চীনা প্রভাব বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলন
চীনা প্রভাব বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলন - ছবি : সংগ্রহ
গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যেখানে প্রয়োজন লড়াই করা এবং গণতন্ত্রের ধারণা আরও সংহত ও শাণিত করার ব্রত নিয়ে ৯-১০ ডিসেম্বর, ২০২১ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। তিনি সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর মোকাবেলায় কাজ শুরু করেছেন। এই সম্মেলনে কে কী পেল তার হিসাব নিকাশ ও পরবর্তী ধাক্কা সামাল দিতে অনেক দেশ সচেষ্ট। পাকিস্তান দাওয়াত পাওয়ার পরও সম্মেলনে যায়নি। তার প্রতিক্রিয়া শুরু না হলেও যে কোন সময় পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচির অধীনে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বাংলাদেশের র্যাবের বিরুদ্ধে আংশিক অবরোধ দিয়েছে। ‘মার্কিন বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০ বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, এসব ঘটনা বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর ঘটানো হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি অ্যান্ড স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ঢাকার অসন্তোষ জানাতে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিলারকে তলব করেছিলেন।
পররাষ্ট্র সচিব দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের এমন একটি সংস্থার ক্ষমতা হ্রাস করতে চাইছে, যেটি সন্ত্রাসবাদ, মাদক পাচার ও অন্যান্য আন্তঃদেশীয় অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মুখসারিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই তাদের যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হয়। পররাষ্ট্র সচিব আরো বলেন, কিছু নির্দিষ্ট ঘটনার জন্য র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো করা হয়েছে। এর আগে এই বিষয়গুলোর জবাবদিহিতার জন্য শুধু মার্কিন প্রশাসনের কাছে নয়, একাধিকবার জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থার কাছেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, যাদের দেশে গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন, অন্য দেশকে গণতন্ত্রের সবক দেয়ার অধিকার তারা রাখে কি না। তিনি আরো জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র এবং বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে তাদের সহযোগিতা রয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলনের প্রচেষ্টা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসাবে ঘোষণা করা এবং গণতন্ত্রকে অটোক্র্যাসির বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর আরেকটি প্রচেষ্টা। তীর কিন্তু রাশিয়া ও চীনকে লক্ষ্য করেই ছোড়া হয়েছে। এতে কি কোন লাভ হলো নাকি পরিস্থিতি আরো জটিল বা বিভক্ত হলো সেগুলো বিশ্লেষকরা এখন একে একে প্রকাশ করছেন। এরই মধ্যে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোট ও রাশিয়ার সমরযন্ত্র মুখোমুখি; চীন যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাইওয়ান প্রণালীতে বিমান বহর ছেড়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেকেকে, কু ক্লাক্স ক্লান আমেরিকায় ধারাবাহিকভাবে অ-শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। অ-শ্বেতাঙ্গরা চিৎকার করে বলছে, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’ কালোরা ও এশিয়ান কিছু সংগঠন সহ-অবস্থান ও সমান আচরণের জন্য রাস্তায় বিক্ষোভ করে আসছে।
চীন এমনকি রাশিয়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বিষয়ে ভালো ফল দেখিয়েছে। চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমেরিকা ভারতকে কৌশলগত অংশীদার হিসাবে বেছে নিয়েছে যদিও আরএসএস নেতা নরন্দ্রে মোদি ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিগণিত করতে অস্বীকার করেছে। খ্রিষ্টান, শিখ, মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের হত্যা, তাদের উপাসনাস্থল অপবিত্র ও ধ্বংস করা, কাশ্মির, পূর্ব ভারত, খালিস্তান এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার রাজ্যে ভিন্নমত, স্বাধীনতা ও স্বশাসনের আন্দোলনের কণ্ঠস্বর রোধে রাষ্ট্রীয় শক্তির নির্মম ব্যবহার কেবল কয়েকটি উদাহরণ যা ভারতকে তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতাকারী রাষ্ট্র হিসাবে প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট।
গণতন্ত্র সম্মেলনের সবচেয়ে বড় সমালোচক চীন মার্কিন গণতন্ত্রকে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। চীন বাইডেনকে স্নায়ুযুদ্ধ-যুগের মতাদর্শগত বিভাজন সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিদেশে রঙিন বিপ্লব উসকে দেয়ার জন্য দায়ী করেছে। এই রঙিন বিপ্লব একসময় ইরানে হট কেকের মতো বিক্রি হয়েছিল। এখনো খালক গ্রুপ সসেজের মতো তা সংগ্রহ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে ব্যস্ত রয়েছে।
