আগামী ৫ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এরদোগানের জন্য। কেন?
এরদোগান - ছবি : সংগ্রহ
সাবাহ পত্রিকার এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে- ‘সম্ভবত নতুন বছরে যে দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের পদক্ষেপ চলমান রয়েছে তারাই নয় বরং ন্যাটো আর ইইউও তুরস্কের দরজায় কড়া নাড়বে; ২০২২ সালে, যেমনটি রাশিয়ার ক্ষেত্রে হয়েছে।’
ভদ্রকুমারের মন্তব্য হলো- ‘খরগোশের সাথে দৌড়ানো এবং গ্রে হাউন্ডের সাথে শিকার করা উত্তেজনাপূর্ণ আর এটি করা স্মার্ট কিছু বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একশ’ বছর আগে উসমানীয় তুরস্ককে একটি ভারী মূল্য দিতে হয়েছিল। কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার উপর জার্মানির আক্রমণকে সহায়তা করার সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় হাজার হাজার অটোম্যান নাগরিককে, তুর্কি সাম্রাজ্য ও ইসলামী খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটে।’
এই মন্তব্যে তার ইঙ্গিত হলো- ন্যাটোর সাথে সম্পর্ক বাড়াতে গিয়ে রাশিয়ার সর্বাত্মক শত্রুতা আঙ্কারার জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এমনকি একেক সময় একেক দিকে খেলতে গিয়ে সব পক্ষের আস্থা হারানো বা শত্রুতার সম্মুখীন হতে হয় কি না সেটিও দেখার একটি বিষয় হতে পারে। প্রথম মহাযুদ্ধের এরকম একটি বৈরী সময়ে ১০০ বছর আগে তুর্কি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্র ইইউ’র সাথে এই সমঝোতা কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বাধীন তুরস্কের সাথে সমঝোতা, নাকি এরদোগানকে বাদ দিয়ে তুরস্কের সাথে সমঝোতা? তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া ও আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে বর্তমান যে পর্যায়ে এসেছে তার পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে এরদোগানের। ২০০২ সালে তিনি তুরস্কের নেতৃত্বে আসার পর দেশটির কৌশলগত লক্ষ্য ও কর্মপন্থার মধ্যে অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়। এই পরিবর্তনের নানা বাঁকে তুরস্কে শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে গেজি পার্কের অভ্যুত্থান আর ২০১৬ সালে সেনা অভ্যুত্থান ছিল দু’টি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। এই দুই প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পর এখন ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন হতে পারে এ ব্যাপারে পরবর্তী লক্ষ্য। এ জন্য আর্থিক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টির মতো কিছু পদক্ষেপ এর মধ্যে শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ইস্যুতে প্রাথমিক সাফল্য দেখা গেলেও চূড়ান্তভাবে কোনো কিছু কার্যকর ফল আনবে অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে এরদোগানের পতন ঘটানো সম্ভব হবে, এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এরদোগানের নেতৃত্ব তুরস্কের গভীর ক্ষমতাবলয় ও ভাবনা জগতের এক ধরনের প্যারাডাইম শিফট বা বাঁক বদল ঘটেছে, যার সাথে দেশটির এখনকার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা কেন্দ্রের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এরদোগান বা একে পার্টিকে বিদায় করার অর্থ হলো, তুরস্ককে পাশ্চাত্য বা ন্যাটোর একান্ত অনুগত মিত্রে পরিণত করা, যেখানে পাশ্চাত্যের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের টুলস হওয়া ছাড়া বাড়তি কোনো ভূমিকা থাকবে না আঙ্কারার। তুরস্কের ডিপ স্টেট এই সময়ে সে ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের পথে যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর সেটি যদি না হয় তাহলে ইউরোপ আমেরিকাকে এরদোগানের নেতৃত্বাধীন তুরস্কের সাথেই কৌশলগত সমঝোতা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কিছু পদক্ষেপ দেখলে মনে হতে পারে, এমন একটি পরিস্থিতির দিকে বাইডেন প্রশাসন ও তার মিত্র শক্তিগুলো এগোচ্ছে। বিশেষভাবে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনে হচ্ছে। যদিও ফ্রান্স একটি আলাদা নীতি নিতে পারে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীন-রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করে নিজস্ব নিরাপত্তাবলয় নির্মাণের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন।
তুরস্ক তার নিজস্ব যোগ্যতা বলে এমন এক আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যার সাথে বৈশ্বিক শক্তির সমঝোতা একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রভাববলয় বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন। এক সময় দেশটিকে ন্যাটো বা পাশ্চাত্য তাদের নীতি বাস্তবায়নে একান্ত টুলস হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এখন আঙ্কারা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব নিরাপত্তা ও অগ্রগতির ব্যাপারে স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে চাইছে। এই অবস্থানের অংশ হিসেবে চীন-রাশিয়ার সাথে এক ধরনের সম্পর্ক নির্মাণ করেছে। চারপাশের দেশগুলোর সাথে বৈরিতাকে কমিয়ে এনেছে।
২০২৩ সালের নির্বাচন এরদোগান ও একেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, পরবর্তী পাঁচ বছর হলো এমন সময় যখন আঙ্কারাকে তার কৌশলগত প্রস্তুতি শেষে সামনে এগোনোর একটি বড় পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু সঙ্কট হলো, এই সময়ে চীন-রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবলয়ের সাথে স্নায়ুযুদ্ধ সিদ্ধান্তকারী একটি পর্বে প্রবেশ করবে যেখানে সমান্তরাল সম্পর্ক বা ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হতে পারে। এখন দেখতে হবে, এই চ্যালেঞ্জ এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্ক অতিক্রম করতে পারে কি না।
mrkmmb@gmail.com