বালু : ভারতীয় ক্রিকেটের বর্ণবৈষম্যের উদাহরণ
বালু - ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি ক্রিকেট মাঠে বর্ণবৈষম্য ফের শিরোনামে। মাইকেল হোল্ডিং নতুন করে সরব হয়েছেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কুইন্টন ডি’কক হাঁটু মুড়ে বসতে অস্বীকার করে বিতর্ক উস্কে দিলেন। কুইন্টন তার পরে খেলতে রাজি হলেও ভারতের বিরুদ্ধে চলতি সিরিজের মাঝেই টেস্ট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে চমকে দিলেন। নেপথ্যে কোনো কাহিনী আছে, সময়ই বলবে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা যে দীর্ঘকাল বর্ণবৈষম্যের কারণে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত ছিল, তা তো সকলেরই জানা।
যদিও ক্রীড়া ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য নতুন কোনো অভিশাপ নয়। ১০০ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে তা দেখা গিয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের নানা অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। এতটাই ভয়াবহ সেই অত্যাচারের মাত্রা যে, ক্যাসিয়াস ক্লে পর্যন্ত তার অলিম্পিক পদক নদীর পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। তার পরে ধর্মান্তরিত হয়ে মোহাম্মদ আলি নাম নেন।
ক্রিকেটে বর্ণবৈষম্য তো ছিলই, এমনকি ভারতীয় ক্রিকেটও এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। যদিও ভারতীয় ক্রিকেটে বর্ণবৈষম্য কাজ করেছে একটু অন্যভাবে। ১৮৯২-তে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরু হয় এ দেশে। ব্যবসায়িক স্বার্থে পার্সিরা ভাবল, ইংরেজদের সাথে ক্রিকেট খেলা হবে উদ্দেশ্য সিদ্ধির সহজ পথ। কারণ শাসকদের কাছেও ক্রিকেট ছিল সবচেয়ে প্রিয় খেলা। সেই মতো মুম্বই এবং পুনের পার্সিরাই প্রথম ইংরেজ শাসকদের সাথে ক্রিকেট শুরু করে। ১৮৯২-তে সেই সব দ্বৈরথের নামকরণ হয়েছিল ‘প্রেসিডেন্সি ম্যাচেস’।
ক্রিকেট খেলে পার্সিদের ব্যবসার প্রসার ঘটতে দেখে এ বার হিন্দুরা আকৃষ্ট হলো। ১৯০৭ সালে তারা প্রতিযোগিতায় যোগ দিলো এবং তখন ত্রিমুখী লড়াই শুরু হয়। ১৯১২-তে এসে গেল মুসলিম দলও। প্রতিযোগিতা হয়ে গেল চার দলের। এর বেশ কয়েক বছর পরে ১৯৩৮ সালে আরো একটি দল যোগ দেয়। শিখ, ক্রিশ্চিয়ান এবং অন্য ধর্মের প্রতিনিধিরা সেই দলে ছিলেন। ধর্মীয় গোঁড়ামির ছাপ ভালো মতোই চোখে পড়ছিল সেই প্রতিযোগিতায়। ১৮৯২ থেকে ১৯৪২- সুদীর্ঘ ৫০ বছর ধরে চলেছিল সেই মনোভাব। যা থামানোর জন্য শেষ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মহাত্মা এই প্রতিযোগিতায় ধর্মীয় প্রভাব নিয়ে সরব হন। তার পরেই টনক নড়ে সকলের।
আরো সাংঘাতিক সব কাণ্ডকারখানা ঘটছিল সেই প্রতিযোগিতায়। হিন্দু দল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হরিজনদের (যাদের বলা হতো আনটাচেবল্স বা অচ্ছ্যুৎ) নেবে না। ইউরোপীয় এবং পার্সিদের হাতে একের পর এক ম্যাচ হারার পরে হিন্দু দল পালওয়াঙ্কার বালুকে খেলাতে বাধ্য হলো। বালু ওই সময়ে ভারতের সেরা বাঁ হাতি স্পিনার ছিলেন। তাকে দলে নেয়ার পরেই হিন্দুরা ম্যাচ জিততে থাকে। কিন্তু বালুকে লাঞ্চ টেবিলে সকলের মাঝে থেকে একসাথে খাবার খেতে দেয়া হতো না। তাকে মাটিতে বসে খাবার খেতে হতো। এতটাই ‘অচ্ছ্যুৎ’ করে রাখা হচ্ছিল ওই সময় ভারতের সেরা স্পিনারকে। এটা যদি বৈষম্য না হয়, তা হলে কোনটাকে বৈষম্য বলব? এর পরে বালুর অন্য তিন ভাই- শিবরাম, বিতাল, গণপতও হিন্দুদের দলে যোগ দিল। কিন্তু তাদের জন্যও হিন্দু ড্রেসিংরুমে অপেক্ষা করত একই রকম বৈষম্যমূলক ব্যবহার। একই রকম অপমান সহ্য করতে হতো তাদের। দুর্দান্ত ক্রিকেটার ছিল চার ভাই। কিন্তু নিজের দলের সতীর্থদের থেকেই সারাক্ষণ বৈষম্যমূলক আচরণ ও মন্তব্যের শিকার হতে হতো তাদের।
বালুর অনন্য প্রতিভাও কোনো ভারতীয় আবিষ্কার করেননি। এক ব্রিটিশ পাদ্রি- যাকে ‘জংলি’ গ্রেগ নামে লোকে চিনত, তিনিই প্রথম খুঁজে বার করেছিলেন বাঁ হাতি স্পিনারকে। গ্রেগ নিজে ইউরোপীয় দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটার ছিলেন। হ্যাম্পশায়ারের হয়েও ব্যাট হাতে অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, বালু বা তার ভাইদের সাথে কখনোই হিন্দু দলের সদস্যরা ঠিক মতো ব্যবহার করেনি। সব সময় তাদের বুঝিয়ে দেয়া হতো- তোমরা ছোট, আমাদের চেয়ে নিম্ন সারির। তাদের চেয়ে অনেক কম যোগ্যতার হয়েও অনেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন একই দলে। কারণ কী? না, তারা নাকি উচ্চ শ্রেণীর, উচ্চ গোত্রের ছিলেন! ভারতীয় সমাজে চলতে থাকা দ্বিচারিতা ফুটে উঠেছিল ক্রিকেট মাঠেও। বালুর মতো ক্রিকেটারকে দলের দরকার ছিল উইকেট নেয়ার জন্য, ম্যাচ জেতার স্বার্থে। ব্যস, ওই টুকুই। তার বাইরে আর কোনো কিছুতেই যেন সমান অধিকার থাকতে পারে না তাদের। খেলার মাঠে বৈষম্যের কী নির্লজ্জ উদাহরণ! যা প্রমাণ করে, বছরের পর বছর ধরে কিভাবে খেলার মাঠেও বৈষম্য রাজ করেছে। হালফিলে দেখা যাচ্ছে, সংগঠক বা প্রশাসকেরা বর্ণবৈষম্য নিয়ে কড়া হচ্ছেন। এক শতাব্দীর ওপর চলা অভিশাপ থেকে খেলাকে মুক্ত করতে গেলে ওই মনোভাবই তো দরকার।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা