সাদ্দাম থেকে বাহাদুর শাহ
সাদ্দাম থেকে বাহাদুর শাহ - ছবি : সংগ্রহ
৩০ ডিসেম্বর! ২০০৬ সালের আজকের এই দিনে মধ্যপ্রাচ্যে কোরবানির ঈদ। মানুষ সকালে গরু কোরবানি দিয়ে এসে শুনতে পায়, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। মানুষের মধ্যে চরম মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এমন দিনে ফাঁসির ফলে ইরাকের শিয়ারা আনন্দে রাস্তায় নেমেছিল কিন্তু সুন্নি মুসলিমদের কাছে বিষয়টি মানতে মোটেও সহজ ছিল না, তারা ঘৃণা প্রকাশ করছিল।
মৃত্যুর পরে সাদ্দাম হোসেনের ভক্ত অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে গেলেও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি ছিলেন চরম একগুঁয়ে, একদেশদর্শী ও স্বৈরপ্রবণ। যাকে সন্দেহ কিংবা অপছন্দ, তার চূড়ান্ত সর্বনাশ করতে মোটেও দ্বিধা করতেন না। তিনি বড় মেয়ে 'রিঘার' স্বামী ও শ্বশুরকে হত্যা করে কন্যাকে বিধবা করতেও কুণ্ঠিত হন নাই। পক্ষান্তরে তার ছেলেরা হয়ে উঠেছিল এক একজন দানব লুটেরার মতো। সন্তানদের যথাযথ নজরদারী না করার কারণে, দুনিয়ার যেসব জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক ঘৃণার পাঁকে আটকে পড়েছিলেন, তিনিও তার মধ্যে একজন।
বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করেই তিনি পাশের ছোট্ট রাষ্ট্র কুয়েত দখল করে নেন। ইরাক ও কুয়েতে প্রচুর বাংলাদেশী কাজ করতেন। বাংলাদেশীদের মধ্যে যার ছেলে যে দেশে চাকুরী করতেন; তাদের পিতা সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সমর্থক হয়ে, গ্রামে-মহল্লায় গোলযোগে মেতে উঠেন। সারা দুনিয়ায় মাতম উঠল, সাদ্দাম তুমি এটা কি করলে? সারা বিশ্বের একজন সাধারণ অশিক্ষিত মানুষও বুঝতে পারে যে, বুশের ইন্ধনেই সাদ্দাম কুয়েত দখল নেয় এবং দখলের পরপরই সে সুর পাল্টে কুয়েতের পক্ষ নিয়ে বসে। গাছে তুলে দিয়ে মই সড়িয়ে ফেলার মত ঘটনাই বটে। ফলে সাদ্দামের পক্ষে আর কোন বিশ্বস্ত বন্ধু রইল না।
কখনো শাসকের কারণেই তার জনগণ অনর্থক কারো শত্রুতে পরিণত হয়। এভাবে একজন অপরিণামদর্শী শাসক তার জনগণের চরম ক্ষতি করেন। তার প্রমাণ দিতে দৌড়ে আসলেন ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত। তিনি ধারণা করছিলেন সাদ্দামের কাছে যে অস্ত্রবল ও বাহু-শক্তি রয়েছে; তা অদম্য, তাকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না। তাই তিনি সাদ্দামের পক্ষেই জোরালো সমর্থন দিয়ে বসলেন! মুসলিম বিশ্বে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। তার এই সিদ্ধান্ত কুয়েতের বিপক্ষে গেল অথচ তারাই একটি বিরাট অনুদান দিত। এ ঘটনায় আরব বিশ্ব বেঁকে বসল। তারা ফিলিস্তিনের মুসলমানদের প্রতি দয়া ও সহানুভূতির হাত সেই যে তুলে নিল, আজো তা প্রায় অপরিবর্তীতই রয়ে গেল।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেভাবে দুর্বল প্রতিহত করতে শেষ চেষ্টা করে। শাসকদের জীবনে যদি এমন পরিস্থিতি আসে তাহলে তারা নিজ জাতিকে অরাজকতা আর নিষ্ঠুরতা উপহার দেয়। সাদ্দামের কোথাও আর স্থান নেই। ফলে পশ্চিমা পরাশক্তির বিরুদ্ধে, হার না মানা, লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার এমন একপেশে দৃঢ় সিদ্ধান্ত; মুসলিম বিশ্বের তরুণ-যুবকদের অনুপ্রাণিত করে। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠল, ইরাক যথারীতি মার খাচ্ছে আর তরুণদের মধ্যে সাদ্দামের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। শেষ দিকে সাদ্দাম বেঁচে ছিলেন জিহবার জোড়ে। মুসলিম তরুনেরা এই অবস্থায়ও বৃদ্ধ সাদ্দামের কাছে সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিল এবং তার অতীত ভুলে সবাই দোয়া করতে লাগল। অনেক পিতা-মাতা নিজের প্রিয় সন্তানের নাম রাখা শুরু করেছিল 'সাদ্দাম' বলে।
তিনি পাকড়াও হলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক পরিত্যক্ত খামার বাড়ির গাড়ির গ্যারেজ থেকে। নিজে বাঁচতে, নিজেদের বাঁচাতে, শেষ করে দিয়ে গেলেন একটি সমৃদ্ধ জাতিকে। অথচ নিজে থেকেই যদি তিনি সড়ে পড়তেন তাহলে ইতিহাস হয়ত তাঁকে আবারো ডেকে আনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করত এবং নির্দোষ স্বীয় জাতিকে বিরান ভূখণ্ডে ভিক্ষার ঝুলি হাতে দৌড়াতে হতনা।
ইতিহাস সাদ্দাম হোসেকে একেবারে হতাশ করেনি। মৃত্যুর পরে তার অনমনীয় তেজি দৃঢ় স্বভাবকে অনেকেই ভালবেসেছেন। যার ফলে সর্বশেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর যেভাবে মানুষের হৃদয়ে জেগে আছে, সাদ্দাম হোসেনকেও তার পাশে স্থান করে দিয়েছে।