নিজের পায়ে দাঁড়ানো
নিজের পায়ে দাঁড়ানো - ছবি : সংগ্রহ
নিজের পায়ে দাঁড়ানো, প্রবাদ কথাটিকে আমরা সাধারণভাবেই গ্রহণ করে থাকি। দুনিয়াতে এর চেয়ে কঠিনতম কাজ দ্বিতীয়টি নেই! মূলত নিজের পায়ে হাটা যতটুকু সহজ, দৌড়ানো তার চেয়েও সহজতর কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো কঠিন পরীক্ষা মানব জীবনে খুব কমই থাকে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, নতুন জাতি গঠনের প্রত্যয়ে, কবি ফররুখ আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিশুদের জন্য একটি অনুষ্ঠান করতেন। তিনি শিশুদের মনোবৃত্তিকে সুদূরপ্রসারী করতে একটি ঐতিহাসিক কবিতার চরণ পড়াতেন, সেটি হলো :
তোরা চাস’নে কিছু কারো কাছে,
খোদার মদদ ছাড়া,
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া।
তোরা নিজের পায়ে দাঁড়া।।
মূলত নিজের পায়ে দাঁড়ানো কথাটির অন্তর্নিহিত মূল্য অনেক গভীর। নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলে, প্রতিষ্ঠিত হবার মূল মন্ত্র হিসেবে কথাটি ব্যবহার করা হয়। বই পুস্তক ও উপদেশ দেবার জন্য বাক্যটি সেরা হলেও, বাস্তবতার নিরিখে এটাকে বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন। তবে যারা নিজেকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পেরেছে; অধ্যবসায়ী ও সিদ্ধান্তে কঠোর তাদের জন্য এটা দারুণ প্রভাব-সৃষ্টি কারী বাক্য।
বিষয়টি অনেকের কাছে পরিষ্কার নাও হতে পারে। সেজন্য একটি উপমার সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
ধরুন কোনো শিক্ষিত তরুণ, চাকরির পিছনে না ঘুরে, একটি মুরগির খামার দিলো। সবার কাছে বিষয়টি অনুপ্রেরণামূলক কাজ হিসেবে বিবেচিত হলো। মুরগি বড় হলো এবং বিক্রির উপযুক্ত পর্যায়ে এলো কিন্তু কোনো কারণে তার পক্ষে বাজারজাত করা সম্ভব হলো না!
তরুণের কাছে যথেষ্ট উদ্ভাবনী শক্তি আছে। সে পরিকল্পনা করল, সকল মুরগি বাজারে নিয়ে জবাই করে, কাঁচা গোশত হিসেবে বিক্রি করবে। যথারীতি বাজারে দাঁড়িয়ে মুরগি বিক্রি করার কাজও শুরু হলো। কিন্তু এভাবে বাজারে দাঁড়িয়ে মুরগি বিক্রি করতে গেলে যে, বহু ধরণের বিচিত্র বাধার মোকাবেলা করতে হবে! এসব তার দূরদর্শী চিন্তা ও উদ্ভাবনী গুণসম্পন্ন মগজেও আগে আসেনি!
প্রথম বাধা এমন জায়গা থেকে এলো, যা সে ভাবেনি! তারা হলো কসাই! বাজারের সীমাবদ্ধ গোশত ক্রেতার পরিসংখ্যান একমাত্র কসাইয়ের কাছেই আছে! এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও, মুরগি বিক্রেতার উপস্থিতির কারণে, ভাবার বিষয় হয়ে উঠেছে। কেননা, যে সব ক্রেতা ছাগলের গোশত কেনার জন্য বাজারে এসেছিল, তারা মুরগির গোশত কিছুটা সস্তা পেয়ে তা খরিদ করে নিলো। এতে করে তারা আর কসাইয়ের দোকানে যায়নি, তাদের মাথায় হাত। নতুন বিক্রেতার উপস্থিতিতে কসাই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সে কখনও বলবে না যে বাজারে কেউ মুরগির গোশত বিক্রি করতে পারবে না। তবে তারা মুরগি বিক্রেতার ব্যবসার ক্ষতি করার চিন্তা অবশ্যই করতে পারে।
নতুন উপদ্রব হিসেবে, বাজারের ঠিকাদার বলবে ‘এই জায়গা আপনার না, এখানে দাঁড়িয়ে গোশত বিক্রি করা যাবে না।' অন্য জায়গা দেখেন! অন্যত্র দাঁড়ালে কেউ আইনের দোহাই দিয়ে বলবে, ‘এখানে ব্যবসা করতে হলে লাইসেন্স লাগবে'। মোড়ল এসে জানাবে, ‘দৈনিক চাঁদা দিতে হবে’। এভাবে একজন ব্যক্তি বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকবে। বিষয়টি এমন হবে, শুরুতে ভাবার সুযোগ ছিল না কিন্তু যখনই এভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চিন্তা করল, তখনই নানা বিচিত্র বাধা সামনে হাজির হলো!
উপরোক্ত উদাহরণে অনেকেই হয়তো লেখকের সাথে একমত হবেন না কিংবা এমন উদাহরণ প্রয়োগের কারণে, তামাসাজনক মন্তব্য করতে চাইবেন! আশা করি এমনটি না হোক! হলে বুঝতে হবে, এরাই সমাজের প্রকৃত বেকুব এবং তারা কোনো দিন চেষ্টা করে দেখেননি যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কত শক্তি, সামর্থ্য ও মনোবলের দরকার!
আচ্ছা আপনার কাছে তিউনিসিয়ার ‘আদেল’-এর কথা মনে আছে কি? ২৭ বছরের টগবগে যুবক নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল! কোনো কাজ কর্ম না পেয়ে অতঃপর রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল সবজি বিক্রি করতে! কিন্তু সেখানেও ছিল পদে পদে বাধা, উৎপীড়ন আর চাঁদাবাজি! রাস্তায় দাঁড়াতে ইচ্ছুক যুবকের গ্যাঁটে টাকার আধিক্য কই? দু’মুঠো অন্ন নিজের জন্যই জোটে না। ফলে ২০১৩ সালের ১৩ মার্চের প্রত্যুষে, প্রতিবাদ স্বরূপ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেয়!
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আদেলের আত্মত্যাগকে কেন্দ্র করেই আরব দেশে শুরু হয়েছিল ‘আরব বিপ্লব’। সারা আফ্রিকার বাদশাহদের সিংহাসনে আগুন জ্বলে উঠে। বহু রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতাশালী শাসকের পতন হয়েছিল। এটা ছিল একজন যুবকের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বাধা দানের কুফল। বহু নগর আগুনে ছাই হয়েছিল, মানুষ মরেছিল অকাতরে। তাই কোনো কাজকে ছোট্ট ভাবতে নেই, কোনো ঘটনাকে তুচ্ছ ভাবতে নেই। আগুন জ্বলে উটে, একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গ থেকেই!
এটা হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানো কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পথে অন্তরায়গুলোর ক্ষুদ্র উপমা। বাস্তব-জীবনে আমরা অনেকেই অন্যের কর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করি, গুরুত্ব দিতে চাই না কিংবা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে সম্ভ্রান্ত ভাবতে ভালোবাসি। কিন্তু ভাবি না যে দৃশ্যত কাজটি ছোট হলেও, বাস্তবতার জীবন-যুদ্ধ অনেক কঠিন। দৃশ্যের অন্তরালে অনেক ঝুঁকি থাকে; আত্মসম্মানের সাথে বোঝাপড়া করা লাগে। সে সবকে পেরিয়ে, বাধার পাহাড় টপকিয়ে স্বীয় ক্ষেত্রে যে দাঁড়াতে পারে “তাকেই বলে নিজের পায়ে দাঁড়ানো।'
কর্মক্ষেত্র ছোট কিংবা বড় যেমনই হোক না কেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারা মানুষ, ‘মুসিবতে ভেঙ্গে যেতে পারে কিন্তু কখনো মচকায় না’।