যে পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন বাড়বে ১০ গুণ
মাছ - ছবি : সংগৃহীত
বিশাল কয়েকটি পুকুরের একপাশে কংক্রিটের সারি সারি ছোট চৌবাচ্চার মতো কয়েকটি সেল বা চ্যানেল, আর সেইসব চ্যানেলের ভেতর দিয়ে নদীর স্রোতধারার মতো পানির স্রোত বাইরের অংশের পুকুরের পানিতে মিশে যাচ্ছে।
সেই স্রোতেই চ্যানেলের ভেতরে সাঁতার কাটছে অসংখ্য মাছ।
'এখানে অনেকটা নদী বা মুক্ত জলাশয়ের মতো পানির স্রোত তৈরি করা হয়েছে। সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে, কৃত্রিমভাবে মাছের জন্য একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।'
বিবিসি বাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন ইন-পন্ড রেসওয়ে সিস্টেম বা আইপিআরএস হিসেবে পরিচিত মাছ চাষের সর্বাধুনিক এই প্রযুক্তির একজন বাংলাদেশী উদ্যোক্তা আকবর হোসেন। তিনি পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাব আইপিআরএস প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
'একটি সাধারণ পুকুরে যত মাছ উৎপাদন করা যায়, এই পদ্ধতিতে সেই পরিমান জায়গায় তার ১০ গুণ বেশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি ৬০০ বিঘা আয়তনের পুকুরে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়, আমাদের ৬০ বিঘার পুকুরেই সেই পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব,' বলছিলেন আকবর হোসেন।
মাত্র বছর দুয়েক হলো বাংলাদেশে এই প্রযুক্তিতে মাছের চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
আইপিআরএস প্রযুক্তি কী?
ইন-পন্ড রেসওয়ে সিস্টেম (আইপিআরএস) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত মাছ চাষের সর্বাধুনিক একটি প্রযুক্তি।
একে বলা যায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর, খাঁচা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অক্সিজেন-খাদ্যের সুষম বণ্টনের একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ ও কৌশল ব্যবহার করে স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণে মাছ চাষ করা হয়।
এই প্রযুক্তিতে বড় আকারের পুকুরে কংক্রিটের ছোট ছোট চ্যানেল তৈরি করা হয়। সেখানে কৃত্রিম স্রোত তৈরি করে অনেকটা নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয়ের মতো পরিবেশ তৈরি হয়।
প্রযুক্তিটি ব্যাখ্যা করে আকবর হোসেন বলছিলেন যে এ ধরণের প্রকল্পে পুকুরের মাঝে রেসওয়ে বা কংক্রিটের ছোট ছোট সেল তৈরি করা হয় এবং সেই সেলের ভেতরের পানিতে মাছগুলো থাকে। এসব সেল আবার বাইরের বড় পুকুরের সাথে সংযুক্ত থাকে, যদিও মাছ সেই পুকুরে বেরিয়ে যেতে পারে না। এসব পুকুর থেকে পরিষ্কার পানি সেলের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে।
তিনি বলেন, সেলের মধ্যে থাকা মাছগুলো স্রোতে ক্রমাগত সাঁতার কাটতে থাকে এবং এতে করে অনেকটা নদীর মতো পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
"নদীর মতো পরিবেশ পাওয়ার কারণে আইপিআরএস পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছের স্বাদ ও রঙ একেবারে নদীর মাছের মতোই হয়। এভাবে স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণের মাছ উৎপাদন করা যায়।''
যেভাবে কাজ করে আইপিআরএস
পুকুরের মধ্যে বানানো সেলের ভেতর নানা রকম সরঞ্জাম ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত পানির স্রোত তৈরি, প্রয়োজন অক্সিজেন প্রয়োগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা ও নিয়ন্ত্রিত পরিমানে খাবার দেয়া হয়।
এর ফলে মাছ পুকুরে থাকলেও সেগুলো অনেকটা প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়। পানিতে স্রোত থাকার কারণে মাছগুলো ক্রমাগত সাতার কাটতে থাকে। আবার পানিতে পরিমান মতো অক্সিজেন রাখতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অক্সিজেন প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া, পানির গুণাগুণ ঠিক রাখা হয় ও মাছেদের পরিমাণ মতো খাবার দেয়া হয়।
আকবর হোসেন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তারা যে আকারের সেল তৈরি করেছেন, তাতে একেকটি সেলের জন্য পাঁচ বিঘা আকারের পুকুর সংযুক্ত থাকতে হবে, যেখান থেকে পরিষ্কার পানি সেলের ভেতর যাতায়াত করবে।
এই প্রযুক্তিতে স্বল্প জায়গায় অনেক মাছ চাষ করলেও মাছের কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু উৎপাদন হয় প্রচলিত পুকুরের উৎপাদনের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ - বলছিলেন এই উদ্যোক্তা।
ওই প্রকল্পটির শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আমিনুল এহসান, যিনি বর্তমানে নওগাঁর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
ড. এহসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'আমাদের দেশে জায়গা কম, কিন্তু মানুষ বেশি। ফলে অল্প জায়গায় বেশি মাছ চাষের উৎপাদন দরকার। সেই সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে, নতুন প্রযুক্তিও ব্যবহার দরকার।'
'কিন্তু সমস্যা হলো, একটা জলাশয়ে স্বল্প জায়গায় বেশি মাছ চাষ করতে গেলে মাছের মল-মূত্র বা মাছের খাবারের কারণে পানির মান কমে যায়। মাছের স্বাস্থ্যের সমস্যা তৈরি হয়। সেটা মোকাবেলা করার জন্যই এই প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে।'
তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে যেমন চ্যানেলের ভেতর পরিষ্কার পানি ও নিয়মিতভাবে অক্সিজেন দেয়া হয়, তেমনই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত সময় পরপর চ্যানেলে মাছের খাবার সবরবাহ করা হয়।
আইপিআরএস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রকল্পের পুকুরে ২৪ ঘণ্টাই পানির প্রবাহ অব্যাহত থাকে।
সেই সঙ্গে চ্যানেলগুলোর বাইরে একটি আরেকটা লম্বা নালা থাকে, যেখানে মাছের মল, বর্জ্য বা অব্যবহৃত খাবার গিয়ে জমা হতে থাকে।
একটি সাকশন মেশিনের মাধ্যমে দুই ঘণ্টা পরপর সেসব বর্জ্য পানি থেকে তুলে আনা হয় এবং সেগুলো একটি ট্যাংকে জমা হতে থাকে। এইসব বর্জ্য আবার সবজি ক্ষেতে সার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
মাছ যেখানে থাকে, সেই চ্যানেলে সবসময় পানি প্রবাহ থাকার কারণে পানি দূষিত হয় না। চ্যানেলের সঙ্গে যে পুকুর থাকে সেখান থেকে অব্যাহতভাবে পরিষ্কার পানি চ্যানেলের ভেতর যাতায়াত করতে থাকে।
ড. আমিনুল এহসান বলছেন, 'সাধারণ নিয়ম হলো, পুকুরের মোট আয়তনের ২.৫ শতাংশ জায়গায় চ্যানেল তৈরি হবে।'
চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে খামারটি করা হয়েছে, সেখানে ২২ মিটার লম্বা, ৫ মিটার প্রশস্ত এবং আড়াই মিটার গভীরের ১৩টি চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি চ্যানেলের বিপরীতে পাঁচ বিঘার একেকটি পুকুর রয়েছে। সেখানে এক বিঘা জমিতে তৈরি করা ১৩টি চ্যানেলের জন্য রয়েছে ৬০ বিঘার পুকুর।
চ্যানেলের বাইরে যে পুকুর থাকে, সেখানে এমন সব মাছ চাষ করা হয়, যা পুকুরের উপরের স্তরের পানির খাবার খেয়ে পরিষ্কার করে রাখে। এসব মাছের মধ্যে রয়েছে সিলভার কার্প, ব্রিগেডের মতো মাছ। এছাড়া, বাকি পুকুরে অন্য কোন মাছের চাষাবাদ করা হয় না।
নবাব আইপিআরএস প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর হোসেন জানান, আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রকল্পে সার্বক্ষণিকভাবে বিদ্যুতের সরবারহ থাকতে হয়। কারণ, পানি প্রবাহ তৈরি, অক্সিজেন সরবরাহ, বর্জ্য নিষ্কাশন- সবই বিদ্যুৎ নির্ভর। এজন্য গ্রিড লাইনের বিদ্যুতের বাইরে তিনি দু'টি জেনারেটর স্থাপন করেছেন।
''বিশ মিনিট সময় যদি বিদ্যুৎ না থাকে, তাহলে মাছগুলো মারা যাবে,'' বলছিলেন মি. হোসেন।
তার প্রতিষ্ঠানের আরও কয়েকটি পুকুর রয়েছে, যেগুলোতে প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছের চাষাবাদ করা হয়। এসব পুকুরে যেখানে গড়ে মাছের মৃত্যুর হার ২০ শতাংশের মতো ধরে রাখা হয়, সেখানে আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছের মৃত্যুর হার ২ শতাংশেরও কম, জানাচ্ছেন আকবর হোসেন।
'আমাদের বিনিয়োগ, নিয়মিত খরচ ইত্যাদি হিসাব করে আমরা দেখেছি, উৎপাদন ঠিক থাকলে প্রায় তিন বছরে আমাদের সব খরচ উঠে আসবে,' আশাবাদী কণ্ঠে জানালেন তিনি।
যেভাবে বাংলাদেশে এলো আইপিআরএস প্রযুক্তি
মাছ চাষের সর্বাধুনিক এই প্রযুক্তির বাংলাদেশে ব্যবহার শুরু হয় মাত্র দুই বছর আগে থেকে- ২০১৯ সালে। চীন থেকে প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আমদানি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাব মৎস্য খামার প্রকল্প 'নবাব আইপিআরএস' নামে এই উদ্যোগটি শুরু করে।
জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২০ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামা রাজ্যে অবস্থিত অ'বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সালে প্রথম এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। দুই বছর পরে সেখানে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্যাটফিস ধরণের মাছ চাষাবাদ করা হচ্ছিল।
তবে ২০১৩-১৪ সালের দিকে চীনে এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। দেশটিতে এই পদ্ধতির আরো উন্নয়ন ঘটে।
পরে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত এবং পাকিস্তানেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু হয়।
আকবর হোসেন বলেন, 'চীনের সঙ্গে এমনিতেই আমাদের নানা ব্যবসা হতো। তাদের বললাম যে, অল্প জায়গায় বেশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব এমন কোনো প্রযুক্তি তাদের কাছে আছে কিনা?'
'বছর খানেক পরে তাদের কাছ থেকে মাছ চাষের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে জানতে পেরে আমি গিয়ে দেখে আসি। এরপর ২০১৯ সাল থেকে প্রকল্পটি শুরু করি। চীন থেকেই সব যন্ত্রপাতি আনি। সেখান থেকেই বিশেষজ্ঞরা এসে এখানে সব স্থাপন করে গেছে। আর আমাদের মাছের চাষ শুরু হয়েছে ২০২০ সাল থেকে।'
আইপিআরএস পদ্ধতির খরচ
নবাব আইপিআরএস তাদের ৬০ বিঘা জমির ১৩টি চ্যানেলের প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে আড়াই কোটি টাকার বেশি।
প্রথম দিকে ১৩টি চ্যানেলে রুই, কাতল, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া ইত্যাদি নানা জাতের মাছের চাষ করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় বছর থেকে শুধুমাত্র রুই মাছ চাষের দিকে গুরুত্বে দিতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
পরে নাটোরে আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছোট আকারে একই রকম খামার তৈরি করে মাছ চাষ শুরু করেছে।
ড. আমিনুল এহসান মনে করেন যে আইপিআরএস পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরুতে বেশ ব্যয়বহুল, ফলে সবার জন্য এই প্রযুক্তি বলা যাবে না। তবে স্বল্প জায়গায় ভালোভাবে অনেক মাছ চাষের জন্য এটি একটি আদর্শ পদ্ধতি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের প্রধান ড. ফাতেমা হক শিখা বলেন যে বাংলাদেশে অনেক নদী, খাল, বিল-উন্মুক্ত জলাশয় থাকলেও এসব থেকে মাছের উৎপাদন আগের তুলনায় কমে আসছে।
'সেসব দিক থেকে চিন্তা করলে, এ ধরণের নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের উৎপাদন যেমন বাড়াতে পারবো, আবার অনেক ঝুঁকিতে থাকা মাছের প্রজাতিও রক্ষা করতে পারবো,' বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
'আমাদের জায়গা কম, জনসংখ্যা বেশি। ফলে কীভাবে উন্নত, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম জায়গায় বেশি উৎপাদন করা যায়, সেসব প্রযুক্তির দিকে আমাদের যেতে হবে। সেসব দিক থেকে এই প্রযুক্তি আমাদের জন্য আদর্শ বলা যায়। তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই,' বলছেন ড. হক।
সূত্র : বিবিসি