পুতিনের বক্তব্যে উচ্ছ্বসিত কোটি কোটি মুসলিম
পুতিন - ছবি : সংগ্রহ
সারা বিশ্বের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভাসছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেছেন, ‘ইসলামের নবী (মুহাম্মাদ সা.)-এর অবমাননাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলা যায় না।’ রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুযায়ী গত ২৩ ডিসেম্বর ক্রিসমাসের পূর্বে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট এ কথাগুলো বলেন। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি ইসলামের নবীর অবমাননা করে, তাহলে সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মনে করা হবে না।’
বর্তমান বিশ্বে ইসলামের নবীর অবমাননা যখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, সেই মুহূর্তে পুতিনের এমন সাহসী উচ্চারণ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি মুহূর্তেই মুসলমানদের মন জয় করে নিয়েছেন। মুসলমানরা তাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহুকে নিজেদের জীবনের চাইতে বেশি ভালোবাসেন। যে উদ্দেশ্যই ইসলামের নবীর অবমাননা করা হোক না কেন, মুসলমানরা সেটা কখনোই মেনে নিতে পারেন না। বিশ্বে সহিংসতার অন্যতম কারণ ‘নবী অবমাননা’। মুসলমানদের আবেগকে উস্কে দেওয়ার এক মোক্ষম হাতিয়ার এটি। শান্তিপূর্ণ বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টি করে ইসলামোফোবিয়ার মাধ্যমে বৈশ্বিক বিভাজনের রাজনীতির এক বিষাক্ত ছুরি এটি।
বিগত কয়েক বছর ধরে এটা অতিমারীতে পরিণত হয়েছে। এমনই এক মুহূর্তে পুতিনের বক্তব্য মুসলমানদের ক্ষতবিক্ষত অন্তরে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। তাই যারা নবীর অবমাননায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন, আজ তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভাসছেন ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন বলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আপনার আশপাশের মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের নাম। বিবিসি জানাচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পুতিনের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটা আমার বার্তার প্রতিধ্বনি যে, নবী সা.কে অবমাননা করা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। টিআরটি ওয়ার্ল্ডে এ সংবাদ প্রকাশ হলে ইমরান খান ওই সংবাদের লিংকে তার টুইটারে বলেন, ইসলামোফোবিয়া মোকাবেলয়া আমরা মুসলমানদের, বিশেষ করে মুসলিম নেতাদের অবশ্যই এ বার্তাটি অমুসলিম বিশ্বের নেতাদের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।
রাশিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসের বরাত দিয়ে বিবিসি জানাচ্ছে, পুতিন বলেছেন, ইসলামের নবীর অবমাননা ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন। তিনি আরো বলেন, ইসলামের নবীর অবমাননা ইসলামের অনুসারীদের পবিত্র অনুভূতিতে আঘাতের সমতুল্য। এ প্রসঙ্গে তিনি ফ্রান্সে ইসলামের নবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশকারী ম্যাগাজিনের কার্যালয়ে আক্রমণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি হেবডোতে ইসলামের নবীর ধৃষ্টতামূলক ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের সমালোচনা করে বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড উগ্রবাদ সৃষ্টি করেছে। ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের নাম উল্লেখ ব্যতিরেকে তাদের সমালোচনা করে পুতিন বলেন, ইউরোপের দেশগুলোর মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনা ও আবেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। তিনি বলেন, বাকস্বাধীনতার একটা সীমা আছে। আমাদের অন্য ধর্মের সীমা অতিক্রম করা উচিত হবে না। রাশিয়াতে কয়েকটি ধর্মের মানুষ একত্রে বসবাস করেন। আমাদের একে অপরের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও রীতির সম্মান করা উচিত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়্যব এরদোগান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানসহ আরো কিছু মুসলিম নেতার পর এই প্রথম কোনো অমুসলিম বিশ্বনেতা এ বিষয়ে কথা বললেন। আর এটাও প্রথম যে, কোনো বিশ্বনেতা প্রকাশ্যে ফ্রান্সে সঙ্ঘটিত ধৃষ্টতামূলক আচরণের সমালোচনা করলেন। এ কারণে মুসলমানরা তাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
মুসলমানগণও তাঁদের নবীর অবমাননা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। এর নাম এশকে রাসূল। কেউ নামাজ পড়ুক বা না পড়ুক, রোজা রাখুক বা না রাখুক, কিন্তু নবী অবমাননা কেউ মেনে নিতে পারে না। বিশ্বের যেখানেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে ধৃষ্টতা প্রদর্শন হোক না কেন, মুসলমানরা সেটাকে নিজেদের ওপর আক্রমণ মনে করেন। পুতিনের বক্তব্য আমাদের আবার শার্লি হেবডোর নোংরামির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ২০০৬ সালে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি ব্যঙ্গচিত্র পুনর্মুদ্রণের মাধ্যমে শার্লি হেবডো বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১২ সালে পত্রিকাটি আবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবমাননাকর ছবি প্রকাশ করে। এরপর পত্রিকাটি একের পর এক অবমাননাকর ছবি ছাপাতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে পত্রিকাটিতে হামলা হয়। এরপর পত্রিকাটি তাদের কার্যালয় মূল স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে অন্য এক স্থান থেকে পুনরায় প্রকাশনা কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৫ সালে তারা আবার নবী সা:-এর অবমাননাকর ছবি প্রকাশ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই পত্রিকায় আবার হামলা হয়। এদিকেই ইঙ্গিত করে পুতিন বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড উগ্রবাদ সৃষ্টি করেছে।
