যেসব রোগে উপসর্গ নাও থাকতে পারে?
যেসব রোগে উপসর্গ নাও থাকতে পারে? - ছবি : সংগ্রহ
সাধারণ জ্বর, গায়ে ব্যথার মতো উপসর্গ নিশ্চিতভাবে শারীরিক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। মানুষও সাথে সাথে চিকিৎসকের কাছে পরামর্শের জন্য ছোটেন। তবে যদি এমন হয় যে দেহে ইতিমধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে অসুখ! অথচ উপসর্গ তার এতই মৃদু যে আপনি তা বুঝতেও পারেননি? অথচ তার প্রভাব ভারী মারাত্মক। তাহলে? অতএব রোগগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। নিতে হবে আগাম ব্যবস্থাও।
হার্টের রোগ : হৃদযন্ত্রে বিবিধ সমস্যার পিছনে দায়ী থাকতে পারে প্রধানত অসংযমী জীবনযাত্রা, বয়স ও বংশগতি। চিন্তার হলো, প্রাথমিকদিকে হার্টের গণ্ডগোলের সেভাবে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
কী করবেন?
পরিবারে কমবয়সে হার্টের রোগ হওয়ার ইতিহাস থাকলে ৩০ বছর বয়স থেকেই সতর্ক হন। করাতে হবে নিয়মিত কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপের পরীক্ষা। কারণ মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং উচ্চ রক্তচাপ হার্টের সমস্যার আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে।
ডায়াবেটিস থাকলেও বেড়ে যায় হার্টের সমস্যা। তাই ৪০ বছর বয়সের পরে অতিঅবশ্যই ছয় মাস অন্তর একবার ডায়াবেটিস রয়েছে কি না জানতে টেস্ট করাতে হবে।
ডায়াবেটিস : ইনসুলিন হর্মোনটি রক্তে থাকা গ্লুকোজ বা সুগারকে কোষে কোষে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। একইসাথে কোষ যাতে ওই গ্লুকোজ কাজে লাগাতে পারে, সেই বিষয়টিও দেখে। কোনো কারণে শরীরে ইনসুলিনের অভাব দেখা দিলে বা ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে রক্তে চিনি বা শর্করার উপস্থিতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। এই সমস্যাকেই বলে ডায়াবেটিস। নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঘটে নানারকম জটিলতা, দেহের টিস্যু ও অভ্যন্তরীণ যন্ত্র ক্রমশ বিকল হতে থাকে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, স্নায়ু, কিডনির অসুখের আশঙ্কা বাড়ে। হতে পারে ডায়াবেটিক ফুট, রেটিনার সমস্যাও। ডায়াবেটিসও কিন্তু বহুদিনই লক্ষণ ছাড়া চুপচাপ শরীরে বেড়ে চলতে পারে।
কী করবেন?
বংশে ডায়াবেটিস হওয়ার ইতিহাস থাকলে প্রতি ছয় মাস অন্তর করান ডায়াবেটিসের চেকআপ। ৪০ বছর বয়স পেরলে প্রতি ৬ মাস অন্তর ব্লাড গ্লুকোজ চেকআপ করাতেই হবে।
রক্তে সুগারের স্বাভাবিক মাত্রা
কারো ডায়াবেটিস হয়েছে কি না জানতে মোটামুটি তিনটি পরীক্ষা করাতেই হবে—
• ফাস্টিং সুগার : ৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর, রক্ত পরীক্ষায় প্রতি ডেসিলিটার রক্তে সুগারের মাত্রা ১২৬ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকলে ধরতে হবে ডায়াবেটিস আছে।
• পোস্ট প্রান্ডিয়াল সুগার : ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা বাদে রক্ত পরীক্ষায়, প্রতি ডেসিলিটার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ২০০ মিলিগ্রামের উপরে থাকলে ওই ব্যক্তির সুগার আছে বুঝতে হবে।
এইচবিএ১সি : সুগার রোগীর রক্তে সুগারের ওঠানামা জানাতে করানো হয় হিমোগ্লোবিন এ১সি (এইচবিএ১সি) পরীক্ষা। এইচবিএ১সি-এর মাত্রা ৬.৫-এর বেশি থাকলে ধরতে হবে ডায়াবেটিস রয়েছে।
গ্লকোমা : গ্লকোমা চোখের এমন একটি রোগ, যেখানে চোখের শিরা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে থাকে। মূল কারণ চোখের ভেতরের চাপ বা প্রেশার বেড়ে যাওয়া। ফলে চোখের শিরাটির ক্রমাগত ক্ষতি হতে থাকে। শেষে সেটি একেবারে শুকিয়ে যায়। গ্লকোমার ক্ষেত্রেও কোনো লক্ষণ থাকে না। যখন লক্ষণ প্রকাশ পায়, ততদিনে রোগ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সাধারণত ক্ষীণ দৃষ্টি, জোরালো আলোয় চোখে ধাঁধা লাগা, আলোর উৎসের চারপাশে রামধনুর রং দেখতে পাওয়ার মতো সমস্যা হল গ্লকোমার লক্ষণ।।
কী করবেন?
নিয়মিত শরীরচর্চা, রক্তচাপ এবং সুগার ও থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। প্রতি বছর গ্লকোমার চেকআপ জরুরি। বিশেষত চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তি যার পরিবারে গ্লকোমার রোগী আছে বা যারা স্টেরয়েড নিয়ে থাকেন বা মায়োপিয়া আছে, তাদের অবশ্যই প্রতিবছর গ্লকোমার পরীক্ষা করাতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ : প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপ হয় ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কারো ব্লাড প্রেশার রিডিং বেশ কয়েকদিন ধরে বারবার নির্ণয় করার পরেও ১২০/৮০ বা এর চেয়েও বেশি হলে বুঝতে হবে, তিনি উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। অন্যদিকে রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ বা এর আশপাশে থাকে, তাহলে তাকে লো ব্লাড প্রেশার হিসেবে গণ্য করা হয়।
উচ্চ রক্তচাপের বিপদ—
উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে ও রোগীর হার্ট রক্ত পাম্প করতে না পারার কারণে হার্ট ফেল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিডনি নষ্ট হওয়া, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা, রেটিনায় রক্তক্ষরণ ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়ার ভয়ও থাকে।
কী করবেন?
রোজ এক্সারসাইজ করুন। খান সুষম খাদ্য। ৪০ বছর হওয়ার পর প্রতি ৩ মাস অন্তর রক্তচাপ পরীক্ষা করান।
ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস : পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে থাকলে তাকে বলা হয় ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা পালমোনারি এম্বোলিজম। পা থেকে শরীরের উপরের দিকে রক্তসঞ্চালনের প্রক্রিয়ায় সমস্যা বা রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা বেশি থাকলে, এই সমস্যা হতে পারে। সাধারণত রক্তপ্রবাহে কোনো সমস্যা দেখা না দেয়া অবধি এই ধরনের অসুখ ধরা পড়ে না।
কী করবেন?
পায়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা হওয়া ও একটানা বসে বা শুয়ে থাকার সময় পা ফোলার সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার : ইউটেরাসের মুখ বা নীচের অংশকে সার্ভিক্স বলে। এই অংশে ক্যান্সার হলে তাকে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার বলে। মূলত ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংসর্গের ফলে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) ছড়িয়ে পড়ে নারীদেহে। খুব অল্পবয়স থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শুরু করলে, একাধিক সঙ্গী থাকলে, ধূমপান করার অভ্যেস থাকলে ও মেনস্ট্রুয়েশন-এর স্বাস্থ্য বিষয়ে উদাসীন হলে, এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। সাধারণত ত্রিশোর্ধ্ব মহিলাদের মধ্যে এই রোগ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। সার্ভাইক্যাল প্যাপ স্মিয়ার টেস্টের মাধ্যমে রোগটিকে ধরা যায়। প্রাথমিক দিকে রোগ ধরা পড়লে সহজেই রোগমুক্তি ঘটে।
কী করবেন?
বিবাহিত মহিলারা প্রতি ৩ বছরে একবার প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট করান।
পিসিওএস : মহিলাদের মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম বা পিসিওএস হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই সমস্যায় রোগীর ওভারিতে বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন সংখ্যার সিস্ট বা টিউমার থাকতে পারে। এই রোগে নারীদেহে অ্যান্ড্রোজেন (পুং হর্মোন)-এর মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে অনিয়মিত মেনস্ট্রুয়েশন, দাড়ি-গোঁফের সমস্যা এমনকী সন্তানধারণেও প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে।
কী করবেন?
দৈহিক উচ্চতা অনুযায়ী শারীরিক ওজন সঠিক রাখুন। উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য খাওয়া কমান। পাতে রাখুন শাকসব্জি, ফল। নিয়মিত ৩০ মিনিট ঘাম ঝরিয়ে এক্সারসাইজ করুন।
কোলোরেক্টাল ক্যান্সার : কোলন ক্যান্সার বা কোলোরেক্টাল ক্যান্সার সহজে ধরা পড়ে না। কোলনে অস্বাভাবিক রকমের পলিপ দীর্ঘদিন ধরে থাকলে, তা থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সঠিক সময়ে ধরা পড়লে কোলন ক্যান্সারের খুব ভালো চিকিৎসা রয়েছে।
কী করবেন?
স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে থাকুন। খিদে কমে গেলে, রোজকার পায়খানার অভ্যেসে কোনও সমস্যা হলে, হজমের দীর্ঘদিনের সমস্যা হলে অতিঅবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
ফুসফুসের ক্যান্সার : ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। দূষণ, ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ। সমস্যা হলো ফুসফুসের ক্যান্সার হলেও প্রাথমিকদিকে সেভাবে কোনো লক্ষণ থাকে না।
কী করবেন?
ধূমপান ছাড়ুন। ধূমপান করার অভ্যেস থাকলে ৫৫ বছর বয়সের পর প্রতিবছর সিটি লাং স্ক্যান করান।
লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, আরটিআইআইসিএস হাসপাতাল, মুকুন্দপুর
সূত্র : বর্তমান