ওমিক্রনের উপসর্গ প্রকাশ পায় ৩ দিনে!
ওমিক্রনের উপসর্গ প্রকাশ পায় ৩ দিনে! - ছবি : সংগৃহীত
শুরু হয়েছে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ। এবারে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট-এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ওমিক্রন। কত দিন থাকবে তৃতীয় ঢেউ? কী করলে দ্রুত কমবে ঢেউ-এর দাপট? জানাচ্ছেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। কলকাতার পিজি হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ যোগীরাজ রায় এবং পিজি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান এবং কোভিড টাস্ক ফোর্সের সদস্য ডাঃ সৌমিত্র ঘোষ।
ভারতে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই চার দিকে শুধু একটাই প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে যে এই তৃতীয় ঢেউ কতদিন থাকতে পারে। এখানে কিছু বিষয় একটু বলার প্রয়োজন। অনুমান করাটা জ্যোতিষশাস্ত্রর কাজ। চিকিৎসাবিজ্ঞান কিন্তু শুধুই অনুমান নির্ভর নয়। তাই এবারের ঢেউ কত দিন থাকবে সেটা এককথায় বলে দেওয়া অসম্ভব। তার আগে কয়েকটি বিষয়ের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
যেকোনো অতিমারী সমাজে কত দিন থাকতে পারে সেটা জানার ক্ষেত্রে দুটি দিক খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, ভাইরাসটা কত দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় সবাই জানে এবারের সংক্রমণের হার অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে সেই ভাইরাস কতদিন বাসা বেঁধে থাকছে। ভাইরাস মানুষের মৃত্যু ঘটালে সেটা বেশি ছড়াতে পারবে না। নিপা বা ইবোলার ক্ষেত্রে আমরা সেটা দেখেছি।
দ্বিতীয় ঢেউ থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। তাই আমাদের সবসময়েই চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। এবারের সংক্রমণের হার খুব বেশি। কিন্তু দেখতে হবে আগামী কয়েকদিনে আক্রান্তদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ব্যাপক হারে কমছে কি না। সেটা না হলে ততটা ভয়ের কারণ নেই। তারপর দেখতে হবে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার কতটা? সেখানে কো-মর্বিডিটি কতটা রয়েছে। ভালো কথা, এবারে মৃত্যুর হার এখনও পর্যন্ত খুবই কম। তাই আমার মতে, আগামী একমাস তৃতীয় ঢেউকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। পাশাপাশি করোনা সুরক্ষা বিধি কঠোরভাবে পালন করা উচিত।
এবারের ঢেউয়ের একটা বড় কারণ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। কিন্তু সেটা প্রমাণ করতে গেলে এখনও প্রচুর পরিমাণে তথ্যর প্রয়োজন। কেউ ওমিক্রনে আক্রান্ত কি না তা জানতে দীর্ঘ সিকোয়েন্সিং করতে হয়। রিপোর্ট আসতে সময় লাগে। তাই লড়াই করতে হলে আগামীদিনে আমাদের ল্যাবরেটরিগুলিকে আরও দ্রুত কাজ করতে হবে।
বিজ্ঞান বলছে, সংক্রমণ দ্রুত ছড়ালে অতিমারীর স্থায়িত্ব কম হবে। কিন্তু তার সব থেকে বড় সমস্যা আমাদের পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতা। এখনও সমাজের একটা বড় অংশ করোনা ভ্যাকসিন নেননি। তাই চাই কড়া অনুশাসন। দেখছি, হাসপাতালের কর্মীরা ব্যাপকহারে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাহলে চিকিৎসা কারা করবেন? পরিষেবা ব্যবস্থার গুণগত মান নেমে যাবে। তাই সাধারণ মানুষকে নিজের পাশাপাশি ডাক্তারদের কথাও ভেবে নিয়ম মেনে চলতে হবে। সবশেষে একটাই কথা বলি, অহেতুক ভয় পাবেন না। মন শক্ত করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলুন। আমরা সর্বদা আপনাদের পাশে রয়েছি।
গত বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পিছনে দায়ী ছিল মূলত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এবারে তৃতীয় ঢেউয়ের মধ্যে ডেল্টার সঙ্গে ওমিক্রনও রয়েছে। তবে সংক্রমণের হার খুব বেশি বলে, মনে করা হচ্ছে যে তৃতীয় ঢেউয়ের পিছনে ওমিক্রনের প্রভাব অনেকটাই বেশি। এটাকে ‘ডেল-মাইক্রন’ বলা যেতে পারে। তাই তৃতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করতে হলে মানুষকে করোনা সম্পর্কিত সতর্কতা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের স্থায়িত্ব ছিল চার মাস। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ওমিক্রন আমাদের দেশে এসেছে। ওখানে সংক্রমণ যত বেড়েছে ততই কড়া অনুশাসন ও লকডাউন করা হয়েছে। আমরা করোনা সতর্কতাবিধি যদি কঠোরভাবে মেনে না চলি, তাহলে কিন্তু এই ঢেউ অনেক লম্বা হতে চলেছে।
মূল কোভিডে দেখা যাচ্ছিল ৮০ শতাংশ রোগী হালকা উপসর্গ, ১৫ শতাংশ মাঝারি উপসর্গ এবং ৫ শতাংশকে আইসিইউতে রাখতে হচ্ছিল। ওমিক্রনের ক্ষেত্রে কিন্তু ফুসফুসের জটিলতা দেখা যাচ্ছে না বলে রোগীর হাসপাতালের উপরে নির্ভরতাও অনেকটাই কমেছে। তবে এক্ষেত্রে করোনা পরবর্তী সময়ে রোগীর শরীরে দীর্ঘকালীন কীরকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে সেটাও আমাদের পরবর্তী সময়ে দেখতে হবে। এখন ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উপসর্গহীন করোনা। অর্থাৎ হোম আইসোলেশনেই রোগীর চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে। অন্যদিকে ৪ শতাংশের মাঝারি উপসর্গ ও ১ শতাংশ রোগীর আইসিইউ-এর প্রয়োজন হচ্ছে। তাই অনেকেই হয়তো এবারের ঢেউকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ফলে সংক্রমণ আরও বাড়ছে। ওমিক্রনের সঙ্গে ডেল্টাও যেহেতু রয়েছে, তাই সব মিলিয়ে মানুষকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।
ওমিক্রনের ইনকিউবেশন পিরিয়ড খুবই কম। আগে সংক্রমণের পর দু-থেকে সাত দিনের মধ্যে উপসর্গ প্রকাশ পাচ্ছিল। এবারে সেটা দাঁড়িয়েছে ২ থেকে ৩ দিন! মাস্ক ছাড়া প্রকাশ্যে দু-তিন মিনিট কারো সঙ্গে কথা বলা বা সংস্পর্শে থাকলেও ওমিক্রন শরীরে প্রবেশ করছে। কারণ এবারে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন ঘটেছে। তাই ওমিক্রনের মোকাবিলায় শক্ত হাতে করোনাবিধি পালন করা, নিয়মিত অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপার মতো বিষয়গুলি খুবই জরুরি।
তাই সব শেষে প্রশ্নের উত্তর একটাই। সমাজের মানুষ একত্রিতভাবে তৃতীয় ঢেউ নিয়ে যতটা সচেতন হবেন, ততটাই তাড়াতাড়ি ঢেউ শেষ হবে। আর গুরুত্ব না দিলে, ঢেউ চলবে বেশ কয়েক মাস ধরে।
সূত্র : বর্তমান