নতুন স্নায়ুযুদ্ধ : ভারসাম্য অবস্থানে মুসলিম বিশ্ব

মাসুম খলিলী | Jan 04, 2022 03:37 pm
নতুন স্নায়ুযুদ্ধ

নতুন স্নায়ুযুদ্ধ - ছবি : সংগৃহীত

 

প্রশ্ন হলো নতুন যে বৈশ্বিক ও রাজনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হচ্ছে তাতে বিশেষ কী বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাবো। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের একটি হবে জাতিবাদী স্বার্থের অগ্রাধিকার প্রাপ্তি। আর দ্বিতীয়টি হবে মুসলিম বিশ্বের বিশেষ গুরুত্ব লাভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৯০-এর দশক পর্যন্ত যে স্নায়ুযুদ্ধ মার্কিন-সোভিয়েত বলয়ে ছিল তার একটি আদর্শবাদী রূপ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ছিল উদার গণতন্ত্রবাদের প্রবক্তা যার অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার ছিল মুক্তবাজার। অন্য দিকে সোভিয়েত প্রভাব বিস্তারের মূল হাতিয়ার ছিল সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদ। যার অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল কথা ছিল রাষ্ট্রীক নিয়ন্ত্রণ বা কমান্ড অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। নবপর্যায়ের এই স্নায়ুযুদ্ধে আমেরিকা এখনো উদার গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকারের প্রধান বিষয় রাখলেও রাশিয়া বা চীন কোনোটাই এখন আদর্শবাদকে তাদের পররাষ্ট্র কৌশলে রাখেনি। কমান্ড অর্থনীতি থেকে দু’টি দেশই একপ্রকার সরে এসে বাজার ও ক্ষেত্রবিশেষ মিশ্র অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছে। এখন প্রভাব বিস্তারের মূল স্বার্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতিবাদী স্বার্থ ও হিসাব নিকাশ।

নতুন এই হিসাবে এক সময়ের আমেরিকান বলয়ের অনেক দেশ এখন চীন-রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গণ্ডি পেরিয়ে তা কৌশলগত অবয়বও গ্রহণ করেছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ একাধিক দেশের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টান্ত এর মধ্যে দেখা যায়।
পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের আলাদা কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা আমরা সেভাবে দেখিনি। নতুন স্নায়ুযুদ্ধে এটি প্রবল না হলেও মোটামুটি দেখা যেতে পারে। সম্ভাব্য বৈশ্বিক মেরুকরণে আমেরিকানরা প্রতিপক্ষ চীন ও রাশিয়ার সাথে মুসলিম স্বার্থ যাতে একই সরলরেখায় না এগুতে পারে তার জন্য দু’টি দেশকেই দু’টি গভীর সমস্যায় জড়িয়ে রেখেছে। এর একটি হলো চীনের উইঘুর সমস্যা আর অপরটি রাশিয়ার ককেসাস অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতার সংগ্রাম।

এই দুই সঙ্কট ছাড়িয়েও মুসলিম দেশগুলোর সাথে চীন, রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংস্কৃতির উন্নয়ন বিবেচনায় মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইরান রাশিয়া ও চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণ করেছে। পরমাণু চুক্তি সংক্রান্ত চলমান আলোচনা ব্যর্থ হলে এই সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকবে। ইরান ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে নিজস্ব সমীকরণ গড়ে তুলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বলয়েই তেহরানের দৃঢ় অবস্থান থাকবে।

অন্য দিকে, তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য একমাত্র মুসলিম দেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশটি ইউরোপের সমকক্ষে পৌঁছানো ছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্পে সাম্প্রতিক বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে। সেই সাথে দেশটি মধ্যএশিয়া মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় বিশেষ অর্থনৈতিক ভূমিকার কারণে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। ন্যাটো সদস্য হওয়ার পর তুরস্ক একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র কৌশল অনুসরণে সচেষ্ট। যার কারণে চীন ও রাশিয়ার সাথেও তুরস্কের তৈরি হয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। দেশটির বর্তমান এরদোগান সরকারের সাথে বাইডেন প্রশাসনের সৃষ্ট দূরত্ব ও নানা ক্ষেত্রে তুর্কিবিরোধী পদক্ষেপ তুরস্ককে চীন-রাশিয়ার প্রতি আরো নিকটবর্তী করছে।

প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়্যব এরদোগানের নেতৃত্বে, তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে তার আন্তর্জাতিক অবস্থান উন্নত করতে এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থায় আরো বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করতে চায়। হার্ড পাওয়ারের ব্যবহার স্বাভাবিককরণের নীতি এবং পরিপূরক হিসাবে একই উদ্দেশ্যে কাজ করেছে। এই অর্থে, দেশটি ২০২২ সালে একটি সক্রিয় এবং উদ্যোগী বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করবে। এটি ইতোমধ্যেই নভেম্বরে তুর্কি রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা এবং গত মাসে তৃতীয় তুরস্ক-আফ্রিকা অংশীদারিত্বের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে সেই উচ্চাকাক্সক্ষার ইঙ্গিত দিয়েছে। এরদোগান ২০২১ সালে ব্যক্তিগতভাবে ১৪টি দেশ সফর করেছিলেন।

মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি সৌদি আরব মার্কিন প্রশাসনের সাথে সৃষ্ট মতভেদের কারণে চীন ও রাশিয়ার প্রতি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে। সৌদি আরবের কৌশলগত নতুন পর্যটন নগরী নিউম সিটিতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছে চীন। সৌদি আরবে এখন চীনা শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সৌদিদের বৃত্তি দিয়ে পড়ার জন্য পাঠানো হচ্ছে। সৌদি আরব চীনে বিনিয়োগও করছে নানা ক্ষেত্রে।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত কৌশলগত বন্দর নির্মাণের কাজ চীনকে দেয়ার ক্ষুব্ধ হয় ওয়াশিংটন। পরে এই কার্যাদেশ বাতিল করা হলেও চীন-রাশিয়ার সাথে আমিরাতের সম্পর্ক বেশ গভীর হয়ে উঠেছে। লিবিয়ায় রাশিয়া-আমিরাত খলিফা হাফতারের পক্ষে অভিন্ন ভূমিকা রেখেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেক জনবহুল দেশ মিসর রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র আমদানি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। সুয়েজের বিকল্প ক্যানেল খনন ও ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ বাঁধ নিয়ে ইসরাইলি উদ্যোগে ক্ষুব্ধ কায়রো রাশিয়া-চীন বলয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। গৃহসঙ্ঘাতে জর্জরিত সিরিয়া-ইয়েমেনে এমনিতে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বলয়ের গভীর প্রভাব রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে ২০২২ সালে নবপর্যায়ের যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হচ্ছে তাতে শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি বিশেষ বলয় তৈরি হতে পারে। আর এর সামনে থাকতে পারে তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো শক্তিধর দেশগুলো। আবার একই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন-রাশিয়া- দু’পক্ষের কাছে মুসলিম দেশগুলোর গুরুত্ব বাড়তে পারে। ভ্লাদিমির পুতিনের মহানবীর প্রশংসা করা আর উইঘুরে মুসলিমবিরোধী ভূমিকার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকে প্রত্যাহার করা এবং বাইডেন প্রশাসনের মুসলিমদের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরির প্রচেষ্টা এরই ইঙ্গিত বলে মনে হয়।

mrkmmb@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us