রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে আমূল বদলে যেতে পারে দুনিয়া?
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে আমূল বদলে যেতে পারে দুনিয়া? - ছবি : সংগ্রহ
ইতিহাস সাক্ষী, যুদ্ধের নেশাকে খুব সহজে দমানো যায় না বাস্তবের দুনিয়ায়। তাই যতই শান্তির সপক্ষে গড়ে উঠুক জনমত, বারবার যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়েছে আকাশে। এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তৈরি হওয়া উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে বিশ্ব। এর আগেও বারবার পরিস্থিতি অশান্ত হলেও এবারের মতো উত্তেজনা কোনোবারই তৈরি হয়নি বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের। ফলে আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে তা কেবল দু’টি দেশের মধ্যে সংঘাতমাত্র হয়ে থাকবে না। বদলে দেবে এই পৃথিবীর অনেক সমীকরণ। এমনকী, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কুটিল ছায়াও নজরে পড়ছে কারো কারো চোখে।
যদিও গত কয়েক দিনে পরিস্থিতি কিছুটা শুধরেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উপরেই নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, সেই সময় প্যারিসে মস্কো ও কিয়েভের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে হওয়া বৈঠকে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। দু’পক্ষই ইঙ্গিত দিয়েছে যুদ্ধবিরতির। এমনকি, ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ফের একবার বৈঠক হতে পারে বলেও দাবি করেছে জার্মান প্রশাসনের এক সূত্র। কিন্তু তবুও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি যা, তাতে সাময়িকভাবে যুদ্ধের আশঙ্কা কিছুটা কমলেও শেষ পর্যন্ত যে যুদ্ধকে এড়ানো যাবেই, একথা হলফ করে বলা মুশকিল।
শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে তা গড়ায় তা জানতে এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কেন ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছে রাশিয়া? শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হলে তা কতটা প্রভাব ফেলবে বাকি বিশ্বে? ভারতেই বা তার কী প্রভাব পড়বে? সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
গত কয়েক বছর ধরেই পূর্ব ইউক্রেনে সরকারি বাহিনীর সাথে ‘রাশিয়ার মদতপুষ্ট’ বিদ্রোহীদের লড়াই চলছেই। কিন্তু পরিস্থিতি সবচেয়ে গুরুতর হয়ে ওঠে ২০১৪ সালের পর থেকে। সেবারের নির্বাচনে ইউক্রেনের নাগরিকরা রুশপন্থী এক নেতাকে দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে সরিয়ে দেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। ব্যাপারটা একেবারেই ভালভাবে নেয়নি রাশিয়া। ক্রিমিয়া দখল করে মস্কো। যদিও তাদের উপরে এরপরই একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা। কিন্তু রাশিয়া তাদের ‘রণং দেহি’ হাবভাব বদলানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। উল্টা নতুন করে মদত জুগিয়ে গিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। সেই বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যই ছিল, পূর্ব ইউক্রেনকে দখল করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা। যা দেখে অসন্তোষ বাড়তে ইউক্রেন সরকারের। এরপরই তারা দ্বারস্থ হয় ন্যাটোর। আর এখান থেকেই ব্যাপারটা এক অন্য বাঁক নেয়।
সামরিক জোট ন্যাটোর নেতৃত্বে রয়েছে আমেরিকা। তারা এখনো ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণই জানায়নি। তবে ইউক্রেন লাগাতার আলোচনা চালিয়ে গেছে। আর ততই ক্ষোভ বেড়েছে রাশিয়ার। গত কয়েক বছরে ইউক্রেনের সেনা ও রাশিয়ার মদতপুষ্ট বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি না শুধরালে আগামী দিনে রক্তক্ষয় আরও বাড়াই হয়তো নিয়তি। আর যুদ্ধ একবার প্রত্যক্ষভাবে শুরু হয়ে গেলে যে আরো কত ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি হবে তা বলাই বাহুল্য।
যুদ্ধের উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে বিশ্ব
কিন্তু কেন রাশিয়া কোনোভাবেই চায় না ন্য়াটোয় যোগ দিক ইউক্রেন? আসলে রাশিয়া বরাবরই strategic depth-কে কাজে লাগিয়ে শত্রুবাহিনীকে বেকায়দায় ফেলেছে। কী এই কৌশল? ভৌগলিক দিক থেকে শত্রুদের কাছে রাশিয়া বরাবরই কঠিন ঠাঁই। এক তো সেদেশে সাংঘাতিক শীতের কামড়। তার ওপর দেশটাও বিরাট বড়। প্রতিপক্ষ যদি কোনোভাবে রাশিয়ায় ঢুকেও পড়ে সেক্ষেত্রে শস্যে আগুন লাগিয়ে ক্রমে পিছিয়ে যেতে থাকে লালফৌজ। ক্রমে রশদ ফুরিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে শত্রুরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকেই এই কৌশল কাজে লাগিয়েছে মস্কো। আর ওই কারণেই ইউক্রেনের গুরুত্ব তাদের কাছে অপরিসীম। মার্কিন নেতৃত্বে ওই সামরিক জোটে ইউক্রেন একবার যোগ দিয়ে দিলেই রাশিয়ার সীমান্তের একেবারে গায়ের কাছে এসে পড়বে বিরোধী শিবির। তাই প্রতিরক্ষার কৌশলগত কারণেই ইউক্রেন দখল করে পূর্ব ইউরোপ ও নিজেদের মধ্যে একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করতে চাইছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ওই কারণেই যেনতেন প্রকারেণ ইউক্রেনকে দখলে রাখতে চায় রাশিয়া।
ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো হয়েছে প্রায় ১ লাখ রুশ সেনা
ইউক্রেনের সীমান্তে ১ লাখ সেনা জড়ো করেছে রাশিয়া। তবে এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পুতিনকে চাপে রেখে চলেছে আমেরিকা। কয়েক দিন আগেই যুদ্ধ হলে দুনিয়া বদলে যাবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবু যদি শেষ পর্যন্ত রাশিয়া হামলা চালায়, তাহলে কিন্তু তাদের উপরে কেবল আমেরিকাই নয়, ইউরোপের বহু দেশই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। যার প্রভাব পড়বে বহু দেশের অর্থনীতির উপরে। ওই তালিকায় রয়েছে ভারতও। ইতিমধ্যেই বিশ্ববাজারে ওঠাপড়া শুরু হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হয়ে রয়েছেন। অপরিশোধিত তেলের দামও বাড়বে বলেই ধারণা। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়তে পারে ভারতের বাজারেও। তবে সবটাই যে খারাপ হবে তা নয়। বিশ্বের গম রফতানির ৩০ শতাংশই করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। যুদ্ধ লেগে গেলে কিংবা রাশিয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা ভারতের গম রফতানির বাজারকে চাঙ্গা করে দিতে পারে।
শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় সেদিকেই নজর সকলের
শেষ পর্যন্ত কী হবে সেই উত্তর এখনো জানা নেই। ওয়াকিবহাল মহলের চোখ আটকে রয়েছে রুশ-ইউক্রেন সীমান্তে। কেবলই আশঙ্কা আর সম্ভাবনার সমীকরণ ঘুরপাক খাচ্ছে। আর ক্রমেই বাড়ছে গুঞ্জন। শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের প্রার্থনা, যুদ্ধ থেকে সরে থাকুক পৃথিবী। একে তো বৈশ্বিক মহামারীর কালো ছায়া ঘিরে রেখেছে আমাদের। তার উপরে বারুদের গন্ধ? পৃথিবীর অসুখকে আর বাড়তে দিতে রাজি নন তারা। বুধবারের মস্কো-কিয়েভ বৈঠকের পরে যে সাময়িক স্বস্তি মিলেছে তাতে অবশ্য সন্দেহ নেই। সকলেই আপাতত ‘ফিঙ্গার ক্রস’ করে রেখেছেন।
সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন