দুটি ভ্যাকসিনে কি ওমিক্রন আটকায়?
দুটি ভ্যাকসিনে কি ওমিক্রন আটকায়? - ছবি : সংগৃহীত
ওমিক্রনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কতটা সক্ষম চলতি ভ্যাকসিন? আরো নিরাপত্তার দাওয়াই-ই বা কী? জানালেন দুই বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায় ও ডা. জ্যোতির্ময় পাল।
ওমিক্রন নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই কয়েকটা বিষয় মনে রাখতে হবে। ওমিক্রন কিন্তু ডেল্টার চেয়ে অনেকটা পৃথক। এর ট্রান্সমিশন রেট, মানে সংক্রমণ হার খুব উচ্চ। মানে, খুব দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু সংক্রমিতের অবস্থা দ্রুত অবনতি হওয়ার শঙ্কা কম। অর্থাৎ এর মারণহার কম। ওমিক্রন সাধারণত মৃদু উপসর্গযুক্ত হয়, কখনও কখনও তেমন কোনও লক্ষণও থাকে না। মানে, যাকে আমরা ‘অ্যাসিম্পটম্যাটিক’ বলি। ডেল্টার ভয়াল রূপ বেশি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রন কম মারণক্ষমতার হলেও এই ভ্যারিয়েন্ট যদি কারো শরীরে বিপুল পরিমাণে ঢুকে পড়ে, তাহলে কিন্তু তা বড় ধরনের সমস্যায় ফেলবে।
কখন দরকার ওমিক্রন টেস্ট
কোভিড হলো মানেই ওমিক্রন হলো এমন কিন্তু একেবারেই নয়। আসলে এই ভ্যারিয়েন্ট নির্ণয়ে আরটি-পিসিআর টেস্ট যথেষ্ট নয়। কারণ, আরটি-পিসিআর-এ আমরা ‘এস’ জিনটা ভালো ভাবে দেখি। কিন্তু পরীক্ষাগারে যে ভাইরাসের সাইকেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার সময় এস জিন পাওয়া যাবে না বা যে রোগীর সিটি কাউন্ট (সাইকেল থ্রেসল্ড কাউন্ট) ৩০-এর নিচে থাকবে, তখনই বুঝতে হবে এর ওমিক্রন টেস্ট জরুরি। তখন তাকে জিন সিকোয়েন্সিং করাতে হবে। সিটি কাউন্ট ৩০-৩৫-এর মধ্যে থাকলে তাদের আলাদা করে জিন সিকোয়েন্সিংয়ের প্রয়োজন নেই। একমাত্র ৩০-এর নিচে নেমে গেলে তখনই এটা করানো হবে। একটি আরটি-পিসিআর, আর একটি জিন সিকোয়েন্সিং— এই দু’টি মিলিয়ে ওমিক্রন হয়েছে কি না সেই পরীক্ষা হবে। তবে এই দুই পরীক্ষার খরচ অনেক বেশি। তাই ওমিক্রনের বাড়বাড়ন্তের সময় বিকল্প কিছু ভাবনা সরকার ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ভেবেছেন। শীঘ্রই একটি ট্র্যাডিশনাল আরটি-পিসিআর ও আর একটি ইম্পোর্টেড আরটি-পিসিআর নিয়ে আসা হবে। এই দু’টি চালু হয়ে গেলে ওমিক্রন পরীক্ষার খরচ অনেকটা কমে যাবে। ৫০০ টাকার মধ্যেই পরীক্ষাটি করা যাবে বলে আশা করা যায়। একে বলে ‘ডুয়াল আরটি-পিসিআর।’
ডেল্টা ও ওমিক্রনের ফারাক
আপাতত সারা বিশ্বে যতগুলো কেস মিলেছে, তার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, ডেল্টা ও ওমিক্রনের মধ্যে মূল ফারাক হলো, ডেল্টায় স্বাদ-গন্ধ চট করে চলে যায়। কিন্তু ওমিক্রনে তা পাওয়া যায়। ওমিক্রনে ডায়েরিয়া একটা অন্যতম উপসর্গ, ডেল্টায় ডায়েরিয়া খুব একটা দেখা যায় না। হলেও হতে পারে, কিন্তু হতেই হবে এমন নয়। ওমিক্রনে গা-হাত-পায়ে ব্যথা, গলা ব্যথা এসব উপসর্গ থাকে। কিন্তু স্বাদ-গন্ধ হারায় না। তবে এই সব উপসর্গই করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে মেলে। তাই ক্লিনিক্যালি এদের আলাদা করে চিহ্নিত করা খুব শক্ত। সুতরাং এই কঠিন নির্ণয়ের জন্যই ওমিক্রন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে জিন সিকোয়েন্সিং খুব প্রয়োজন। আপাতত যা কল্যাণী ও কিছু ক্ষেত্রে ট্রপিক্যাল মেডিক্যাল কলেজে হচ্ছে। এই পরীক্ষার সময় ও খরচ কমাতেই ডুয়াল আরটি-পিসিআর আনছে ভারত সরকার।
দুটি ভ্যাকসিনে কি ওমিক্রন আটকায়?
আমাদের যে ক’টা ভ্যাকসিন প্রচলিত, সেগুলো সবই এস জিনকে বা স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করে তৈরি। মনে রাখতে হবে, ভাইরাস তার স্পাইক প্রোটিন দিয়েই কিন্তু আশ্রয়দাতার কোষে প্রবেশ করে। সেখানে থেকে পুষ্ট হয়ে হোস্ট সেলসহ অন্যান্য কোষে আক্রমণ শুরু করে। দুটি ডোজ ভ্যাকসিন নিলে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আলফা ডেল্টা ইত্যাদি যে স্পাইক প্রোটিন আছে ভাইরাসের তাকে ব্লক করে দেওয়াই এই অ্যান্টিবডির মূল কাজ। সাধারণ ভ্যাকসিনোলজির নিয়ম মানলে দেখা যায়, এই স্পাইক প্রোটিনকে ব্লক করে দেওয়ার ফলে ভাইরাস আর কোষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে না ফলে মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয় না।
শরীরে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির ভূমিকা বুঝতে গেলে অনেকটা সকেট ও প্লাগের কথা মনে করতে হবে। সকেটের উপযুক্ত প্লাগ বা প্লাগের উপযোগী সকেট হলে তবেই যেমন ব্যবহার করা সম্ভব, তেমনই এই অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডিকেও একে অপরের পরিপূরক হতে হবে। তবেই রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। এবার এও সত্য যে এই ভ্যাকসিন যখন বাজারজাত হয়, তখন ওমিক্রন আসেইনি। ভাইরাসের প্রোটিন স্পাইকগুলো মিউটেট হতে হতেই তো নতুন নতুন ভেরিয়্যান্ট তৈরি করে, তাই এখানে বলা যায় যে, সকেটটি মানে ভাইরাসটি বদলে গিয়েছে। তাই প্লাগ মানে ভ্যাকসিন আর সেভাবে কাজ করছে না। তবে এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা আমরা অনেকেই বুঝতে চাইছি না ও অকারণে ভয় পাচ্ছি। ভাইরাসের মিউটেট হওয়া মানে কিন্তু পুরো স্পাইক প্রোটিনটিই বদলে গেল এমন একেবারেই নয়। বরং স্পাইক প্রোটিনের কিছু অংশ বদলে যায়। কিছুটা একই থাকে। ফলে ভ্যাকসিন কিন্তু সবসময়ই কিছুটা প্রতিরোধ তৈরি করবে। ফলে টিকা নেয়ার পর রোগটি হলেও তার ভয়াবহতা অনেকটা কমিয়ে দিতে সক্ষম এই টিকাই।
ওমিক্রন নিয়ে বিকল্প টিকার ভাবনা
ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে লড়ে তার ভয়াবহতা কিছুটা কমিয়ে ফেলতে পারলেও তাকে সম্পূর্ণ রুখে দিতে পারে না। তার প্রমাণ রোগীরাই। যারা এখন পর্যন্ত ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ৯০ ভাগেরই ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে অ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড ও নোভাভক্স- দেখা গিয়েছে এই দুই টিকা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত অনাক্রম্যতা তৈরি করতে পারে। এই ফলাফলকে আরও উন্নত করতে ও ওমিক্রনকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত করতে সরকার ইতিমধ্যেই বুস্টার ডোজের কথা ঘোষণা করেছে। এই ভ্যাকসিন তারাই পাবেন, যাদের দুটি ভ্যাকসিন নেওয়ার ন’মাস পেরিয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে বেছে নেয়া হয়েছে ষাটোর্ধ্ব, সঙ্গে কো-মর্বিডিটি আছে- এমন মানুষদের। হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, ক্রনিক সিওপিডি, অ্যাজমা রয়েছে এমন বয়স্ক লোকদের দ্রুত এই বুস্টার ডোজ নিতে হবে। তবেই ওমিক্রনের বিরুদ্ধে লড়াই সহজ হয়ে উঠবে।
সূত্র : বর্তমান