আফগানিস্তানে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি
আফগানিস্তানে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি - ছবি : সংগ্রহ
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আফগান দখল করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে খান খান হয়ে গেলে সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন ঘটে। এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একক পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বে আবির্ভাব ঘটে। পরিণতিতে আমেরিকানদের পররাষ্ট্রনীতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে পশ্চিমা আদর্শ ও সংস্কৃতির সম্প্রসারণে মনোযোগী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদকে ঠেকাতে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর বিশাল অংশ দায়িত্বমুক্ত বা কর্মহীন হয়ে পড়ে। এই বাহিনীকে প্রথমে নব্বইয়ের দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু ২০০০ সাল নাগাদ যুদ্ধের ব্যস্ততা স্তিমিত হয়ে এলে নতুন যুদ্ধ ময়দানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেনাদের ব্যস্ত রাখতে। তখন তাদের আফগান যুদ্ধে মোতায়েন করা হয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে। আমেরিকানরা বিশাল সামরিক বাহিনী ও অবকাঠামো সৃষ্টি করেছিল শীতল যুদ্ধের মোকাবেলায়। শীতল যুদ্ধ শেষ হলে যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে উপসাগরীয় যুদ্ধে এবং পরবর্তীতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশাল সামরিক বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। আর অন্যদিকে অস্ত্র ব্যবসায় জারি রাখা, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা নির্মাণের ঠিকাদার এবং বিভিন্ন ধরনের মার্কিন কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা ইত্যাদির মাধ্যমে গাছের আগার এবং তলার সমুদয় ফল ভোগ করার নীতি তারা গ্রহণ করেছিল।
ইসলামভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা : মার্কিনিদের আফগানিস্তান আক্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল ধর্ম হিসেবে ইসলামের একটি রাজনৈতিক ভিত্তি রচিত হওয়া। এটি একটি অলিখিত ও অপ্রকাশিত কারণ। সাধারণত বিশ্লেষকরা বিষয়টি বুঝেও নানা কারণে তা প্রকাশ করেন না বা আলোচনায় আনতে চান না। আর শক্তিশালী পশ্চিমা মিডিয়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে ইস্যুটি না তোলার কারণে বিভিন্ন দেশীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমও তা প্রকাশ করে না। কারণ, বিশ্বায়নের যুগে পশ্চিমা গণমাধ্যমই মূলত ফিডার মিডিয়া; যা দুনিয়ার অন্যসব মাধ্যম অনুসরণ করে থাকে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ মুসলিম অধ্যুষিত হলেও রাজতান্ত্রিকতা বা একনায়কত্বের কারণে ইসলামকে রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। কাজেই এসব মুসলিম দেশকে পশ্চিমারা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিজেদের পক্ষপুটে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কারণ, ইসলামের রাজনৈতিক কাঠামোকে পশ্চিমারা বা অমুসলিম বিশ্ব অত্যন্ত ভীতির চোখে দেখে থাকে। তাই সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর পতনের পর পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর উত্থান নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে। কাজেই ইসলামী আদর্শের রাজনৈতিক শক্তিকে কোনোভাবেই তারা বরদাশত করতে রাজি নয়। ইরান শিয়া সম্প্রদায়ের হলেও ইসলামী রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চার কারণে বিপ্লবের শুরু থেকেই এর পিছনে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব লেগে রয়েছে। এমতাবস্থায় আফগানিস্তানের সুন্নি তালেবানের ইসলামের নামে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া দেখে পশ্চিমা বিশ্ব হতচকিত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে তালেবানকে বাগে রাখতে পারবে ভেবে নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থে সমর্থন দিচ্ছিল। কিন্তু তালেবান নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে এবং শুধু আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার অজুহাত তুলে আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত আফগানিস্তান দখল করে নেয়।
সত্যিকারার্থে আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল মজুদের কারণেই যুগে যুগে ঔপনিবেশিক শক্তি দেশটিকে নিজেদের দখলে রাখার চেষ্টা করেছে। একই কারণে মার্কিনিরা আফগানিস্তানে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। অবশ্য ওই সব আকর্ষণের সাথে যুক্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টাইমলাইন, একক পরাশক্তির বিশ্বব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্থানের ভীতি। সবশেষে ‘৯/১১’-এর ঘৃণ্য সন্ত্রাসী আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রকে তালেবানের ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস করে আফগানিস্তান দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণের সুযোগ করে দেয়। তাইতো কেবল একজন ব্যক্তিকে আশ্রয়দানের ‘অপরাধে’ একমাত্র পরাশক্তি ধরাতলের যুদ্ধবিধ্বস্ত দরিদ্রপীড়িত একটি রাষ্ট্রটিকে দখল করে নেয়। তারপর দীর্ঘদিন সেই দেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার, জীবনাচার ও মূল্যবোধ, সামাজিক ঐতিহ্য ও রীতি-নীতি এবং রাজনৈতিক গতিধারা নতুনভাবে পশ্চিমা ধাঁচে বিনির্মাণের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। এ সবকিছুর পিছনেই ক্রিয়াশীল ছিল পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্কীর্ণ স্বার্থ আর লাভ-লোকসানের হিসাব।