ্গে রাস্তায় মিছিলে নামতে রাজি। এখন তোমাদের সাথে যোগ দেব না তোমাদের ব্যক্তিগত চাহিদার জন্য, যেমন ভ্যাকসিন নয়। ভেবেছ কি? তোমাদের মতো লোকদের কারণে প্রতিদিন লাখো লাখো মানুষ মরছে আর তোমরা আছো মনের মতো করে ঘুরতে পারছো না তাই নিয়ে? আর কত দিন শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে? অন্যের কথাও ভাব, বলে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।
পরে বাসে করে রওনা দিলাম মাটসের বাসার উদ্দেশে। মাটস আমার এক কলিগ, অতীতে আমরা এক সাথে কাজ করেছি। তাদের বাসায় আসতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেল। তাদের বাড়ির আশপাশের সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখা হয়নি কারণ ভীষণ ঠান্ডা ছিল, তবে শিগগিরই আবার যাব তখন একটি ভিডিও করে দেখাব। উপরে আমি লিখেছি “বর্তমান সুইডিস জাতি আমার মতো বাড়ি বিক্রি করে ফ্লাট কিনছে”। লাইনটি মন থেকেই এসে গেল, পরে ভাবলাম কথাটি একটু বেশি হয়ে গেল কিনা! না, কারণ মন থেকে লিখেছি তাই সত্যকে তুলে ধরতে ক্ষতি কি? যাইহোক ডিনার শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত বারোটা বেজেছে। শুয়েছি তবে ঘুম আসছে না। ভাবছি জীবন চলার পথ একটি কঠিন যাত্রা, মনে সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। বানানো রাস্তায় তো সহজেই চলা যায় তবে রাস্তা বানিয়ে যদি সেই রাস্তায় চলা যায় নিশ্চয় অনুভূতিটা হবে অন্য রকম যেমন আমার ক্ষেত্রে আমি আমার নিজের রাস্তা নিজেই তৈরি করেছি। এমন করে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। তবে ঘুম থেকে উঠে দেখি শীতের সকালে চমৎকার সূর্য উঠেছে।
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন, rahman.mridha@gmail.com