ইউরোপে বাকস্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননা
ইউরোপে বাকস্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননা - ছবি : সংগ্রহ
২০০৫ সালে ডেনমার্কের এক সংবাদপত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধৃষ্টতামূলক কার্টুন প্রকাশ করলে বহু মুসলিম দেশেই প্রতিবাদ হয়েছে। সংবাদপত্রটি ওই কার্টুন প্রকাশকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ইস্যু বানানোর চেষ্টা চালায়। ২০০৬ সালে সুইডেনের কিছু ওয়েবসাইট ওই কার্টুনগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ছড়াতে শুরু করে। ওই ওয়েবসাইটগুলোকে বলা হয়, এই কার্টুনগুলো সরিয়ে নাও। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরিশেষে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লায়লা ফ্রেইভাল্ডসকে পদত্যাগ করতে হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ওয়েবসাইটগুলো থেকে কার্টুন সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিল। ইউরোপের অধিকাংশ সরকার চাইলেও তারা তাদের মিডিয়াকে ধৃষ্টতামূলক কার্টুন প্রকাশে বাধা দিতে পারে না তথাকথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কারণে।
ইউরোপে বাকস্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননা শুধু ফ্যাশনই নয়, বরং বলা যায় এটা মহামারীর সীমা অতিক্রম করে অতিমারীতে রূপ নিয়েছে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ ২০২০ সালে ফ্রান্সে নবীর অবমাননাকর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সে সময় একের পর এক বিতর্কিত ১২টি ব্যঙ্গচিত্র জনসম্মুখে প্রদর্শন করেন। সারা বিশ্ব থেকে এর জন্য প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও ম্যাক্রোঁ দম্ভভরে বলেছিলেন, ফ্রান্স ব্যঙ্গচিত্র প্রত্যাহার করবে না। বরং এ ধরনের ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ অব্যাহত থাকবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননা শুধু ইউরোপেই নয়, বরং এ মহামারী আমাদের বাংলাদেশেও আছে। মাঝে মধ্যে বাকস্বাধীনতার নামে শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের এ দেশেই এক শ্রেণীর জঘন্যমনা মুক্তমনার দাবিদার আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে অবমাননাকর বিষবাষ্প উদগীরণ করে। তারা এ দেশের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করে। অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা কখনোই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না।
অমুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে পুতিন
তিনি সর্বপ্রথম এমন বক্তব্য দিলেও অনেক আগে থেকেই ইউরোপে এ কথা বলা শুরু হয়েছে যে, মুসলমানদের নবী সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক আচরণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। যেমন ২০১১ সালে অস্ট্রিয়ার একটি আদালত নবী অবমাননার কারণে এক মহিলাকে ৪৮০ ক্রোনা জরিমানা করেন। ওই মহিলা ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসে আপিল করে বলে যে, তাকে দেওয়া শাস্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। ইউরোপিয়ান কোর্ট শাস্তির পক্ষে রায় দিয়ে বলেন, মুসলমানদের নবী সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক আচরণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়। কেননা এর দ্বারা বিদ্বেষ ছড়ায়।
সাত সদস্যবিশিষ্ট ইউরোপীয় কোর্ট ২০১৮ সালে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গে এই রায় ঘোষণা করেন। রুশ প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বক্তব্যে শুধু মুসলিম উম্মাহই নয়, বরং বিশ্বজুড়ে সবাই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি এমন এক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ বক্তব্য প্রদান করেছেন, যখন বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে পরস্পর সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব ঘটেই চলেছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সঙ্ঘটিত ঘটনাবলিকে ইউরোপ উগ্রবাদ বলে অভিহিত করছে। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার বিষয়ে এই প্রথম কোনো অমুসলিম নেতা কথা বললেন, যিনি সুপারপাওয়ার ও নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর সদস্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট পুতিন যে কথা বলেছেন, তা সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ের কথা। ইসলাম সন্ত্রাসের ধর্ম নয়। সুতরাং মুসলমানও সন্ত্রাসী নন। ইসলাম তো সন্ত্রাস দমনের জন্যই পৃথিবীতে এসেছে। মুসলমানরা শান্তিপ্রিয় জাতি। এর জ্বলন্ত প্রমাণ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজে মুসলমানদের হত্যা করার পরও বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। এর প্রতিশোধে তারা কোনো ধরনের হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড ঘটাননি। কিন্তু এই শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের উস্কে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করা হয় বার বার। আজ সারা বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতার নামে এই হীন কাজ বন্ধ হলে বিশ্বে যতটুকু উগ্রবাদ দেখা যায়, তা অনেকাংশেই কমে যাবে।
পুতিনের বক্তব্য নিয়ে আমাদের একটু ভাবা উচিত। যে সময় ইউরোপে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলামের নবীর অবমাননার উন্মাদনার জোয়ার চলছে, সে সময় ‘ইসলামের নবীর অবমাননাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলা যায় না’ এমন সাহসী উচ্চারণের জন্য পুতিনকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও উগ্রবাদ নিরসনে পুতিনের এ বক্তব্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক