খনির নিচে গোপন কুঠুরিতে রাশি রাশি সোনা!

অন্য এক দিগন্ত | Feb 03, 2022 02:12 pm
খনির নিচে গোপন কুঠুরিতে রাশি রাশি সোনা!

খনির নিচে গোপন কুঠুরিতে রাশি রাশি সোনা! - ছবি : সংগ্রহ

 

খনিতে দীর্ঘ দিন খননকাজ বন্ধ। সেই অব্যবহৃত খনির একটি গোপন কুঠুরিতে রাখা ছিল রাশি রাশি সোনাদানা, গয়নাগাঁটি। বস্তায় ভরা নোটের বান্ডিল। মূল্যবান শিল্পকর্ম। বছরের পর বছর ধরে গোটা ইউরোপ জুড়ে নাৎসিদের লুঠপাটের ওই ধন খুঁজে পেয়েছিল আমেরিকার সেনাবাহিনী।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে খুঁজে পাওয়া সেই ধনসম্পত্তির আর্থিক মূল্য চোখ কপালে তোলার মতো। কিভাবে সন্ধান পাওয়া গেল ওই বিপুল সম্পত্তি? লুঠের সামগ্রী নিয়ে কী করেছিলেন আমেরিকার সেনারা?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মানি দখলের পর সে দেশের দিকে পা বাড়িয়েছিল আমেরিকার থার্ড আর্মি। মের্কের্স-কাইজেলবাখ শহরে ঢুকে পড়েছিল তারা। হঠাৎই গোপন সূত্রে খবর এলো, শহরের কাছে একটি অব্যবহৃত নুনের খনিতে থরে থরে সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছে জার্মান সেনা। সবই নাৎসিদের লুঠের সামগ্রী! সঙ্গে সঙ্গে সে খবর পৌঁছেছিল আমেরিকার সেনার উপরমহলে।

কিছু দিনের মধ্যে থার্ড আর্মির জেনারেল আইজেনহাওয়ার এবং জেনারেল প্যাটন পৌঁছে যান ওই খনিতে। চাক্ষুষ করেন নাৎসিদের লুঠ করা বিপুল সামগ্রী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি ডলারের সোনা লুঠ করেছিল নাৎসিরা। এমনকি, ইহুদিদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তাদের দাঁতে বাঁধানো সোনা বা সোনার সিগারেটের বাক্স বা গয়নাগাঁটি। বাদ পড়েনি সংগ্রহালয়ের শিল্পসামগ্রীও।

লুঠের কোটি কোটি ডলারের বেশির ভাগই যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র কেনায় খরচ করেছিল নাৎসিরা। তা সত্ত্বেও সম্পত্তি ফুরোয়নি। বেশির ভাগ সোনা রাখা হয়েছিল জার্মানির শীর্ষ ব্যাঙ্ক রাইখসব্যাঙ্কে। তবে জার্মানি দখলের খবর পাওয়ামাত্রই বার্লিনের ওই শীর্ষ ব্যাঙ্ক থেকে সোনা সরানোর সিদ্ধান্ত নেন জার্মানির সেনা কর্তৃপক্ষ। মিত্রশক্তির হাত থেকে সোনা বেহাত হওয়ার ভয়ে তা রাইখসব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখায় পাঠিয়ে দিতে শুরু করেন তাঁরা।

১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্লিনে বোমাবর্ষণ করতে শুরু করেছিল মিত্রশক্তি। তাতে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল রাইখসব্যাঙ্ক। নষ্ট হয়ে যায় ব্যাঙ্কের ছাপাখানাগুলিও। এর পরেই রাইখসব্যাঙ্কে থাকা সোনাদানার বড় অংশ মের্কের্সের একাধিক খনিতে সরানোর সিদ্ধান্ত নেয় জার্মানি। সেই সময়ে যার অর্থমূল্য ছিল ২৩.৮ কোটি ডলার। সোনাদানার পাশাপাশি অসংখ্য নোটের বান্ডিলও সরানো হয়েছিল।

বিপুল সম্পত্তি লুকিয়ে রাখার জন্য মের্কের্সের নুন এবং পটাসিয়াম খনিগুলিকেই সুরক্ষিত বলে মনে হয়েছিল জার্মান সেনার। বার্লিন থেকে প্রায় দু’শো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ওই খনি ভিতরে আগে থেকেই যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করত সেনা। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমাবর্ষণে তত দিনে খনির উপরের কারখানা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

বার্লিনে সপ্তাহখানেকের মধ্যে প্রায় দু’হাজার ৩০০ টন বোমাবর্ষণ করেছিল আমেরিকান বি-১৭ বিমানের বোমারুরা। বোমাবর্ষণের মাঝেই মের্কের্সের রেলপথে ‘মালপত্র’ বোঝাই করে ট্রেন ছুটেছিল। তাতে ছিল এক হাজার বস্তায় ভরা ১০০ কোটি রাইখসমার্ক (১৯২৪ থেকে ১৯৪৮ সালের ২০ জুন পর্যন্ত তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে প্রচলিত মুদ্রা)। সঙ্গে ছিল বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রাও। ছিল হিরের গয়না, সোনা-রুপোর কয়েন, বাঁট এবং গয়নাগাটি, সোনার বাক্সও। সবই ইহুদিদের থেকে লুটের সামগ্রী। প্রাশিয়ার ১৪টি সংগ্রহালয়ের এক-চতুর্থাংশ শিল্পকর্মও।

ফেব্রুয়ারি-মার্চ জুড়ে ট্রেনে করে এ ভাবেই বিভিন্ন খনিতে সম্পত্তি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জার্মানির পতনের আগে পর্যন্ত তা বন্ধ হয়নি। থার্ড আর্মির পদধ্বনি শোনার আগেই যতটা সম্ভব লুঠপাটের সামগ্রী সরিয়েছিল জার্মান সেনা। তবে এক দিকে ইস্টারের ছুটি, অন্য দিকে রেলসেতু উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সে কাজ ব্যাহত হয়েছিল।

সমস্ত সম্পত্তি সরানো অসম্ভব বুঝতে পেরে অন্য পন্থা নেয় জার্মান সেনা। এ বার নোটের বান্ডিল সরাতে শুরু করেছিল। ২ এপ্রিল প্রায় ২০ কোটি রাইখসমার্ক এবং ৫০টি বস্তায় ভরা বিদেশী নোট ট্রাকবোঝাই করে মাজবার্গ এবং হ্যালে সরানো হয়েছিল। একটি গোটা ট্রেনের কামরায় বোঝাই করা হয়েছিল লুটের সামগ্রী। তবে বোমাবর্ষণে রেলসেতু উড়ে যাওয়ায় ফের মের্কের্সের পথ ধরে জার্মান সেনা।

সপ্তাহখানেকের মধ্যে মের্কের্সে হানা দেয় থার্ড আর্মি। মের্কের্সের সম্পত্তির খবর পেয়ে খনির পাঁচটি প্রবেশপথে রক্ষী মোতায়েন করে তারা। ৭ এপ্রিল থার্ড আর্মির লেফেটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম এ রাসেলের নেতৃত্বে সেনা ঢোকে মের্কের্সের খনিতে। সঙ্গে ছিলেন চিত্রগ্রাহকরাও।

খনির ভিতরে চলমান সিঁড়ি দিয়ে নামতেই আমেরিকার সেনানিদের চক্ষু চড়কগাছ! খনির ভিতরের প্রধান পথে রাখা ছিল ৫৫০টি বস্তাবোঝাই রাইখসমার্কের বান্ডিল। তবে আসল সম্পত্তি ছিল একটি গোপন কুঠুরিতে!