চীন আরো বলেছে, সম্মেলনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাদর্শগত কুসংস্কার ও সঙ্ঘাতকে উসকে দিয়েছে আর বেইজিং ‘সব ধরনের ছদ্ম-গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ ও বিরোধিতা করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শীর্ষ সম্মেলনের আগে, চীন মার্কিন গণতন্ত্রকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ব্যর্থ বলে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার অস্বীকার করেছে যে চীনের সাথে আরেকটি শীতল যুদ্ধ হবে না। তথাপি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা, মানবাধিকার, জিনজিয়াং এবং তাইওয়ান নিয়ে উত্তেজনা দিন দিন বেড়েই চলেছে, শীতল যুদ্ধের পরিবর্তে বরং সামরিক সংঘর্ষই কাল হয়ে দেখা দিচ্ছে।
গণতন্ত্র সম্মেলনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচারী শাসকদের সামনে সমমনোভাবাপন্ন মিত্রদের জড়ো করা। যাদের ডাকা হয়নি তাদের মধ্যে রাশিয়া ও চীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা যুদ্ধ-যুগের আদর্শগত বিভাজনের অভিযোগ এনেছেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, ‘গণতন্ত্র’ দীর্ঘদিন ধরে ‘গণধ্বংসের অস্ত্র’ হয়ে উঠেছে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বাইডেন বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র কোনো সীমানা জানে না। এটি প্রতিটি ভাষায় কথা বলে।’ ‘আমরা তাদের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যারা এই মূল্যবোধের অংশীদার’ বাইডেন প্রতিজ্ঞা করেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়াবে ‘যারা তাদের জনগণকে মুক্ত শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা দেয় এবং লোহার হাত দিয়ে তাদের লোকদের দম বন্ধ করার চেষ্টা করে না।’
ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রেসিডেন্ট বাইডেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা সমর্থন করার জন্য ৪২৪ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও আর্থিক সমর্থনের বিষয়টি সম্মেলনের আগে প্রচার পায়নি।
১ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, পিপলস রিপাবলিক অব চায়না, পিআরসি’র প্রশাসনের ফর্ম এবং বিষয়বস্তু বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের সবার কাছে পরিচিত কারণগুলোর কারণে বিশ্বজুড়ে গুরুতর উদ্বেগের বিষয় ছিল। এখন একটি গণতান্ত্রিক থিম এবং প্রচলিত মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো বিষয়টির পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
শুরু থেকেই পিআরসি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাশক্তি এবং পর্যাপ্ত সম্পদের অধিকারী হয়ে নিজেকে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধাগুলোর মডেল হিসাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। পিআরসি, অনেক সমস্যার বোঝা নিয়ে একদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতীকী হয়ে গেছে।
গত সাত দশকে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনও প্রতিটি ক্ষেত্রে অসাধারণ উন্নয়ন দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক অতীত থেকে এর অর্থনীতিসহ অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন শক্তি এবং প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। একই সাথে, আধুনিকায়নের আগমন, ক্রমবর্ধমান আয় এবং তথ্যের সাথে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিস্তার চীনে গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাওয়ার পথ আরো প্রশস্ত করেছে।
চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে গভীর এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চীনকে সীমিত গণতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত শক্তি হিসাবে কাজ করে; কারণ চীনা সিস্টেম নিজেই সেই বিপদগুলো সম্পর্কে সচেতন যা মিখাইল গর্বাচেভের শাসনামলে পুরোনো ইউএসএসআরের পতনের দিকে পরিচালিত করেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে চীনের একটি নির্বাচনী গণতন্ত্রে পরিণত হওয়ার কোনো আশা নেই, এটি কিছু ব্যক্তিগত বিধিনিষেধ এবং অন্য সীমাবদ্ধতাগুলোকে সহজ করে জনগণের কিছু অভিযোগের সমাধান হিসাবে কাজ করতে পারে।
জো বাইডেন গণতন্ত্রের জন্য ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করার সাথে সাথে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে গণতান্ত্রিক ক্ষয় এই সময়ের চ্যালেঞ্জ। গণতন্ত্র অবরোধের মধ্যে রয়েছে এবং বছরটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন, অভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচারী নির্লজ্জতার দ্বারা পরিচিহ্নিত। বলতে গেলে টানা পাঁচ বছর ধরে কর্তৃত্ববাদের দিকে এগিয়ে চলা দেশের সংখ্যা গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চাৎপসরণকারীদের মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, ভারত এবং ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশগুলো। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২০ সালের ক্ষতি স্বীকার করতে অস্বীকার করার কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গণতন্ত্রও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।
অতিথিদের তালিকায় এমন অনেক নেতাও রয়েছেন যারা গণতান্ত্রিকভাবে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। যার মধ্যে ভারতের নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলের জাইর বলসোনারো এবং ফিলিপাইনের রদ্রিগো দুতার্তে রয়েছেন। শীর্ষ সম্মেলনের তালিকায় থাকা এক-চতুর্থাংশেরও বেশি দেশকে গণতন্ত্রের নজরদারি সংস্থা ফ্রিডম হাউসের রেটিংয়ে আংশিক গণতান্ত্রিক বলা হয়েছে। সে হিসেবে আরো অনেক দেশ সম্মেলনে যোগদানের যোগ্য হলেও রাজনীতির ধারালো তলোয়ার সেগুলোকে ছাঁটাই করেছে। অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং ইরাকের তিনজন আমন্ত্রিত ব্যক্তিকে মোটেও মুক্ত বলে মনে করা হয় না। ভারত এবং পোল্যান্ডের বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
