বুজুর্গ উমেদ খাঁ : চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের মহানায়ক

সাইফুদ্দিন আহমেদ | Jan 29, 2022 02:38 pm
বুজুর্গ উমেদ খাঁ : চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের মহানায়ক

বুজুর্গ উমেদ খাঁ : চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের মহানায়ক - ছবি : সংগ্রহ

 

বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এবং দেশের বাণিজ্যিক ও আধ্যাত্মিক নগরী হিসেবে চট্টগ্রাম আজ সারাবিশ্বে পরিচিত। অথচ এক ব্যক্তির আগমন না হলে হয়তো এই চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হতো না। আর ওই ব্যক্তিটি হলেন মোগল সুবাদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র, চট্টগ্রাম বিজয়ের মহানায়ক বুজুর্গ উমেদ খাঁ।

বঙ্গের সুলতানদের হটিয়ে এক জটিল রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে মধ্যযুগে প্রায় শত বছর চট্টগ্রামে রাজ কায়েম হয়েছিল মগদের! ফেনী নদী থেকে সমগ্র আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত এ রাজ্যটি আমাদের কাছে সাহিত্যের ভাষায় পরিচিত 'মগের মুল্লুক' নামে। ( অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, মগ অধ্যুষিত চট্টগ্রামের তখন কী ছিল হাল!) আর এই অত্যাচারী মগদের চট্টগ্রাম থেকে হটিয়ে দেন মোগল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খাঁ।

১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই যে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের (তৎকালীন সুবা বাঙলা) অন্তর্ভুক্ত হলো, এরপর থেকে আর কখনো বাংলার প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক আওতার বাইরে যায়নি চট্টগ্রাম। মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি, স্বাধীন বাংলাদেশ যখনই যার শাসন ছিল না কেনো এই ভূখণ্ডে, চট্টগ্রাম সবসময়ই ছিল বাংলার সাথে, বাংলার প্রবেশদ্বার হিসেবে।

কিন্তু বুজুর্গ উমেদ খাঁর চট্টগ্রাম বিজয়ের আগে এই ভূমি বাংলা ছাড়াও কখনো মগ রাজা তো কখনো ত্রিপুরা রাজার করায়ত্ত হতো। শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ অত্যাচারী শাসকদের এমনভাবে বিতাড়িত করেছেন এই ভূমি থেকে যে চট্টগ্রামকে আর বাংলা থেকে আলাদা করার দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পায়নি প্রতিবেশী রাজ্যগুলো।

১.
বুজুর্গ উমেদ খাঁর বিজয়ের আগেও দুবার চট্টগ্রাম বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হলেও সে বিজয়গুলো দীর্ঘস্থায়ী ছিল না।

* ১ম বার চট্টগ্রাম বিজয়
১৩৪০ সালে ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের আমলে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম বৃহত্তর বাঙলার অধীনে আসে। চট্টগ্রামের কিংবদন্তিতুল্য বদর পীরও এই বিজয়াভিযানে সুলতানের সঙ্গী হন। ১৩৪৬ সালে এই চট্টগ্রাম দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনিতে চট্টগ্রামকে বঙ্গ সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত সুন্দর নগর হিসেবে বর্ণনা করেন।

* ২য় বার চট্টগ্রাম বিজয়
প্রায় ২০০ বছর মুসলিম শাসনামলের পর ১৫১৩ সালে চট্টগ্রাম আবার বাংলার হাতছাড়া হয়। হোসেন শাহী বংশের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহের আমলে পাশ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃক চট্টগ্রাম দখল করে নেয়া হয়।
যদিও ত্রিপুরার এই দখলদারিত্ব বেশি দিন বজায় ছিলো না। অচিরেই সুলতান আলাউদ্দিন হুসেইন শাহের পুত্র সুলতান নশরত শাহ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় (ফাতেহ) করা হয়। চট্টগ্রাম বিজয় করেই সুলতান অঞ্চলটির নাম দেন 'ফাতেয়াবাদ'। আজো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন ফাতেয়াবাদ অঞ্চলটি সুলতান নশরত শাহের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নশরত শাহের খনন করা বড় দীঘি (ওই দীঘির নামানুসারে স্থানটির নাম বড়দিঘীর পাড়) এবং সুলতান নশরত শাহ মসজিদ আজো অস্তিত্ব জারি রেখেছে স্বনামে।

সুলতান নশরত শাহ ত্রিপুরারাজ থেকে চট্টগ্রামকে বিজয় করে আনলেও এই বিজয় টেকসই ছিল না। যদিও সুলতানের মৃত্যুর পরে আরো ৫০ বছর চট্টগ্রাম বাংলার সাথে ছিল। কিন্তু নিত্যনৈমিত্তিক আরাকানরাজের সাথে চট্টগ্রামের দখল নিয়ে বাংলার সুলতানদের সংঘর্ষ লেগেই থাকত।

১৫৮১ সালে এসে আরাকানরাজ বাংলার আধিপত্য খর্ব করে চট্টগ্রামকে পুরোপুরি আরাকানের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি, বাংলার রানি চট্টগ্রাম হয়ে যায় আরাকান মগ এবং পর্তুগিজ জলদস্যুদের ( ফিরিঙ্গি ) অভয়ারণ্য! মগ- পর্তুগিজ ঐক্যজোট সমগ্র ভাটি বাঙলার জনজীবনকে বিভীষিকাময় করে তোলে। চট্টগ্রামকে ঘাঁটি করে মেঘনা নদীর উপকূলের বিস্তীর্ণ ভূভাগে জলদস্যুতা এবং লুটতরাজ চালাত এই মগ এবং হার্মাদ গোষ্ঠী।

২.
আরাকান রাজার মোগল শাহজাদাকে হত্যার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিজয়ের উপলক্ষ তৈরি হয়।
১৬৫৭ সালে মোগল সিংহাসন নিয়ে বাদশাহ শাহজাহানের চারপুত্রের মধ্যে সংঘটিত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে তার অপর ভাইয়েরা পরাজিত হন।
আওরঙ্গজেব আলমগীরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের একজন হলেন শাহজাদা সুজা। শাহজাদা সুজা ১৬৪০ সাল থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর বাংলার সুবাদার (বর্তমান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী পদমর্যাদা) ছিলেন।

ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে পরাজয়ের পর শাহজাদা সুজার লক্ষ্য ছিল নোয়াখালী থেকে জাহাজে করে সমুদ্র পথে মক্কা অথবা ইস্তাম্বুলে চলে যাবেন। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তা আর হয়ে উঠেনি। এদিকে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের বাহিনী প্রতিনিয়ত খোঁজ করছে শাহজাদা সুজার।
আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাই শাহজাদা সুজা পাশ্ববর্তী আরাকান রাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চলে যান। ১৬৬০ সালের আগস্ট মাসে এককালের পরাক্রমশালী বাঙলার সুবাদার শাহজাদা সুজার ঠাঁই হলো আরাকান রাজ্যে।

কিন্তু ছয় মাসের মাথায় শাহজাদা সুজাকে খুন করে আরাকান রাজা। শাহজাদার পরিবারের মেয়েদের করা হয় লাঞ্ছিত এবং ছেলেদের করা হয় কারারুদ্ধ। মোগল শাহজাদার এই বিয়োগান্ত সংবাদ অচিরেই পৌঁছে যায় দিল্লি বাদশাহ তথা সুজার ভাই আওরঙ্গজেব আলমগীরের কাছে।

নিজ ভাই হলেও হয়তোবা ক্ষমতার প্রশ্নে কখনোই সুজার প্রতি সহানুভূতি দেখাতেন না বাদশাহ আওরঙ্গজেব। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশী কারো হাতে ভাইয়ের খুন! এ যে তৈমুরী (মোগল) বংশের অবমর্যাদা! প্রতাপশালী বাদশাহ আওরঙ্গজেব কি করে এটা বরদাশত করবেন?

আরাকান রাজের হাতে নিজ ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে তাই নিজ মামা ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর শায়েস্তা খাঁকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান দিল্লি বাদশাহ আওরঙ্গজেব। আর সুবাদার শায়েস্তা খাঁর প্রতি আওরঙ্গজেবের প্রথম নির্দেশই ছিলো, 'মগদের শায়েস্তা করো'!
১৬৬৫ সালের শীতকাল। সুবাদার শায়েস্তা খাঁ এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী গঠন করলেন মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধারের এই মিশনে প্রধান সেনানায়ক হিসেবে যোগ দিলেন সুবাদার শায়েস্তা খাঁর সুযোগ্য পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ।

৩.
বুজুর্গ উমেদ খাঁ একজন ঠান্ডা মাথার কৌশলী সামরিক ব্যক্তিত্ব এবং দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি বুঝলেন, চট্টগ্রাম বিজয় করতে হলে সমুদ্র এবং স্থল দুই পথেই আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে। সমুদ্রপথে আক্রমণ করতে হলে দরকার নৌ ঘাঁটি। আর এই নৌ ঘাঁটি স্থাপনে যুতসই জায়গা হলো সন্দ্বীপ।

কিন্তু সন্দ্বীপে তখন দিলাওয়ার খাঁ নামক সাবেক মোগল সেনাপতির শাসন বজায় ছিল। তিনি মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ে সহায়তা করতে রাজি হননি। আর তাই বুজুর্গ উমেদ খাঁর পাঠানো নৌবাহিনী সর্বপ্রথম দিলাওয়ার খাঁকে পরাজিত করে সন্দ্বীপ দখল করে। (সন্দ্বীপের পঞ্চাশ বছরের স্বাধীন সুলতানের প্রতি সম্মান জানিয়ে দ্বীপটির প্রধান সড়কটির নাম দিলাওয়ার খাঁর নামে নামাঙ্কিত সুদীর্ঘকাল ধরে।)

বুজুর্গ উমেদ খাঁর দ্বিতীয় কৌশল ছিল পর্তুগিজ এবং মগদের মধ্যে বিবাদ বাড়িয়ে মোগলদের পক্ষে সুবিধা আদায় করা। কূটনৈতিক উপায়ে ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এই কাজেও সফল হন তিনি। আর তাই মোগলদের চট্টগ্রাম আক্রমণের সময় আরাকানদের কোনোরূপ সাহায্য করেনি পর্তুগিজরা।

১৬৬৬ সালের জানুয়ারি মাস। ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ। যাত্রাপথে বুজুর্গ উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার এক গ্রামে যাত্রাবিরতি করেন এবং একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ নির্মিত মসজিদটি আজো আছে এবং সেই গ্রামের নাম এখনো উমেদনগর হিসেবে রয়েছে!
বিশাল সৈন্যবহর সাথে থাকলেও উত্তর চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ জঙ্গল বুজুর্গ উমেদ খাঁর সামনে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তিনি সৈন্যদলকে নির্দেশনা দিলেন যে গাছ কেটে কেটে রাস্তা তৈরি করে অগ্রসর হও! মোগল সৈন্যদল দিন রাত এক করে রাস্তা তৈরি করলো চট্টগ্রাম নগরে প্রবেশের।

৪.
বুজুর্গ উমেদ খাঁর চট্টগ্রাম দুর্গ বিজয়। বাঙলা দেখলো তার সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে!
জানুয়ারির শেষদিকে এসে বুজুর্গ উমেদ খাঁর বাহিনী মূল চট্টগ্রাম নগরে এসে পৌঁছায়। এদিকে সমুদ্রপথেও মোগল বাহিনী নৌ সেনাপতি ইবনে হোসেন মনসুর খাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে নোঙর করতে সক্ষম হয়।
স্থল ও নৌ দুই বাহিনী মিলিত হয়ে ১৬৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি আক্রমণ করে আরাকানদের উপর। আরাকানদের শক্ত ঘাঁটি চাটগিছা কিল্লায় (আন্দরকিল্লা) টানা তিন দিন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় মোগল এবং মগদের। অবশেষে ২৬ জানুয়ারি পদানত হয় আরাকান বাহিনী।

১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি বিজয়ী বীরের বেশে আন্দরকিল্লা দুর্গে হেলালী নিশান উড়ান সেনাপতি উমেদ খাঁ। মোগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের নির্দেশে চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করা হয় 'ইসলামাবাদ'।

বুজুর্গ উমেদ খাঁর এমন বিজয়কে তুলনা করা যায় সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুসালেম) বিজয়ের সাথে। শত বছর ক্রুসেডারদের দখলে থাকা মুসলিম উম্মাহর প্রথম কিবলাকে দখলমুক্ত করে সুলতান আইয়ুবী যে অসাধারণ কীর্তি স্থাপন করেন, ঠিক তেমনই একশ বছর মগ আর পর্তুগিজদের দখলে থাকা বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামকেও দখলমুক্ত করে অবিস্মরণীয় এক কীর্তি স্থাপন করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ।

বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি চট্টগ্রামে যেন নতুন করেই ইসলামের আবাদ করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ। তিনি চট্টগ্রামজুড়ে অনেকগুলো মসজিদ, লাইব্রেরি, সরাইখানা স্থাপন করেন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, চন্দনপুরার হামিদিয়া তাজ মসজিদ, বটতলীর বায়তুল হামদ হাশেমী মসজিদ (চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার অন্তর্গত), মীরসরাই-এর শায়েস্তা খাঁ মসজিদ আজো বুজুর্গ উমেদ খাঁর কীর্তির জানান দেয়।