২০০৫ সালে ডেনমার্কের এক সংবাদপত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধৃষ্টতামূলক কার্টুন প্রকাশ করলে বহু মুসলিম দেশেই প্রতিবাদ হয়েছে। সংবাদপত্রটি ওই কার্টুন প্রকাশকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ইস্যু বানানোর চেষ্টা চালায়। ২০০৬ সালে সুইডেনের কিছু ওয়েবসাইট ওই কার্টুনগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ছড়াতে শুরু করে। ওই ওয়েবসাইটগুলোকে বলা হয়, এই কার্টুনগুলো সরিয়ে নাও। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরিশেষে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লায়লা ফ্রেইভাল্ডসকে পদত্যাগ করতে হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ওয়েবসাইটগুলো থেকে কার্টুন সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিল। ইউরোপের অধিকাংশ সরকার চাইলেও তারা তাদের মিডিয়াকে ধৃষ্টতামূলক কার্টুন প্রকাশে বাধা দিতে পারে না তথাকথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কারণে।
ইউরোপে বাকস্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননা শুধু ফ্যাশনই নয়, বরং বলা যায় এটা মহামারীর সীমা অতিক্রম করে অতিমারীতে রূপ নিয়েছে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ ২০২০ সালে ফ্রান্সে নবীর অবমাননাকর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সে সময় একের পর এক বিতর্কিত ১২টি ব্যঙ্গচিত্র জনসম্মুখে প্রদর্শন করেন। সারা বিশ্ব থেকে এর জন্য প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও ম্যাক্রোঁ দম্ভভরে বলেছিলেন, ফ্রান্স ব্যঙ্গচিত্র প্রত্যাহার করবে না। বরং এ ধরনের ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ অব্যাহত থাকবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননা শুধু ইউরোপেই নয়, বরং এ মহামারী আমাদের বাংলাদেশেও আছে। মাঝে মধ্যে বাকস্বাধীনতার নামে শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের এ দেশেই এক শ্রেণীর জঘন্যমনা মুক্তমনার দাবিদার আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে অবমাননাকর বিষবাষ্প উদগীরণ করে। তারা এ দেশের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করে। অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা কখনোই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না।
অমুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে পুতিন
তিনি সর্বপ্রথম এমন বক্তব্য দিলেও অনেক আগে থেকেই ইউরোপে এ কথা বলা শুরু হয়েছে যে, মুসলমানদের নবী সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক আচরণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। যেমন ২০১১ সালে অস্ট্রিয়ার একটি আদালত নবী অবমাননার কারণে এক মহিলাকে ৪৮০ ক্রোনা জরিমানা করেন। ওই মহিলা ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসে আপিল করে বলে যে, তাকে দেওয়া শাস্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। ইউরোপিয়ান কোর্ট শাস্তির পক্ষে রায় দিয়ে বলেন, মুসলমানদের নবী সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক আচরণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। কেননা এর দ্বারা বিদ্বেষ ছড়ায়।
সাত সদস্যবিশিষ্ট ইউরোপীয় কোর্ট ২০১৮ সালে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গে এই রায় ঘোষণা করেন। রুশ প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বক্তব্যে শুধু মুসলিম উম্মাহই নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সবাই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি এমন এক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ বক্তব্য প্রদান করেছেন, যখন বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে পরস্পর সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব ঘটেই চলেছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সঙ্ঘটিত ঘটনাবলিকে ইউরোপ উগ্রবাদ বলে অভিহিত করছে। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার বিষয়ে এই প্রথম কোনো অমুসলিম নেতা কথা বললেন, যিনি সুপারপাওয়ার ও নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর সদস্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট পুতিন যে কথা বলেছেন, তা সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ের কথা। ইসলাম সন্ত্রাসের ধর্ম নয়। সুতরাং মুসলমানও সন্ত্রাসী নন। ইসলাম তো সন্ত্রাস দমনের জন্যই পৃথিবীতে এসেছে। মুসলমানরা শান্তিপ্রিয় জাতি। এর জ্বলন্ত প্রমাণ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজে মুসলমানদের হত্যা করার পরও বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। এর প্রতিশোধে তারা কোনো ধরনের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটাননি। কিন্তু এই শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের উস্কে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করা হয় বার বার। আজ সারা বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতার নামে এই হীন কাজ বন্ধ হলে বিশ্বে যতটুকু উগ্রবাদ দেখা যায়, তা অনেকাংশেই কমে যাবে।
পুতিনের বক্তব্য নিয়ে আমাদের একটু ভাবা উচিত। যে সময় ইউরোপে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননার উন্মাদনার জোয়ার চলছে, সে সময় ‘ইসলামের নবীর অবমাননাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলা যায় না’ এমন সাহসী উচ্চারণের জন্য পুতিনকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও উগ্রবাদ নিরসনে পুতিনের এ বক্তব্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
ahmadimtiajdr@gmail.com