রাগ নিয়ন্ত্রণের সহজ উপায়

অধ্যাপক এ আর এম সাইফুদ্দিন একরাম | Jan 11, 2022 02:29 pm
রাগ নিয়ন্ত্রণের সহজ উপায়

রাগ নিয়ন্ত্রণের সহজ উপায় - ছবি : সংগ্রহ

 

অন্যান্য আবেগের মতো রাগ একটি স্বাভাবিক মানবিক আবেগ। অবশ্য পৌরাণিক কাহিনীগুলোয় দেবতাদের ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায়। গ্রিক দেবতাদের মধ্যে অ্যারিস রাগ বা ক্রোধের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অ্যারিস কখন কীভাবে কার ওপর রেগে যান, এই ভয়ে তার জন্য কোনো উপাসনালয় তৈরি হয়নি। হিন্দুদের দুর্বাশা মুনিও রাগের জন্য যথেষ্ট পরিচিত।

আমাদের আজকের প্রশ্ন, মানুষ কেন রাগে? অবশ্য এককথায় এর উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। ক্রোধান্বিত হওয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাবিধ কারণ রয়েছে। আনন্দ-বেদনা-হতাশার মতো নিত্যনৈমিত্তিক আবেগের কথা যদি বলি, তাহলে ক্রোধ বা রাগও তেমন একটি আবেগ। কোনো ঘটনায় আমরা যেমন খুশি কিংবা মনোক্ষুণ্ন হই, তেমনি কোনো কোনো ঘটনায় রাগান্বিত হই।

একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত রাগ মেনে নেয়া গেলেও, মাত্রাবিহীন রাগারাগি কারো কাম্য নয়। অতিরিক্ত ক্রোধ স্বাস্থ্যহানিকর। এখন কীভাবে বুঝব, রাগের মাত্রা সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছেন কিংবা তা অস্বাস্থ্যকর?
এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। ক্রোধের কারণে বন্ধু-বান্ধব যদি আপনাকে এড়িয়ে চলে, চাকরি-বাকরি বিপন্ন হয় কিংবা আশপাশের মানুষ যদি আপনাকে রাগী হিসেবে ভয় পেতে শুরু করে, তাহলে বুঝতে হবে, আপনার ক্রোধের আগুন বশে আনা দরকার। কারণ, অতি ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

রাগারাগি করা কি শুধুই স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া? নাকি এর পেছনে বংশগত কোনো কারণ রয়েছে? বিজ্ঞানীরা এখনো ক্রোধের জন্য দায়ী কোনো জিন শনাক্ত কিংবা চিহ্নিত করেননি। তবে অনেকের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। এটিকে অনেকে ‘অকস্মাৎ ক্রোধ বিস্ফোরণ’ নামে উল্লেখ করে থাকেন। এ ধরনের প্রচণ্ড রাগের প্রকাশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আশপাশের মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন; এমনকি অন্যদের ওপর শারীরিক আক্রমণও করতে পারেন। এটিকে রোগ হিসেবে গণ্য করলেও এর কোনো কারণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি দুজন ব্যক্তির মধ্যে একজন রেগে যান; অথচ অপরজন কেন ক্রোধান্বিত হন না? অন্যান্য সাধারণ অনুভূতির মতো এখানে একই ঘটনা ঘটে। একটি ঘটনা কার মনে কী রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সেটাই রেগে যাওয়া কিংবা না যাওয়ার নিয়ামক। ক্রোধান্বিত ব্যক্তি কি অন্যদের জন্য বিপজ্জনক? কিংবা এটি কি পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট করে? অবশ্যই ক্রোধান্বিত ব্যক্তি অপরের জন্য বিপজ্জনক হতে পারেন এবং ক্রোধান্বিত ব্যক্তির সাথে অন্যদের সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়।

আজকাল যত নারী কিংবা শিশু নির্যাতনের ঘটনা আমরা দেখতে পাই, এর বেশির ভাগের মূলেই রয়েছে ক্রোধ কিংবা রাগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ক্রোধ কিংবা আক্রোশ পুরুষের। অবশ্য কখনো কখনো মহিলাদের চণ্ডমূর্তি দেখা যায়। সব সময় ক্রোধে ফুঁসতে থাকা ব্যক্তির সাথে অন্যদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কারণ রাগী ব্যক্তির সামনে কেউ মুখ খোলে না, কিংবা যুক্তিতর্কে লিপ্ত হতে চায় না। এটা পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক নয়। রাগ ও ক্রোধ মাত্রাভেদে অনেকের শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। অল্প অল্প রাগারাগিতে হয়তো কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু অতিরিক্ত রেগে গেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।

যাদের হৃদযন্ত্র দুর্বল, তাদের হার্ট অ্যাটাক কিংবা অনেক সময় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ হয়ে পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক হয়ে যায়। এর ফলে মৃত্যু ঘটাও বিচিত্র নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রেগে গেলে কীভাবে আমরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? এর কোনো সহজ সমাধান নেই। আপনাকে রাগের মাথায় উত্তেজনাবশত কিছু না করে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। রাগের যথার্থ কারণ আছে কি না তা ভাবতে হবে এবং বিষয়টির ঠিক-বেঠিক দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। ক্রোধান্বিত মস্তিষ্কে এত কিছু ভাবা যায় না। অতএব সমাধান হচ্ছে- সময় নেয়া। মনে রাখতে হবে, আজকে আপনি রাগ করছেন, আগামীকাল আপনার রাগ থাকবে না। কিন্তু রাগের মাথায় যে মানসিক কিংবা শারীরিক আঘাত অপরকে করা হয়, সেটি কিন্তু তার পক্ষে ভুলে যাওয়া কঠিন। এ জন্য রাগের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করার পরিবর্তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে নিরিবিলি কোথাও ঘটনার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই সর্বোত্তম।

যদি এমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে রাগের প্রতিক্রিয়া কোনো ভঙ্গুর বস্তুর ওপরে প্রক্ষেপ করা যায়। যেমন- রাগ কমানোর জন্য অনেককে দেয়ালে আঘাত করতে দেখা যায়, কেউ কেউ থালা-বাসন কিংবা ফুলদানি ভাঙেন। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়াও অনেক সময় আশপাশের মানুষের জন্য ভীতি সৃষ্টি করে। এ জন্য বলা হয়, রেগে গেলে খেলতে চলে যান, দৌড়াতে পারেন কিংবা টিভি দেখতে পারেন। এ ধরনের ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে রাগ কমানো যায়।

মনে রাখতে হবে, আমাদের রেগে যাওয়া স্বাভাবিক আবেগ। রাগার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু রাগের বশে কাউকে আঘাত করার অধিকার কারো নেই। অনেক সময় না রাগার জন্য হরেক রকম কসরত করেও আমরা ক্রোধ সংবরণ করতে পারি না। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে আমরা রেগে যেতে বাধ্য হই এবং হতাশ হয়ে পড়ি। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ। রাগের কারণে হতাশা এলে ক্রোধ আরো বেড়ে যায়।
অতএব হতাশা গ্রাস করার আগেই রাগের কারণ বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকের রেগে যাওয়া একটি অভ্যাসে পরিণত হয়, বলা যায় রেগে যাওয়া একটি নেশা হয়ে যায়। রাগলে তাদের মস্তিষ্কে স্বস্তিদায়ক এন্ডোর্ফিন নিঃসরিত হয়। এ জন্য তারা রেগে যাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারেন না। কিন্তু আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, রাগের মাথায় কিছু করলে তার ফল কখনোই ভালো হয় না। অতএব রাগের আগুন বশে রাখুন।

লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us