শুধু মসজিদ নির্মাণ বা ইসলামের বিকাশ সাধন করে থেমে ছিলেন না বুজুর্গ উমেদ খাঁ। তিনি ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। আর তাই বাদশাহ আওরঙ্গজেব তাকে নবাব উপাধি প্রদান করে চট্টগ্রামের শাসনভার প্রদান করেন। বুজুর্গ উমেদ খাঁ নিযুক্ত হলেন চট্টগ্রামের প্রথম মোগল ফৌজদার।

ফৌজদার হয়েই তিনি সমগ্র চট্টগ্রামকে অনন্যভাবে গড়ে তোলেন। তৈরি করেন সুদক্ষ প্রশাসন, সিস্টেমেটিক রাজস্ব ব্যবস্থা এবং সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

৫.
চট্টগ্রামের বিজয় করেই আরাম আয়েশ ভোগ করার জন্য বসে না থেকে তিনি মোগল বাহিনীসহ চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণে যাত্রা করেন মগদের পুরোপুরি চট্টগ্রাম ছাড়া করতে।

মগদের ক্রমশ চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করতে করতে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত পৌঁছান বুজুর্গ উমেদ খাঁ। কিন্তু বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় তিনি আর অগ্রসর হননি। আর চট্টগ্রাম থেকে রামু পর্যন্ত রসদ সরবরাহে কষ্ট হওয়ায় বুজুর্গ উমেদ খাঁ রামু হতে কিছুটা পিছিয়ে শঙ্খ (সাঙ্গু) নদীর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন।

মোগল বাহিনী সাঙ্গু নদীর তীরে এসে দুর্গ স্থাপন করেন এবং মোগলদের সীমানা সাঙ্গু নদ পর্যন্ত কার্যকর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরই লক্ষ্যে সাঙ্গু নদীর তীরে দুইজন সেনানায়ককে ( আধু খাঁ এবং লক্ষ্মণ সিং) এই স্থানে মোতায়েন করেন বুজুর্গ উমেদ খাঁ। এই দুই সেনানায়ক ছিলেন হাজার সৈন্যের নিয়ন্ত্রক। তাই তাদের নামানুসারে স্থানটির নাম হয় দুইহাজারী > দোহাজারী।

ফিরতি বছর চট্টগ্রাম আবার দখল করতে আরাকান থেকে হামলা চালায় মগরা। সাঙ্গু নদী ও আশেপাশের এরিয়ায় মোগলদের সাথে মগদের চারটি যুদ্ধ হয়। বুজুর্গ উমেদ খাঁ কর্তৃক নিয়োজিত মোগল সেনাপতি আধু খাঁর বীরত্বে মোগলরা সবগুলো যুদ্ধে জয়ী হয় এবং সাঙ্গু নদী পর্যন্ত মোগল সীমানা বিস্তৃত হয়। নিশ্চিত হয় চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষা।
উল্লেখ্য আধু খাঁর বীরত্বে সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রাম মোগলদের করায়ত্ত হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার 'আধু নগর' ইউনিয়ন আজো আধু খাঁর অস্তিত্বের জানায় দেয় চট্টগ্রামবাসীকে। মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ের পর দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড়ের চূড়ায় স্মারক হিসেবে একটা লোহা গেঁথে রাখেন আধু খাঁ। লোহা গেঁথে রাখা থেকে স্থানটির নামকরণ হয় লোহাগাড়া।

আরাকানের মগদের সাথে মোগল বাহিনীর সাঙ্গু নদের পাড়ে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধে অনেক মোগল সৈন্য শহীদ হন। তাদের মধ্যে ২২ জনকে রাজকীয়ভাবে দাফন করা হয় চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের বাগিচাহাট (বাগ-ই-শাহ হলো আসল নাম) নামক এলাকায়। আজো সেই কবরস্থান তার অস্তিত্ব বজায় রেখে জানান দিচ্ছে, চট্টগ্রামের মাটি তাদের রক্তেই কেনা!

৬.
চট্টগ্রাম নগর গঠনে মোগলদের ভূমিকা
মোগলরা শুধুমাত্র চট্টগ্রাম দখল করে এর সুবিধা নেয়ার জন্য আসেনি। বরং মোগলরা চট্টগ্রামকে একটা পরিপূর্ণ নগর হিসেবে গড়ে তোলে। চট্টগ্রামজুড়ে স্থাপিত অনেক মোগল স্থাপনা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও বেশ কিছু এখনো টিকে আছে।

* আসকার দিঘী! চট্টগ্রামের দ্বিতীয় মোগল ফৌজদার আসকার খাঁ কর্তৃক নির্মিত এই সুবিশাল দীঘি নগরীর কাজির দেউড়ি ও জামালখান মোড়ের মাঝে আজো টিকে রয়েছে।

* ঘাট ফরহাদ বেগ! মোগল নবাব ফরহাদ খাঁর নির্মাণ করা ঘাট।
* আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, ওয়ালী বেগ খাঁ মসজিদ, হামজা খাঁ মসজিদ, কদম মোবারক মসজিদ, হামিদিয়া তাজ মসজিদ, শেখ বাহার উল্লাহ মসজিদসহ নগরজুড়ে থাকা বেশ কিছু প্রাচীন মসজিদ মোগল আমলে মোগল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি।

এই স্থাপনাগুলো ছাড়াও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ অঞ্চলের নাম মোগল প্রভাবিত!
ক. আগ্রাবাদ। আগ্রা থেকে বুজুর্গ উমেদ খাঁর সাথে আগমনকারী মোগল ফৌজরা এই অঞ্চলে আবাদ গড়ে তোলায় নাম হয় আগ্রাবাদ।
খ. চকবাজার। মোগলদের স্থাপিত বাজার।
গ. আন্দরকিল্লা। বুজুর্গ উমেদ খাঁ চাটগিছা কিল্লার নামকরণ করেন আন্দরকিল্লা। পরে এইখানে অনেক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়।
ঘ. হাজারী লেইন, হাটহাজারী। মোগল রাজত্বের বড় একটা পদ ছিল হাজারী। সেই হাজারী পদধারী আমলাদের মাধ্যমে গড়ে উঠে এলাকা দুটি।
ঙ. ফৌজদারহাট, দেওয়ান হাট, দেওয়ান বাজার। মোগল আমলের প্রশাসক ফৌজদার এবং দেওয়ানদের নির্মাণ করা হাট বাজার।
চ. বাকলিয়া। আরবি বাকিল্লাহ অর্থ সবজিক্ষেত। সেখান থেকে নামকরণ।
ছ. পতেঙ্গা। ফতেহ গাঁ থেকে পতেঙ্গা। আরবি ফতেহ অর্থ বিজয়।
জ. নগরীর পাঁচলাইশ, হামজার বাগ, বকশীর হাট, নিজশহর (কাতালগঞ্জ), পোস্তগোলা, জামালখান, চাকতাই, বাগমনিরাম, সদরঘাট, কাপাসগোলা, মোগলটুলী, বিবিরহাট, পিলখানা, মির্জারপুল নামগুলো আজো মোগলদের ঐতিহ্যের সাক্ষী!

৭.
বুজুর্গ উমেদ খাঁর চট্টগ্রামের দুর্গ বিজয় এবং তার অধীনস্থ সেনাপতি আধু খাঁর সাঙ্গু নদের পাড় পর্যন্ত বিজয় বাংলার ইতিহাসের অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিজয়ের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

সাঙ্গু নদ পর্যন্ত একচ্ছত্র মোগল আধিপত্য পরে ধীরে ধীরে নাফ নদী পর্যন্ত প্রসারিত হয় অর্থাৎ কক্সবাজার ও বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম বিজয় এই অঞ্চলে বাঙলার আধিপত্যকে সুদৃঢ় করে তোলে। পাশ্ববর্তী আরাকান এবং ত্রিপুরাদের তুলনায় বাঙালি জাতি যে শক্তি সামর্থ্যে এগিয়ে, চট্টগ্রাম বিজয় তারই নিদর্শন।

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের হলো! আজো বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সামনেও থাকবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু একজন বুজুর্গ উমেদ খাঁ না থাকলে এই চট্টগ্রাম হয়তো আজ আরাকানের মতো (বাঙালি আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হয়েও) হয়তো বাংলাদেশের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত না। নাফ তীরের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো হয়তো ফেনী নদীর পাড় চাটগাঁইয়া শরণার্থীর ক্রন্দনে কম্পিত হতো একুশ শতকে এসে।

কিন্তু যেই বুজুর্গ উমেদ খাঁর জন্য চট্টগ্রাম স্থায়ীভাবে বাঙলার অংশ হলো, সেই উমেদ খাঁকে কি আমরা মনে রেখেছি? চট্টগ্রামজুড়ে অসংখ্য স্থাপনা বিভিন্ন রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের নামে। বিভিন্ন ব্যক্তির জন্ম, মৃত্যু দিবসও পালন হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবে। অথচ বুজুর্গ উমেদ খাঁর নামে কোনো কিছু নেই এই চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিজয়ের দিবসও পালিত হয় না এই নগরের কোথাও।

জাতি হিসেবে চট্টগ্রাম বিজয় আমাদের জন্য যতটা গৌরবের, চট্টগ্রাম বিজয়ের মহানায়ককে স্মরণে না রাখাটা কি ততটা লজ্জার না?

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us