গণতন্ত্রের জন্য কিছু গুরুতর হুমকি হলো অবিশ্বাস, মেরুকরণ, ভোটার দমন এবং পক্ষপাতমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো। কূটনৈতিক চাপ গণতান্ত্রিক অনুশীলনকে উৎসাহিত এবং প্রচার করতে পারে, তবে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে কতটুকু কার্যকর তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
কোনো দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতন্ত্র রক্ষা বা ধ্বংস করার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ভোটাধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা সুস্থ গণতন্ত্রের ভিত্তি। জনসাধারণের পরিষেবাগুলোতে প্রবেশে বাধা, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং হ্রাসপ্রাপ্ত বস্তুগত সমৃদ্ধিও গণতন্ত্রকে পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মতে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, সংবাদপত্র গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধ।
বছরের পর বছর ধরে, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সুশীল সমাজের দলগুলো আরো শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য চাপ দিয়েছে। গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলন, বাইডেন প্রশাসনের জন্য তাদের সাথে জড়িত থাকার একটি ভালো প্ল্যাটফর্ম হতে পারত, ফোরামটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের কণ্ঠস্বর শোনার এবং তাদের সরকারকে জবাবদিহি করার সুযোগও দিতে পারত।
শুরুতে, বাইডেন প্রশাসন শীর্ষ সম্মেলন থেকে কিছু প্রধান খেলোয়াড়কে বাদ দিয়েছিল, শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং মালদ্বীপকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ওয়াশিংটন যেভাবে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের বেছে নিয়েছে তাতে স্বচ্ছতা দেখা যায় না। সমস্যার একটি অংশ হোয়াইট হাউজ গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে চীনকে লক্ষ্য বানায়। ফলে কৌশলগত বিভ্রান্তি জন্ম নেয়।
চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রায় অপরিবর্তনীয় অংশীদার হওয়ায় ভারত এই ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। নেপাল এবং মালদ্বীপ উভয়ই চীনের সাথে একই সারিতে কৌশলগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ- আগেরটি হিমালয়ে এবং পরেরটি ভারত মহাসাগরে। পাকিস্তান বছরের পর বছর ধরে অবিচলভাবে বেইজিংয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, কিন্তু তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে তার ভূমিকা ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা স্বার্থে এটিকে অপরিহার্য করে তুলেছে।
স্বাভাবিকভাবেই, এই অঞ্চলের কিছু দেশ আমন্ত্রণটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনে করেছে। বাংলাদেশও সোচ্চার ছিল। শীর্ষ সম্মেলনের আগে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন যুক্তি দিয়েছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র ‘দুর্বল’ গণতন্ত্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তিনি তার দেশকে পরেরবার আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কা সবাই এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান বলয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। বলা হয়, এই বছরের শুরুর দিকে, কোয়াডে যোগদানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে বেইজিং সতর্কবার্তা দিয়েছিল। জনাব মোমেন তাৎক্ষণিকভাবে বলেন যে, বাংলাদেশ নিজেই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবে; আর ভুটান চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধে অনেকটা জর্জরিত।
কিছু দেশকে আলিঙ্গন করে এবং অন্যদের ছেড়ে দিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে- অন্তত আদর্শগতভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে একত্রিত করার একটি সুযোগ নষ্ট করেছে।
সাংহাইতে ২০২১ সালের বুন্ড সামিটে, (ইঁহফ ঝঁসসরঃ) মার্কিন কৌশল সমন্বয় এবং বিশ্বব্যবস্থার ওপর প্রভাব সম্পর্কে প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব সম্ভাবনাকে উন্নতির শীর্ষে নিতে পারে, কিন্তু কোনো দেশেরই বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করার সম্ভাবনা নেই।’
কিসিঞ্জার আশা করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন সহযোগিতা ও সমতার ধারণার ভিত্তিতে অনেক ক্ষেত্রে একে অপরের সাধারণ অধিকার ও সহযোগিতার স্বীকৃতি দিতে পারে।
তিনি বলেন যে, প্রধান দেশগুলো বিভিন্ন জটিল ও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যেগুলো অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় নির্ভুলতা প্রমাণ করেছে, তাই এগুলো অত্যন্ত ধ্বংসাত্মকও বটে। এই প্রযুক্তিগুলো এখন লক্ষ্য হয়ে উঠেছে, এই দেশগুলোকে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আলোচনার জন্য সবার জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাছাড়া, মহামারী পরবর্তী যুগে অন্তত চিকিৎসা এবং অ-কৌশলগত বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার