করোনা ভাইরাস কি ল্যাবে তৈরি?

মোহাম্মদ শামছুল আলম | Jan 18, 2022 02:58 pm
করোনা ভাইরাস কি ল্যাবে তৈরি?

করোনা ভাইরাস কি ল্যাবে তৈরি? - ছবি : সংগ্রহ

 

এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত যে প্রশ্নটি অমীমাংসিত রয়েছে তা হচ্ছেÑ সার্স কোভিড-২ ভাইরাসটির মূল উৎপত্তি। দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, জোরালো কোনো প্রমাণ ছাড়াই পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় বৈজ্ঞানিক মহল প্রথম থেকেই সার্স কোভিড-২ ভাইরাসটিকে প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত বলে প্রচার করে আসছিল। কোনো প্রমাণ ছাড়াই সার্স কোভিড-২ ছড়িয়ে পড়ার তিন-চার মাসের মধ্যেই অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ মাসে একদল বিজ্ঞানী তড়িঘড়ি করে ‘দ্য লেনচেট’ জার্নালে সার্স-কোভিড-২ ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত তত্ত্বকে জোর দিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, যেসব বিজ্ঞানী করোনাভাইরাসকে পরীক্ষাগার থেকে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনার আশঙ্কা করেছিলেন তাদের অজ্ঞ এবং তাদের সন্দেহকে কন্সপিরেসি থিউরি বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বকে কন্সপিরেসি থিউরি বলাটা সমীচীন নয়। বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বকে প্রমাণ দিয়েই ভুল বা সঠিক নির্ণয় করতে হয়। তাই প্রথম থেকে প্রচার করা কন্সপিরেসি থিউরি-টিকে এখন খধন-ষবধশ (মবহবঃরপধষষু বহমরহববৎবফ/সড়ফরভরবফ) তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই দ্য লেনচেট জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলটি প্রস্তুত করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত ইকো-হেলথ অ্যালায়েন্স প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট উৎ. চবঃবৎ উধংুধশ. উৎ. চবঃবৎ উধংুধশ ২০ বছর ধরেই লোকচক্ষুর অন্তরালে ভাইরাসের মধরহ ড়ভ ভঁহপঃরড়হ (ক্ষতিকর ভাইরাস তৈরি) সংক্রান্ত গবেষণা করে আসছেন। এই উৎ. চবঃবৎ উধংুধশ করোনাভাইরাস সংক্রান্ত গবেষণার জন্য চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি প্রতিষ্ঠানের ড. জিন-লি সি’কে কন্ট্রাক্ট দেন। ড. জিন-লি সি’ মূলত বাঁদুরের করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেন যেখানে তিনি করোনাভাইরাসকে এমনভাবে রূপান্তরিত করেন যেন ওই ভাইরাস মানুষসহ অন্য কোনো প্রজাতিতে আক্রমণ করতে পারে। খধন-ষবধশ তত্ত্ব নিয়ে আশঙ্কাকারী বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, ওই ল্যাবের মাধ্যমেই উহান থেকে করোনা মহামারীর শুরু।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সার্স কোভিড-২ ভাইরাসটিকে পরীক্ষাগারে তৈরি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে?
প্রথমত, চীনেই ল্যাব থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নতুন ঘটনা নয়। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি থেকে প্রথম সার্স ভাইরাস সার্স-কোভিড-২ ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এতে মহামারী সৃষ্টি হয়নি, কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই ৯ জন ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হন এবং একজন মৃত্যুবরণ করেন। দ্রুত তদন্ত করে দেখা যায়, একজন গ্রাজ্যুয়েট স্টুডেন্ট ওই ভাইরাস নিয়ে কাজ করতে গেলে অসাবধানতাবশত ভাইরাসটি ছড়িয়ে যায়। চীন সরকার ২০০৪ সালের ২৩ এপ্রিল ওই ল্যাব বন্ধ করে দেয়।
একইভাবে, সার্স কোভিড-২ ছড়িয়ে পড়ে চীনের উহান প্রদেশ থেকে যেখানে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি নামক পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ করোনাভাইরাস গবেষণার অবস্থিত। ব্যাপারটি শুধু কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

দ্বিতীয়ত, সার্স কোভিড-২ এর প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত তত্ত্ব অনুযায়ী ভাইরাসটি বাঁদুড় থেকে পেঙ্গলীন হয়ে মানুষে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সার্স-কোভিড-২ এর পুরো জেনোমের সাথে বাঁদুড়ের জঅঞএ-১৩ করোনাভাইরাসের জেনোমের ৯৬ শতাংশ মিল রয়েছে। বাকি ৪ শতাংশ পরিবর্তনের উৎস নিশ্চিত নয়। এ ছাড়া করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার দেড় বছরেরও বেশি হয়ে গেল। প্রচুর গবেষণার পরও বাঁদুড়, পেঙ্গলীন বা অন্য কোনো প্রাণীতে মানুষে আক্রমণকারী সার্স কোভিড-২ এর খুব কাছাকাছি জেনোমের কোনো ভাইরাস পাওয়া যায়নি, যার দ্বারা অনুমাণ করা যায়, সার্স কোভিড-২ প্রাণী থেকে মানুষে প্রবেশ করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, চীনে ৮০ সহস্রাধিক বন্য ও গৃহপালিত পশু পরীক্ষা করেও কোনো প্রাণীতে সার্স কোভিড-২ পাওয়া যায়নি।

তৃতীয়ত, সার্স-কোভিড-২ এর জিনোমে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে যা থেকে ধারণা করা যায়, ভাইরাসটি ইঞ্জিনিয়ারিং করে মানুষে সংক্রমণ করার উপযোগী করা হয়েছে। সার্স কোভিড-২ ভাইরাস যে প্রোটিনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে তার নাম স্পাইক প্রোটিন। এই স্পাইক প্রোটিনে এস-১ এবং এস-২ নামক দু’টি অংশ থাকে। স্পাইক প্রোটিনটি মানুষের দেহকোষে সংযোজিত হলেই মানুষের দেহকোষে প্রবেশ করতে পারে না। তার জন্য স্পাইক প্রোটিনটি কাটার (পষবধাধমব) প্রয়োজন হয়। স্পাইক প্রোটিনটি কাটার পরেই শুধু ভাইরাসের জেনোম দেহকোষে প্রবেশ করে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে।

মানুষের দেহকোষে ঋঁৎরহ নামক এক ধরনের ঢ়ৎড়ঃবধংব বহুুসব থাকে যা কোষের কোনো প্রোটিনকে কেটে কোষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ঠিক রাখে। এখানে জেনে রাখা প্রয়োজন, ঋঁৎরহ একটি প্রোটিনের যেকোনো জায়গায় কাটতে পারে না। তার জন্য চাই চারটি অ্যামিনো এসিডের সমন্বয়ে তৈরি একটি বিশেষ সিকোয়েন্স যেটিকে ঋঁৎরহ পষবধাধমব ংরঃব বলা হয়। আশ্চর্যজনকভাবেই, সার্স কোভিড-২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের এস-১ এবং এস-২ অংশের মাঝখানে নিখুঁত ঋঁৎরহ পষবধাধমব ংরঃব পাওয়া গেছে যা করোনাভাইরাসকে অতি সহজেই ঋঁৎরহ পষবধাধমব-এর মাধ্যমে মানুষের দেহকোষে ঢুকতে সাহায্য করে।

এই ঋঁৎরহ পষবধাধমব ংরঃব-টি অন্যান্য সমগোত্রীয় কোনো করোনাভাইরাসে পাওয়া যায় না তাই ওই ভাইরাসগুলো মানুষকে এত সহজে আক্রান্ত করতে পারে না। মূলত এই ঋঁৎরহ পষবধাধমব ংরঃব-টিই করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।

এই ঋঁৎরহ পষবধাধমব ংরঃবটি নিয়ে প্রথম যিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন উনি হচ্ছেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সাবকে অধ্যাপক ড. ডেভিড ভাল্টিমোর। তিনি এটিকে নাম দেন ঝসড়শরহম মঁহ. তিনি ব্যাখ্যা করেন, যদিও এমন জিনগত পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হতে পারে কিন্তু মানুষের দেহকোষে সহজে আক্রান্তের উপযোগী ঋঁৎরহ পষবধাধমব ংরঃব-এর চারটি অ্যামিনো অ্যাসিড স্পাইক প্রোটিনের মাঝখানে নিখুঁতভাবে অবস্থানের বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা উচিত।

এসব কিছু বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বছর সার্স কোভিড-২ ভাইরাসের মূল উৎপত্তি খুঁজে পেতে তদন্ত শুরু করেছে। অনেকদিন গড়িয়ে গেলেও আশানরূপ তেমন ফলাফল পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী জটিল রাজনৈতিক মারপ্যাচ আর জানা-অজানা কারণে কিছু খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর একটি তত্ত্বকে প্রচার করে অন্যটিকে উড়িয়ে দেয়াতে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটিকে এই তদন্তে জোর দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
উত্তর যাই হোক, বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। তাহলে মানবজাতী ভবিষ্যতে সম্ভাব্য আরো ভয়াবহ মহামারী থেকে রক্ষা পাবে।

লেখক : স্টাফ সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড ইমিউনোলজিস্ট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us