গোপন কুঠুরিটি তিন ফুট দীর্ঘ ইটের দেওয়াল দিয়ে ঢাকা ছিল। দেওয়ালের মাঝে ছিল একটি স্টিলের দরজা। তাতে ব্যাঙ্কের ভল্টের কায়দায় বিরাট বড় তালা। কম্বিনেশন লকের নম্বর এবং সঠিক টাইমিং না থাকলে যে তালা খুলবে না। ডিনামাইট দিয়ে ওই দেওয়াল উ়ড়িয়ে দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছিল থার্ড আর্মি।

১৫০ ফুট লম্বা এবং ৭৫ ফুট চওড়া গোপন কুঠুরির ছাদ ছিল ১২ ফুট উঁচুতে। কুঠুরির মধ্যে রাখা ছিল সোনার কয়েন এবং বাঁটবোঝাই সাত হাজার বস্তা। ৫৫টি বিশেষ বাক্সে বন্দি ছিল প্রচুর সোনার বাট। সাথে আরো শত শত সোনার সামগ্রী।

সোনার রাইখসমার্ক নোটই ছিল এক হাজার ৩০০ বস্তার বেশি। ওই একই সংখ্যক রাইখসমার্কও মিলেছিল। ছিল ৭১১টি বস্তায় ভরা সোনার ডলার। বস্তা বস্তা সোনার পাউন্ড, ফ্রাঁ-এর নোট। সঙ্গে দু’হাজারেরও বেশি ব্যাগে ভরা বহু দেশের মুদ্রা। পাশাপাশি, ৪০০ টন শিল্পসামগ্রীও উদ্ধার হয়েছিল।

ছোট্ট কুঠুরিতে কী ভাবে বিপুল সম্পত্তি রাখা হয়েছিল? হতবাক জেনারেল আইজেনহাওয়ার পরে লেখেন, ‘সমস্ত কিছু ঠেসে স্যুটকেসে ভরা হয়েছিল। ট্রাঙ্ক ও অন্যান্য বাক্সে সোনা-রুপোর প্লেট, গয়নাগাঁটি ভরা ছিল। জায়গা বাঁচাতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সমস্ত সামগ্রীকে চ্যাপ্টা করে রাখা হয়েছিল।’ সব মিলিয়ে ওই ছোট্ট কুঠুরি থেকে ৫২ কোটি ডলারেরও বেশি সম্পত্তি উদ্ধার করেছিল থার্ড আর্মি! সেই সময়ের নিরিখে যা বিপুল পরিমাণ অর্থ।

এই বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির কী পরিণাম হয়েছিল? ’৪৫-এর গ্রীষ্মে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের মুদ্রাগুলি ফিরিয়ে দিয়েছিল আমেরিকা। শিল্পসামগ্রীও ফেরানোর কাজ শুরু হয়েছিল। সোনা-রুপোর নোট বা মুদ্রা ফেরানোর কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সে জন্য ত্রিপক্ষীয় কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কাজ শেষ হয়েছে ১৯৯৬ সালে।

সে বছরই মের্কের্সের খনির শেষ সোনা পৌঁছয় তার মালিকের হাতে। মুদ্রা ছাড়াও গয়নাগাঁটির সোনাদানা ফেরানোর নজরদারির কাজে অন্য একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল।

কমিশনের মাধ্যমে মের্কের্সের বিপুল সম্পত্তি ফেরানোর কাজ মিটলেও এ নিয়ে আজও তর্ক মেটেনি। কত পরিমাণ সোনা-রুপোর সম্পত্তি গলিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং তা ব্যাঙ্কের মুদ্রার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক কম নয়।

নাৎসি-নির্যাতনের শিকার ইহুদিদের উত্তরাধিকারীদের লুঠের সামগ্রীর কত অংশ পাওয়া উচিত? আদৌ কি তা আসল মালিকের হাতে পৌঁছেছে? এ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ১৯৯৭-’৯৮ সালে অন্তত ১৫টি দেশ নাৎসি-লুঠের অংশ থেকে নিজেদের দাবি ছেড়ে দেয়। যা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ মেট্রিক টন সোনা!

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us