আফগানিস্তানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
আফগানিস্তানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব - ছবি : সংগ্রহ
মহাকবি ইকবাল আফগানিস্তানকে বলেছেন, এশিয়ার ‘হৃদ-স্থল’। লর্ড কার্জন বলেছেন, এশিয়ার ‘ককপিট’। বিখ্যাত ‘সিল্করোড’ আফগানিস্তানের ওপর দিয়েই ছিল। দেশটি ইরান, আরব সাগর, ভারত এবং মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ পথে অবস্থিত হওয়ায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ আফগানিস্তান দখলে আক্রমণ চালিয়েছে। আলেকজান্ডার ৩২৯ খ্রি. পূর্বাব্দে আফগানিস্তান জয় করেছিলেন। ৮৭৪ খ্রি. থেকে ৯৯৯ খ্রি. পর্যন্ত পার্সিয়ানরা আফগানিস্তান শাসন করে। ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান আফগানিস্তানে আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। ১৩৮১ সালে চেঙ্গিস খানের বংশধর তৈমুর লং হেরাত দখল করেন। এরপর ব্রিটিশরা উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপনের পর ১৯ শতকে তিন তিন বার আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। ইতিহাসের শিক্ষাকে উপেক্ষা করে আমেরিকানরাও একবিংশ শতাব্দীতে এসে দখলদারিত্বের মাধ্যমে আফগানিস্তানে একটি তাঁবেদার সরকার গঠন করে পুরো এশিয়া অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। আফগানিস্তানে তাঁবেদার সরকার থাকলে সেখানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে তৎকালিন উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়াকে সামাল দিতে দ্রুত প্রয়োজনীয় সৈন্য মোতায়োনের সুবিধাদি অর্জন দরকার হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকেও আফগানিস্তান থেকে চাপে ফেলতে সেখানে মার্কিন উপনিবেশ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
পাইপলাইন রাজনীতি : আফগান যুদ্ধের ধাক্কায় সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ার ছয়টি দেশ স্বাধীন হয়ে যায় ১৯৯১ সালে। এই দেশগুলোতে প্রচুর তেল ও গ্যাসের মজুদ থাকলেও ভূমিবেষ্টিত হওয়ায় তারা এই সম্পদ বাইরের বাজারে রফতানির সুযোগ বঞ্চিত ছিল। এজন্য এসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা তেল-গ্যাস রফতানির একমাত্র উপায় হিসেবে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে পাইপলাইন বসাতে সর্বাত্মক চেষ্টা শুরু করে। এ অঞ্চলে তেলের মজুদ রয়েছে ৫০ বিলিয়ন ব্যারেল এবং গ্যাসের পরিমাণ ২৩৬-৩৩৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (ওবেই জাগীরদার, ২০২১)। আরব উৎস থেকে প্রাপ্ত তেলের বিকল্প হিসেবে জ্বালানির বিকল্প উৎস এই মধ্য এশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের লোলুপ দৃষ্টি পতিত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ও রাশিয়ার মাটি উপেক্ষা করে একমাত্র আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের করাচি সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত পাইপলাইনই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক ব্যবস্থা। কিন্তু ১৯৯৮ সালের পর থেকে তালেবান সরকারের সাথে টানাপড়েন শুরু হলে এ পাইপলাইন স্থাপনে আফগানিস্তানে একটি পশ্চিমা তাঁবেদার সরকার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাঁবেদার সরকার বা রাজা-বাদশাহদের বসিয়ে একই কায়দায় ব্রিটিশ ও মার্কিনিরা অদ্যাবধি ওই এলাকার তেল সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই উদ্দেশ্যেই মার্কিন বাহিনী মাত্র দুই মাস যুদ্ধ করে তালেবান সরকারকে হাটিয়ে আফগানিস্তানে একটি অনুগত সরকার বসিয়ে টানা ২০ বছর ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।
আফগানিস্তানের মজুদ প্রাকৃতিক সম্পদ : মূলত আফগানিস্তানের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদে প্রাচীনকাল থেকেই সম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ আফগানিস্তানের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছে। সর্বশেষ আগ্রাসী মার্কিন বাহিনীও এর বাইরে নয়। দুষ্প্রাপ্য মৃত্তিকা ও পাথরের উৎসস্থল হলো আফগানিস্তান। এগুলোর মধ্যে আছে নীলকান্তমনি, চুনি, নীলা, কপার, পান্না, স্ক্যানভিয়াম ও ইউর্কিরিয়াম। কাবুলের ২৫ মাইল দক্ষিণে লগার প্রদেশের মেস এয়াংক খনিতে প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন কপার মজুদের সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন দখলদারিত্বের সময় তালেবানদের কঠিন প্রতিরোধের মুখেও আফগানিস্তানে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের খনিজ উত্তোলন করা হতো। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার তথ্যমতে উত্তর আফগানিস্তানে গড়ে ২৯০ শত কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত খনিজ তেল ও ১৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে।