হয়তো দুদিন পরে মরব আগে মরলে কী ক্ষতি!
চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুরের আত্মহত্যা ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে - ছবি : সংগৃহীত
আমার সুইডেনে প্রথম বছরে সামার জবের একটি স্মরণীয় ঘটনা হৃদয়ে গেঁথে আছে আজও। সেটি ঘটেছিল সুইডেনের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। সাইমোন ও ছারা অবসরপ্রাপ্ত সুইডিশ নাগরিক, থাকতেন ওই বৃদ্ধাশ্রমে। দুজনেরই বয়স ৭০ প্লাস। আমার বিশ্ববিদ্যালয় সামারে তিন মাস ছুটি। স্টকহোমে এসেছি সামার জব করতে। বৃদ্ধাশ্রমে কাজ পেয়েছি। এখানে বৃদ্ধদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করাই ছিল আমার কাজ। হুইল চেয়ারে করে তাদেরকে নিয়ে পার্কে ঘোরাঘুরি করা ছিল কাজের একটি অংশ। বৃদ্ধদের সাথে নানা বিষয়ের ওপর কথা বলা ছিল আমার সুইডিশ ভাষা শেখার একটি ভালো সুযোগ। এদের সামাজিক ও মানসিক দিকগুলো জানার এক অপূর্ব সুযোগ পেয়েছি তখন। সাইমোন ও ছারা প্রায় ৫০ বছর এক সাথে বিবাহিত জীবন পার করে আসছে। তাদের এক ছেলে নাম আন্দেস, চাকরি করে স্টকহোমের বাইরে। মা-বাবার সাথে খুব একটা দেখা হয় না।
সাইমোন ও ছারা প্রায়ই তাদের ছেলের ব্যাপারে আমার সাথে আলোচনা করেন। সবে বাংলাদেশ থেকে এসেছি, তাই তাদের ছেলের প্রতি দরদ দেখে নিজের পরিবারের কথা মনে পড়ত। প্রতিদিন ঘুমানোর সময় সাইমোন ও ছারার নানা ধরণের ওষুধ খাওয়ানো ছিল আমার কাজের আরো একটি অংশ। আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি তারা আমাকে বলত, রহমান তুমি চলে যাও আমরা পরে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। আমি কখনো তাদের কাজ কর্মে কোনো রকম সন্দেহ করিনি, তারপরও আমার বসকে একদিন বিষয়টি বললাম। বস বললেন, 'ঠিক আছে তারা যদি নিজেরা ওষুধ খেতে ভুলে না যায় তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি দেখো তারা যদি ভুল করে ওষুধ সেবন না করে তবে অবশ্যই তুমি ওষুধ খাইয়ে তবে বাসায় যাবে।'
আমি কখনো দেখিনি তারা ওষুধ খেতে ভুলেছে বা টেবিলে রেখে দেয়া ওষুধ টেবিলেই রয়ে গেছে। সাইমোন ও ছারাকে সবাই পছন্দ করে। আমি প্রায় দুমাসের বেশি কাজ করছি। তাই সবার সাথে একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। হঠাৎ একদিন সকালে এসে সাইমোন ও ছারার রুমে নক করছি কিন্তু তারা দরজা খুলছে না। কী করি? একস্ট্রা চাবি এনে ঘর খুলে দেখি সাইমোন ও ছারা দুজনে দুজনার হাতে হাত রেখে চিরনিদ্রায় শায়িত। কী ব্যাপার? কী হয়েছে? কেউ কিছু বলতে পারছে না। ডাক্তার ও পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করল, আমাকেও হাজারটা প্রশ্ন করল। আমি যা জানি তাই বললাম। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল ওভারডোজ ওষুধ খেয়ে তারা মারা গেছে। কিন্তু এত ওষুধ পেল কী করে? তদন্তে জানা গেল, মাসের পর মাস ওষুধ জমা করে এক সাথে সব ওষুধ খেয়ে তারা মারা গেছে। আমিসহ যারা সাইমোন ও ছারাকে সাহায্য করি, আমাদের কাজ তাদের সেবা করা এবং তাদের আদেশ মেনে চলা। যেহেতু দুজনই সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী তাই আমাদের কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। তারপরও দুজনের মৃত্যুর কারণে বৃদ্ধাশ্রমে তখন থেকে কিছু নতুন নিয়ম চালু করা হয়। তার মধ্যে একটি হলো ওষুধ সেবনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি সাহায্য করা। হঠাৎ এত বছর পরে ওই দিনের সেই ঘটনা আজ মনে পড়ে গেল।
আজ সুইডিশ টেলিভিশনে একটি খবর তুলে ধরেছে। বিশ্বের অনেক দেশে যদি কেউ কঠিন অসুখে ভোগা অবস্থায় বেঁচে থাকতে না চায়, তবে কিছু পেশাদার ডাক্তার তাদের মরতে সাহায্য করে ওষুধ দিয়ে। সুইজারল্যান্ড তার মধ্যে অন্যতম। এ বছরের প্রথম দিকে সুইডেনের একজন এএলএস রোগী মৃত্যুবরণ করতে সুইজারল্যান্ডের এক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে।
সবকিছু ঠিকঠাক এমন সময় কোভিড-১৯ এসে সব ভণ্ডুল করে দেয়। এএলএস (অ্যামাইটোট্রপিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস) বা লৌ গেহ্রিগ রোগ নামেও পরিচিত। এটি একটি নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুর রোগ। এটা সময়ের সাথে সাথে খারাপ হয় এবং আরো বেশি কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। এ রোগটি অক্ষমতা সৃষ্টি করে, কারণ এটি নার্ভের কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। সামান্য উপসর্গের সাথে রোগটি শুরু হয় যেমন হাঁটা চলা এবং শ্বাস প্রশ্বাসের অক্ষমতার সাথে সাথে এটি বাড়তে থাকে।
সুইডিশ এই রোগী ভুগে ভুগে জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকতে চান না। সুইডেন তাদের মোরাল ও এথিকস-এর বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা কাউকে মরতে সাহায্য করবে না, যার কারণে সুইডেন থেকে এই এএলএস রুগী দেশের বাইরে গিয়ে মরবে বলে প্লান করেছিলেন। গত কয়েক দিন আগে সুইডেনের এক অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার সুইডিশ নিয়ম ভঙ্গ করে ওই এএলএস রুগীকে মরতে সাহায্য করেন। অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার মনে করেন, যদি কেউ স্বেচ্ছায় তার নিজ জীবন নিতে চায় তবে কেন তাকে বাধা দিতে হবে? কষ্টে বেঁচে থাকার চেয়ে যদি কেউ মরতে চায় তবে পেশাদার ডাক্তারের সে ব্যাপারে সাহায্য করা উচিত। বিষয়টি নিয়ে সুইডেনে বেশ তোলপাড় হয়েছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত সুইডিশ পার্লামেন্ট কী সিদ্ধান্তে আসে এবং অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার কী সাজা পাযন! ডাক্তারের ডাক্তারি লাইসেন্স বাতিল হবে নাকি জেল-জরিমানা হবে সেটি দেখার বিষয়। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষের চিন্তা সুইডেনও কি তাহলে স্বেচ্ছায় রোগী মরতে আইন পরিবর্তন করবে? ঘটনাটি শেষ দেখার আশায় সবাই। আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগে সাইমোন ও ছারা নিজেদের দায়িত্বে সবার অজান্তে মৃত্যুবরণ করে সত্ত্বেও সুইডিশ জাতি আইন পরিবর্তন করেনি, দেখি এবার কী হয়।
মানুষ জাতির মৃত্যুর পেছনে সব সময় একটি কারণ থাকে। এখন যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় মরে বেঁচে থাকতে না চায় সেক্ষেত্রে বিষয়টি নতুন করে ভাববার বিষয় হতে পারে। তবে যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারা জানে নিজের জান নিজে নেয়া মহাপাপ। তারপরও এমনটি ঘটে চলেছে সারা বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশে। গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের গণ মাধ্যমে দেখছি এক লোক ফেসবুক লাইফে এসে আত্মহত্যা করেছে। কী কারণে এমন ঘটেছে সেটাও বর্ণনা করেছেন। নানা জনের নানা মত/দ্বিমত লক্ষ করছি। সব থাকতেও কোথাও কেউ নেই। এ ধরণের ঘটনা সুইডেনসহ বিশ্বের অনেক দেশে ঘটে চলছে। জাপানে সুইসাইডের হার বেশি তুলনা করলে অন্যান্য দেশের সাথে। বাংলাদেশে প্রতিদিনই এ ধরণের আত্মহত্যা হচ্ছে (গলায় দড়ি, গাড়ির তলে, বিষ খেয়ে ইত্যাদির মাধ্যমে) তা সত্ত্বেও ফেসবুক লাইফের মৃত্যুটা সবার বিবেকে নাড়া দিয়েছে। হতাশার কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বা ডেপ্রিশনের কারণে সাধারণত এমনটি ঘটে। মানসিক ভারসাম্য বা ডেপ্রিশন মানুষের মধ্যে হঠাৎ সৃষ্টি হয় না, কিন্তু দুর্ঘটনা যখন ঘটে সেটা হঠাৎই ঘটে এবং তখন আমরা রিঅ্যাক্ট করি।
সুইডিশ ভাষায় আমরা অনেক সময় বলি “tänk före efter” মানে হচ্ছে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। এটা যদি শুধু প্রবাদ বাক্য হিসাবেই ব্যবহার করা হয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে পরিবার, প্রতিবেশি এবং যারা একাকিত্ব জীবনযাপন করছে তাদের খোঁজখবর নেয়া। কারণ স্রষ্টা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মানবীয় গুণাবলি দিয়ে, জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে। যে কারণে জীবজগতের মধ্যে আমরাই শ্রেষ্ঠ জীব। কাজেই সেরা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। আমরা কি সে দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করতে পারছি!
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com