তুরস্কের সামনে অনেক সমীকরণ
তুরস্কের সামনে অনেক সমীকরণ - ছবি : সংগ্রহ
তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বোঝাপড়ার মধ্যে একটি দূরত্ব যে কিছুদিন ধরে চলছে সেটি গোপন কোনো বিষয় নয়। ন্যাটো সদস্য হওয়ার পরও, তুরস্কের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ভোগের চেষ্টা অথবা স্বাধীনভাবে প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষমতাধর দেশগুলো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। রাশিয়া-চীন অক্ষের সাথেও সমান্তরাল সম্পর্ক তৈরি করেছে এরদোগানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক। ‘নব্য তুরস্কের’ পররাষ্ট্র কৌশলের এই অভিনবত্ব আফ্রোইউরেশীয় অঞ্চলে তুরস্কের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। একই সাথে দেশটির উচ্চাকাক্সক্ষার ব্যাপারে সন্দেহও তৈরি করেছে। পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী ও থিংকট্যাঙ্কগুলোর বিশ্লেষণগুলো পড়লে বিষয়টি আর অস্পষ্ট থাকে না।
তবে বৈশ্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়াজুড়ে চীন-রাশিয়া বলয়ের সাথে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের যে সর্বাত্মক সঙ্ঘাতমুখর অবস্থা তৈরি হচ্ছে, বিশেষত তাইওয়ান ইউক্রেন এবং সর্বশেষ কাজাখস্থানকে কেন্দ্র করে যে উন্নয়ন, সেটি পাশ্চাত্য বলয়কে তুরস্কের গুরুত্বের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে হিসাব-নিকাশে বাধ্য করছে। এই নতুন হিসাব-নিকাশের কিছু সঙ্কেত পাওয়া যায় আমেরিকান বলয়ের সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্তে। এসব সিদ্ধান্তের পুরোভাগে রয়েছে বৈশ্বিক পুনর্গঠন ও মেরুকরণের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের সক্রিয়তাবাদী নীতি।
ইসরাইলি নেতারা যখন ইরানের সাথে ভিয়েনা আলোচনার বিফল পরিসমাপ্তি এবং ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলার ব্যাপারে চাপ তৈরি করছিল তখন বাইডেন প্রশাসন তাতে সাড়া দেয়নি। বলা যায়, তা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে তেলআবিবকে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইস্যুটিকে অন্তরালে ঠেলে দিয়ে আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার কৌশলকেও যুক্তরাষ্ট্র্র সেভাবে সমর্থন করছে বলে মনে হয় না।
জেরুসালেমে ফিলিস্তিনের কনস্যুলেট পুনরায় খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত থেকেও যুক্তরাষ্ট্র সরে আসেনি। এমনকি গাজার উপর হামলা, পশ্চিম তীরে ক্র্যাকডাউন, নতুন করে ইহুদি বসতি নির্মাণ করে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলার বিষয়গুলো নিয়ে ওয়াশিংটনের সাড়া ছিল তাৎপর্যপূর্ণভাবে শীতল। সর্বশেষ ইসরাইলের সাইপ্রাস-গ্রিস-ইউরোপ ভূমধ্যসাগরীয় পাইপলাইন প্রকল্প থেকে আমেরিকান সমর্থন প্রত্যাহার বড় ধরনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে গ্রিক মিডিয়ায় ওয়াশিংটন পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করার জন্য ডিজাইন করা এক হাজার ৯০০ কিলোমিটার সাবসি পাইপলাইন ইস্টমেড প্রকল্পের বিষয় পুনর্বিবেচনা করেছে মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরে আঙ্কারায় প্রত্যাশা বেড়েছে। গ্রিস, সাইপ্রাস ও ইসরাইল ২০২৫ সালের মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তাদের গ্যাসক্ষেত্র থেকে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করার জন্য পাইপলাইন নির্মাণে ২০২০ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে ১০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস বহন করবে বলে আশা করা হয়েছিল। ছয় বিলিয়ন ইউরোর (৬.৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রকল্পটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সমর্থন ছিল এবং এই বছর একটি চূড়ান্ত বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলেছে যে, ওয়াশিংটন তার ফোকাস স্থানান্তরিত করায় প্রকল্পটিকে আর সমর্থন করবে না। গ্যাস এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস উভয়কেই সমর্থন করতে পারে এমন বিদ্যুতের আন্তঃসংযোগকারী প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী ।
গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পটির কার্যকারিতার জন্য মার্কিন সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তুরস্ক ওয়াশিংটনের ইউ-টার্নের রাজনৈতিক বার্তা পড়তে আগ্রহী। তুরস্ক এবং গ্রিস উভয়ের দাবিকৃত বিতর্কিত সামুদ্রিক অঞ্চলগুলোর মাধ্যমে পাইপলাইনের রুটটির তীব্র বিরোধিতা করেছিল আঙ্কারা। আর এটি ওয়াশিংটনের একটি বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে ইসরাইল তার বিশাল লেভিয়াথান এবং তামার ক্ষেত্র থেকে ইউরোপে গ্যাস রফতানি করে বিপুল আয়ের আশা করেছিল। প্রকল্পের সমর্থন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসায় এটি আর বাস্তবায়নের মুখ দেখবে বলে মনে হচ্ছে না।
এর পাশাপাশি রাশিয়ান এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের যে টানাপড়েন চলছিল তার নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে নতুন করে আঙ্কারা-ওয়াশিংটন এফ-১৬ ও এফ-৩৫ নিয়ে আলোচনা তুরস্কের সাথে পশ্চিমা বলয়ের একটি সমঝোতার আভাসই দিচ্ছে বলে মনে হয়।
তুর্কি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, তুর্কি ও মার্কিন কর্মকর্তারা এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে ওয়াশিংটনে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আকর সতর্কতার সাথে আশাবাদী যে, এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যেতে পারে। তুরস্ক এফ-৩৫ প্রোগ্রামের অংশীদার ছিল এবং শতাধিক এফ-৩৫ জেট কেনার পরিকল্পনা করেছিল। এস-৪০০ কেনার ব্যাপারে রাশিয়ার সাথে সমঝোতার পর তুরস্ক এফ-৩৫ প্রোগ্রাম থেকে বাদ পড়ে এবং এর প্রতিরক্ষা শিল্প অধিদফতর ২০২০ সাল থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হচ্ছে। তবে, তুর্কি ঠিকাদাররা এখনো পঞ্চম প্রজন্মের জেটের যন্ত্রাংশ তৈরি করছে। অন্যদিকে, এরদোগান তুরস্কের বিদ্যমান নৌবহরকে আপগ্রেড করার জন্য ৪০টি নতুন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান এবং প্রায় ৮০টি আধুনিকীকরণ কিট কেনার জন্য গত নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রস্তাব করে।
এরদোগানের প্রধান সহযোগী ইব্রাহিম কালিন ১০ জানুয়ারি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে কথা বলেছেন। আঙ্কারার এক বিবৃতি অনুসারে, বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ইস্যুগুলোর মধ্যে, ইউক্রেন সঙ্কট, কাজাখস্তানে বিক্ষোভ, সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়। আর্মেনিয়ার সাথে আলোচনা এবং আফগানিস্তান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও ইথিওপিয়ার উন্নয়ন নিয়েও কথা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কালিন জ্যাক সুলিভানকে জানিয়েছিলেন যে, ইউক্রেন সঙ্কট সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত আর তুরস্ক সম্ভাব্য সব উপায়ে অবদান রাখতে প্রস্তুত। এ ছাড়া, কালিন ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতার ‘সুরক্ষা’র গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের একটি গতিশীল সামরিক সম্পর্ক রয়েছে, বিশেষ করে দেশটিকে অ্যাটাক ড্রোন সরবরাহের ব্যাপারে।
স্পষ্টতই, সিরিয়া নীতি থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে এবং তার বাইরে সার্বভৌম অধিকার পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক মতবিরোধ সত্ত্বেও, তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইতিবাচক আলোচনার পথ অন্বেষণ করছে। আঙ্কারার অনুমান, তুরস্ক নিয়ে ওয়াশিংটনে অনেকের নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও, বাইডেন প্রশাসন বিচ্ছেদের জন্য এগোতে ইচ্ছুক নয়।
এরদোগানও আশা করছেন, তুরস্কের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি এখন পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ আঙ্কারার অবস্থান বৃহৎ-শক্তির প্রতিযোগিতার পরিণামমূলক হয়ে উঠছে। প্রকৃতপক্ষে, কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে তুরস্কের ভূমিকা, ইউক্রেন, ইরাক ও লিবিয়াতে আঙ্কারা এবং ওয়াশিংটনের স্বার্থ কাছাকাছি থাকা, রুশ ও চীনা প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার অঞ্চল সাব-সাহারান আফ্রিকায় তুরস্কের ক্রমবর্ধমান পদচিহ্ন- এ সবই দুই পক্ষের সম্পর্কের মধ্যে গেম পরিবর্তনকারী হতে পারে।
সার্বিকভাবে ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিপক্ষের সঙ্ঘাতে তুরস্ক যে অবস্থান নেয় তা যুক্তিযুক্তভাবে এখন আগের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ। তবে এম কে ভদ্রকুমারের মতো কিছু বিশ্লেষক এর উল্টো একটি দিকের প্রতিও ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ভদ্রকুমার বলছেন, তুরস্কের জন্য একটি ‘সুইং স্টেট’ হওয়ার কৌশলগত সুবিধা থাকতে পারে, কিন্তু যখন সময় কঠিন ও জটিল হয়ে যায়, তখন এর পরিণতি বিরূপ হতে পারে। তুরস্ক ১০০ বছর আগে সত্যের এমন একটি মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছিল। আজ অনুরূপ একটি অবস্থার সম্মুখীন আঙ্কারা।
আঙ্কারায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে এক বৈঠকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ২০২২ সালে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইইউ-এর পূর্ণ সদস্যপদ তুরস্কের কৌশলগত অগ্রাধিকার এবং এটি আমাদের মধ্যে অভিন্ন কুসংস্কার বা ভয়ের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার আগ্রহের প্রকাশ। এরদোগানের মতে, তুরস্ক-ইইউ সহযোগিতা অত্যাবশ্যক এবং তুরস্কের বিশেষ প্রচেষ্টা না থাকলে, সিরিয়া এবং ইউরোপ একটি ভিন্ন ল্যান্ডস্কেপের মুখোমুখি হতো।
আঙ্কারা নিশ্চিত করেছে যে, ওয়াশিংটন তুরস্কের সাথে তার সমস্যাযুক্ত সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে আগ্রহী।
সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত তুরস্কের দৈনিক সাবাহ পত্রিকার এক ভাষ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অবশেষে, এই মুহূর্তে, তুরস্ক মুখোমুখি অবস্থান নেবে রাশিয়ার। ন্যাটো জোট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি আগের চেয়ে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাটোর একটি প্রমাণিত এবং অপরিহার্য সদস্য হিসেবে, তুরস্ক উভয় পক্ষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।’
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তুরস্ক ২০২২ সালে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি মিত্র হিসেবে স্বীকৃত হতে চলেছে। এই প্রত্যাশায়, আঙ্কারা ডিসেম্বরের শেষের দিকে ওয়াশিংটনের কাছে একটি ‘যৌথ কৌশলগত প্রক্রিয়া’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছিল। তবে এরদোগানের প্রধান সমস্যা হলো তিনি কতটা পাশ্চাত্যের অ্যাজেন্ডা ধারণ করে সামনে এগোবেন এ ব্যাপারে পশ্চিমাদের আস্থার অভাব। সিরিয়া পরিস্থিতিতে তিনি নিজস্ব অবস্থান নিয়েছেন এবং ইউরেশীয় একীকরণের চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (এসসিও) তুরস্কের সদস্য হওয়ার মতো বিষয় নিয়ে ভেবেছেন। আরব প্রতিবেশীরাও তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের উচ্চাকাক্সক্ষাকে সন্দেহের চোখে দেখে।
বাস্তবে এরদোগান মনে করছেন, তুরস্ক পশ্চিম, ন্যাটো এবং রাশিয়ার কাছে অপরিহার্য। যদিও ভদ্রকুমারের মতো অনেকে মনে করেন, পশ্চিমারা তুরস্ককে ফিরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু এরদোগানকে মেনে নেবে কি না সেটি এখনো প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। এরপরও এরদোগান তার অবস্থানকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কাজাখস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া জানাতে তুরস্ক আট দিন সময় নিয়েছে। এটা অলক্ষিত হয়নি যে, রাষ্ট্রপতি কাসিম-জোমার্ত টোকায়েভ বারবার অভিযোগ করেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের চরমপন্থী এবং সন্ত্রাসীরা তার দেশে অশান্তি সৃষ্টিতে জড়িত যারা বিদেশী শক্তি দ্বারা প্রশিক্ষিত এবং যুদ্ধে কঠোর ছিল। কাজাখ কর্মকর্তারা বলেছেন, প্লটটি ‘একক উৎস থেকে’ পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু কাজাখ কর্তৃপক্ষ যে বিপুল সংখ্যক অ্যাক্টিভিস্টকে আটক করেছে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে, তাদের মধ্যে অনেক বিদেশীও রয়েছে। কাজাখ সরকার সম্ভবত তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নূর সুলতান নজরবায়েভ নিজেই সরকারের এই নীতির সমালোচনা করেছেন।
যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থার (সিএসটিও) শান্তিরক্ষা মিশন কাজাখস্তানের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে যখন সাহায্য করছিল তখন রাশিয়ান মিডিয়া আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধির খবর দিয়েছে। আর্মেনিয়া সোভিয়েত-উত্তর এই ব্লকের এখন সভাপতি। অন্য দিকে, মস্কোর প্রভাবশালী দৈনিক কমারসান্ট রিপোর্ট করেছে, কাজাখস্তানে সিএসটিও মিশন তুর্কি এবং আজারবাইজানী মিডিয়া আউটলেটগুলোতে সক্রিয়ভাবে সমালোচিত হয়েছিল, যদিও অফিসিয়ালভাবে কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়নি।
কাজাখস্তানে বিস্ফোরণের প্রাক্কালে এরদোগান তার রাশিয়ান প্রতিপক্ষ ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ২০২২ সালের প্রথম টেলিফোন কথোপকথন করেন। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কাছে দেয়া রাশিয়ার নিরাপত্তা গ্যারান্টি সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর দুই দিন পরে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু তার মার্কিন প্রতিপক্ষ অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সাথে আলোচনা করেন যেখানে, তুর্কি বক্তব্য অনুসারে, মূল বিষয় ছিল ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এবং ন্যাটোর মধ্যে উত্তেজনার বিষয়টি।
ব্লিঙ্কেন নিজেই এ বিষয়ে টুইট করেছেন, ‘তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ‘ভালো’ আলোচনা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের মধ্যে ইউক্রেনে রুশ উত্তেজনার হুমকির বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় অব্যাহত রয়েছে এবং আলাদাভাবে, দ্বিপাক্ষিকভাবে ন্যাটোর মিত্র হিসেবে সহযোগিতাকে আরো গভীর করতে কাজ হচ্ছে।’
এর পর ৬ জানুয়ারি, মেভলুত কাভুসোগলু রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথেও কথা বলেছেন। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, দুজন ন্যাটো-রাশিয়া কাউন্সিলের বৈঠক এবং কাজাখস্তান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা আর ককেশাসের বর্তমান উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সাবাহ পত্রিকার এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে- ‘সম্ভবত নতুন বছরে যে দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের পদক্ষেপ চলমান রয়েছে তারাই নয় বরং ন্যাটো আর ইইউও তুরস্কের দরজায় কড়া নাড়বে; ২০২২ সালে, যেমনটি রাশিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে।’
ভদ্রকুমারের মন্তব্য হলো- ‘খরগোশের সাথে দৌড়ানো এবং গ্রে হাউন্ডের সাথে শিকার করা উত্তেজনাপূর্ণ আর এটি করা স্মার্ট কিছু বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একশ’ বছর আগে উসমানীয় তুরস্ককে একটি ভারী মূল্য দিতে হয়েছিল। কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার উপর জার্মানির আক্রমণকে সহায়তা করার সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় হাজার হাজার অটোম্যান নাগরিককে, তুর্কি সাম্রাজ্য ও ইসলামী খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটে।’
এই মন্তব্যে তার ইঙ্গিত হলো- ন্যাটোর সাথে সম্পর্ক বাড়াতে গিয়ে রাশিয়ার সর্বাত্মক শত্রুতা আঙ্কারার জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এমনকি একেক সময় একেক দিকে খেলতে গিয়ে সব পক্ষের আস্থা হারানো বা শত্রুতার সম্মুখীন হতে হয় কি না সেটিও দেখার একটি বিষয় হতে পারে। প্রথম মহাযুদ্ধের এরকম একটি বৈরী সময়ে ১০০ বছর আগে তুর্কি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্র ইইউ’র সাথে এই সমঝোতা কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বাধীন তুরস্কের সাথে সমঝোতা, নাকি এরদোগানকে বাদ দিয়ে তুরস্কের সাথে সমঝোতা? তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া ও আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে বর্তমান যে পর্যায়ে এসেছে তার পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে এরদোগানের। ২০০২ সালে তিনি তুরস্কের নেতৃত্বে আসার পর দেশটির কৌশলগত লক্ষ্য ও কর্মপন্থার মধ্যে অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়। এই পরিবর্তনের নানা বাঁকে তুরস্কে শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে গেজি পার্কের অভ্যুত্থান আর ২০১৬ সালে সেনা অভ্যুত্থান ছিল দু’টি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। এই দুই প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পর এখন ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন হতে পারে এ ব্যাপারে পরবর্তী লক্ষ্য। এ জন্য আর্থিক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টির মতো কিছু পদক্ষেপ এর মধ্যে শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ইস্যুতে প্রাথমিক সাফল্য দেখা গেলেও চূড়ান্তভাবে কোনো কিছু কার্যকর ফল আনবে অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে এরদোগানের পতন ঘটানো সম্ভব হবে, এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এরদোগানের নেতৃত্ব তুরস্কের গভীর ক্ষমতাবলয় ও ভাবনা জগতের এক ধরনের প্যারাডাইম শিফট বা বাঁক বদল ঘটেছে, যার সাথে দেশটির এখনকার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা কেন্দ্রের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এরদোগান বা একে পার্টিকে বিদায় করার অর্থ হলো, তুরস্ককে পাশ্চাত্য বা ন্যাটোর একান্ত অনুগত মিত্রে পরিণত করা, যেখানে পাশ্চাত্যের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের টুলস হওয়া ছাড়া বাড়তি কোনো ভূমিকা থাকবে না আঙ্কারার। তুরস্কের ডিপ স্টেট এই সময়ে সে ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের পথে যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর সেটি যদি না হয় তাহলে ইউরোপ আমেরিকাকে এরদোগানের নেতৃত্বাধীন তুরস্কের সাথেই কৌশলগত সমঝোতা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কিছু পদক্ষেপ দেখলে মনে হতে পারে, এমন একটি পরিস্থিতির দিকে বাইডেন প্রশাসন ও তার মিত্র শক্তিগুলো এগোচ্ছে। বিশেষভাবে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনে হচ্ছে। যদিও ফ্রান্স একটি আলাদা নীতি নিতে পারে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীন-রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করে নিজস্ব নিরাপত্তাবলয় নির্মাণের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন।
তুরস্ক তার নিজস্ব যোগ্যতা বলে এমন এক আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যার সাথে বৈশ্বিক শক্তির সমঝোতা একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রভাববলয় বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন। এক সময় দেশটিকে ন্যাটো বা পাশ্চাত্য তাদের নীতি বাস্তবায়নে একান্ত টুলস হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এখন আঙ্কারা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব নিরাপত্তা ও অগ্রগতির ব্যাপারে স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে চাইছে। এই অবস্থানের অংশ হিসেবে চীন-রাশিয়ার সাথে এক ধরনের সম্পর্ক নির্মাণ করেছে। চারপাশের দেশগুলোর সাথে বৈরিতাকে কমিয়ে এনেছে।
২০২৩ সালের নির্বাচন এরদোগান ও একেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, পরবর্তী পাঁচ বছর হলো এমন সময় যখন আঙ্কারাকে তার কৌশলগত প্রস্তুতি শেষে সামনে এগোনোর একটি বড় পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু সঙ্কট হলো, এই সময়ে চীন-রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবলয়ের সাথে স্নায়ুযুদ্ধ সিদ্ধান্তকারী একটি পর্বে প্রবেশ করবে যেখানে সমান্তরাল সম্পর্ক বা ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হতে পারে। এখন দেখতে হবে, এই চ্যালেঞ্জ এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্ক অতিক্রম করতে পারে কি না।
mrkmmb@gmail.com