দীর্ঘ সময় ধরে বোতলে পানি ভরে রাখলে হতে পারে ভয়াবহ বিপদ
দীর্ঘ সময় ধরে বোতলে পানি ভরে রাখলে হতে পারে ভয়াবহ বিপদ - ছবি : সংগৃহীত
পানির আরেক নাম জীবন কিন্তু জানেন কি ভুল ভাবে পানি খেলে বাঁধতে পারে বিপত্তি। কোন পাত্র থেকে পানি খাবেন, কিভাবে খাবেন, কখন খাবেন- সব কিছুই ঠিকঠাক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সঠিক ভাবে পানি না পান করলে, পানি পানের সব উপকারিতা আমরা নাও পেতে পারি। দীর্ঘক্ষণ রেখে দেয়া পানি পান করলে অনেক সময় অনুভব করা যায় তার স্বাদের পরিবর্তন। কিন্তু জানেন কি, ঘটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি উন্মুক্ত অবস্থায় রাখলে বাতাসের কার্বন-ডাইঅক্সাইড মিশতে শুরু করে পানিতে। ফলে পরিবর্তন ঘটে পানির অম্লত্বের। তবে তার মানে এই নয় যে এই পানি খাওয়া নিরাপদ নয়।
কিন্তু পানি ঢেকে না রাখলে মানুষের অগোচরেই পানিতে মিশতে পারে নানা জীবাণু। যা থেকে শরীর খারাপ হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। অনেকেই আবার প্লাস্টিক বোতলে পানি পান করেন। এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের তৈরি বোতলে দিনের-পর-দিন পানি পান করলে তাতে বৃদ্ধি পায় শরীরে ক্যানসার তৈরি হওয়ার আশঙ্কা। আবার একই বোতল থেকে মুখ লাগিয়ে একাধিক মানুষ পানি পান করলে মুখের লালা ও মিউকাসে মিশে থাকা অজস্র ব্যাকটিরিয়াও পানিতে মিশে যায়। ফলে এক জন কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে অন্য জনের মধ্যেও তা ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তা হলে পানি খাওয়ার সঠিক পন্থাটি কী? যখনই সম্ভব হবে পরিশুদ্ধ পানি খাওয়ার চেষ্টা করুন। বরফ, বিশেষ করে দোকান-বাজারে যা ব্যবহার করা হয়, তা পানিতে মিশিয়ে না খাওয়াই ভালো। রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের শরবত বিক্রি হয়, তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই ধরনের পানীয় অত্যন্ত উপযোগী হলেও রোজ রোজ এই ধরনের পানীয় খাওয়া ঠিক নয়। এতে অপরিশোধিত পানি থাকে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু যা একাধিক ভয়ানক রোগ ডেকে আনতে পারে। যারা বোতল থেকে পানি পান করেন, তারা চেষ্টা করুন সম্ভব হলে গ্লাসে ঢেলে পানি পান করতে। একই সঙ্গে বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি না খাওয়াই ভালো। দীর্ঘ দিন ধরে বোতলে রয়ে গিয়েছে, এমন পানি পান করবেন না।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
হরমোনের রোগবালাই
অধ্যাপক ডা: এম এ জলিল আনসারী
দেহের কার্যাবলি ঠিক রাখার জন্য অনেকগুলো গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড কাজ করে। এগুলো হরমোন নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে। এদের মধ্যে জীবনরক্ষাকারী গ্রন্থি নামে পরিচিত অ্যাডরেনাল গ্রন্থি। কারণ শারীরিক অথবা মানসিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হলে এই গ্রন্থিনিঃসৃত হরমোনই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। মজার ব্যাপার হলো এ গ্রন্থি এত জটিল কাজ করলেও আকারে কিন্তু বেশ ছোট। কিডনির ওপরে এরা টুপির মতো অবস্থান করে। ছোট হলে কি হবে এ গ্রন্থির বাইরের অংশ তিন শতাধিক হরমোন নিঃসরণ করে। এদেরকে একত্রে স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন বলা হয়। স্টেরয়েডের কথা মোটামুটি সবারই জানা। মাঝে মাঝে ক্রীড়াবিদদের ড্রাগ টেস্ট করা হয়। অনেক ক্রীড়াবিদ তাদের নৈপুণ্য বাড়াতে ওষুধ ব্যবহার করেন। এটাও কিন্তু স্টেরয়েড। অ্যাডরেনাল গ্রন্থির ভেতরের অংশ হতে নিঃসৃত আরেক রকমের হরমোনকে ক্যাটকোলামাইন জাতীয় হরমোন বলা হয়। স্টেরয়েড ও ক্যাটকোলামাইন দুটোই শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কোনোটির অভাব হলে শরীরে বিরূপ প্রভাব পড়ে। অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডের কার্যকারিতা কমে গেলে অথবা নষ্ট হয়ে গেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। ফলে সামান্য আঘাতে অথবা সাধারণ রোগেই রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারে। আবার এ হরমোন বেশি হলেও শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে। কিন্তু এ রোগগুলো নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিন্দুমাত্র সচেতনতা দেখা যায় না।
অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডের হরমোন কমে গেলে যে রোগ হয় তাকে এডিসন্স ডিজিস বলা হয়। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়ে, রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়, শরীরের ওজন কমে যায়, রক্তচাপ কমে যায়, ত্বকে কালো অথবা সাদা দাগ বা ছাপ দেখা যায় এবং শরীরের নানাস্থানে ঘনঘন ইনফেকশন বা সংক্রমণ হতে পারে। এ রোগের উপসর্গ ততটা সুনির্দিষ্ট নয় এবং বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই রোগের লক্ষণসমূহ অনেকটা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। এ রোগ সাধারণত প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে না। তা ছাড়া প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ নির্ণয় করতে হলে যে পরীক্ষা করা প্রয়োজন তাও আমাদের দেশের সর্বত্র প্রচলিত নেই। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এ রোগ সঠিকভাকে নির্ণয় করা সম্ভব। রোগ নির্ণয় সঠিক হলে এ রোগ পুরোপুরি সরিয়ে তোলা সম্ভব।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীরে অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডের হরমোনের আধিক্য দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগীর ওজন বেড়ে যায়, মুখাবয়ব গোলাকার হয়ে ক্ষেত্রবিশেষে পূর্ণচন্দ্রাকৃতির মতো হতে পারে, ত্বক ফেটে গিয়ে লালচে দাগ হয়ে যায়, মোটা হওয়া সত্ত্বেও শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, মহিলাদের এ রোগ হলে তাদের মুখে গোফ-দাড়ি বা অতিরিক্ত চুল গজাতে পারে, মাসিক অনিয়মিত হয় এবং মহিলা ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একে বলে কুশিং সিন্ড্রোম।
অ্যাডরেনাল গ্রন্থির ভেতরের যে অংশ হতে ক্যাটকোলামাইন নামক হরমোন নির্গত হয় সে অংশে টিউমার হলে উচচ রক্তচাপ হয়ে থাকে। হাইপারটেনসন যদি এমন হয় যে সহজে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না, বারবার কমবেশি হচ্ছে, মাঝে মাঝে শরীর বেশি ঘামছে, অতিরিক্ত বুক ধড়ফড় করছে তা হলে অ্যাডরেনাল গ্রন্থির এ অংশে টিউমার হয়েছে মনে করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। তবে এ রোগের কারণে খুব কম লোকেরই উচ্চ রক্তচাপ হয়।
অনেক সময় অল্প বয়সে অর্থাৎ শিশুকালেই কারো যৌবনপ্রাপ্তির মতো শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। এটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। আবার মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক পরিবর্তন ছেলেদের মতো হয়। এমনকি মেয়েশিশু ছেলেশিশুতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার ঘটনাও কখনো শোনা যায়। এগুলো কিন্তু অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ডের হরমোনের অস্বাভাবিক নিঃসরণের জন্যই হয়ে থাকে। অজ্ঞতার কারণে অনেকের মাঝেই এই বিষয়ে বহুরকমের ভ্রান্তধারণা ও কুসংস্কার বিরাজমান।
স্টেরয়েডগুলো পরীক্ষাগারে তৈরি করা যায়। এদের সিনথেটিক স্টেরয়েড বলে। হরমোনজনিত রোগ ছাড়াও এদের বহু ব্যবহার আছে। এ ওষুধগুলো অ্যাজমা, বিভিন্ন প্রকারের বাত, নানাবিধ চর্মরোগ ও বিভিন্ন ধরণের জ্বর উপশম করে। প্রকৃত রোগ নির্ণয় না করে রোগের উপসর্গ সাময়িকভাবে কমিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অনেক হাতুড়ে চিকিৎসক অবিবেচকের মতো এ ওষুধ রোগীদের সেবনের জন্য দেয়। আবার স্থায়ী মোটা করার কথা বলে স্টেরয়েড ওষুধ দিনের পর দিন সেবন করানো হয়। ফলে একদিকে যেমন শরীর মোটা হয়ে উল্লিখিত কুশিং সিন্ড্রোমের মতো মারাত্মক অসুখের সৃষ্টি হতে পারে তেমনি শরীরের অভ্যন্তরীণ স্টেরয়েড নিঃসরণক্ষমতা কমে গিয়ে রোগী সামান্য অসুখে বা আঘাতেই মৃত্যুবরণ করতে পারে। এ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সচেতনতা।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল