দৃষ্টিনন্দন দীপশিখা মেটি স্কুল

সেতারা কবির সেতু | Dec 30, 2021 02:16 pm
দীপশিখা মেটি স্কুল

দীপশিখা মেটি স্কুল - ছবি : সংগ্রহ

 

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রাপুর গ্রামে স্কুলটি অবস্থিত। রুদ্রাপুর শহর থেকে দূরে প্রত্যন্ত একটি গ্রাম হলেও স্কুলটি নির্মাণের পর থেকে অনেকের কাছেই এখন গ্রামটি পরিচিত। এ স্কুলের নির্মাণশৈলী দেখতে প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী আসেন।

১৯৯৯ সালের আগে এ গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা চার-পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে পাশের গ্রামে যেত পড়ালেখা করতে। এ কষ্ট দূর করতে এবং গ্রামের শিশু, কিশোরদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য দীপশিখা নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ১৯৯৯ সালের গত ১ সেপ্টেম্বর রুদ্রাপুর গ্রামে ছোট্ট পরিসরে ‘মেটি স্কুল’ গড়ে তোলে।
এখানে ছাত্রছাত্রীদের নাচ, গান, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা এবং ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন হাতের কাজ শেখানো হয়। বর্তমানে এ স্কুলে শিশুশ্রেণী থেকে দশমশ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। এই স্কুলের উদ্দেশ্য আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, যুক্তিযুক্ত চিন্তার বিকাশ ও দলীয়ভাবে শিক্ষা গ্রহণ।

মেটি মূলত একটি সংগঠনের নাম। পুরো নাম মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি)। কম খরচে এবং হাতের নাগালের জিনিসপত্র ব্যবহার করে মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে মেটি।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিরল উপজেলার রুদ্রাপুর গ্রামে মেটির অত্যাধুনিক মাটির স্কুলঘর নির্মাণ শুরু হয়, জার্মানির ‘শান্তি’ দাতাসংস্থার অনুদানে। অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এ স্কুল নির্মাণে অবদান রাখেন। সহযোগিতা করেন দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরা। জার্মান স্থপতি অ্যানা হেরিঙ্গার ও এইকে রোওয়ার্ক এই ভবনের নকশা করেন।

মেটি স্কুল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু ও বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়াল, যাতে দেয়ালে ফাটল ধরতে না পারে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি দেয়ালে লাগলে খড়ের জন্য তা নেমে যাবে। দেয়াল তৈরির পর সুন্দর করে সমান করা হয়েছে।
দেয়ালের প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। মেঝের প্লাস্টারের জন্য পামঅয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ওয়াটারপ্রুফ। বাইরে থেকে প্লাস্টার না করায় স্বাভাবিকভাবে উপকরণগুলো চোখে পড়ার মতো।
মেটি স্কুল ছয় কক্ষবিশিষ্ট মাটির তৈরি একটি দোতলা ভবন। এর আয়তন ৮ হাজার বর্গফুট। ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭ লাখ টাকা। অথচ ইট, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করলে ব্যয় হতো প্রায় এক কোটি টাকা। ভবনের ভেতরে রয়েছে শীতের দিনে গরম আর গরমের দিনে ঠাণ্ডার ব্যবস্থা।

জার্মান ও অস্ট্রিয়ার ১০ জন ছাত্র ও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় ১৯ জন শ্রমিকের সমন্বয়ে মেটি স্কুল নির্মিত হয়েছে। ২০০৮ সালে বিশ্বের ১৩টি স্থাপত্যের সাথে মেটি স্কুলকে আগা খান অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। পুরস্কার হিসেবে দীপশিখাকে ১৩ হাজার ৭০০ ডলার। এ ছাড়া অ্যানা হেরিঙ্গার ২০০৯ সালে এই ভবনটি নকশার জন্য কারি স্টোন নকশা পুরস্কারে ভূষিত হন।

দিনাজপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে দীপশিখা মেটি স্কুলটি অবস্থিত। পাকা সড়ক। স্কুলটি দর্শনে যাওয়ার সময় তেমন বেগ পেতে হয় না। তবে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে দর্শনার্থীদের তেমন প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। তা ছাড়া বিকেল ৫টার পর মূল দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।

দুই পাশে সবুজ ধানক্ষেত। আর মাঝখান দিয়ে স্কুলটিতে যাওয়ার পথ। এ পথ দিয়ে যেতে ক্লান্তি এতটুকুও স্পর্শ করবে না। গাড়ির গ্লাসটি নামিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন স্কুলের গেটে পৌঁছে যায় তা টেরই পাওয়া যাবে না। ভেতরে প্রবেশ করার পর কিছু সময়ের জন্য থমকে যেতে হবে। ভাবতে হবে মাটি আর বাঁশ দিয়ে ত সুন্দর নির্মাণশৈলী হতে পারে! সত্যিই এই স্কুলের নির্মাণশৈলী দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। স্কুলের ভবনগুলো তিনতলা পর্যন্ত। ভবনের প্রতিটি তলার সামনে লম্বা বারান্দা এবং পেছনে উঁচু থেকে নিচু করে সুন্দর একটি পথ তৈরি করা হয়েছে। নিচ তলা থেকে তিন তলায় যাওয়ার জন্য কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। সেই সাথে পেছনের পথ দিয়েও নামা এবং উঠার সুযোগ রয়েছে।

ভবনগুলো একসাথে না। একটা ভবন থেকে আরেকটা ভবন বেশ দূরে স্থাপিত। প্রতিটি ভবনের সামনে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে। নতুন ভবনের পেছনের ঘাট বাঁধানো একটি পুকুর আছে। পুকুরের চারপাশে আছে গাছ। পুকুরের শীতল বাতাস বয়ে যায় ভবনটির উপর দিয়ে। প্রতিটি ভবনের সামনে রয়েছে মাঠ। মাঠে ছাত্রছাত্রীদের জন্য দোলনা, স্পিরসহ খেলাধুলার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে।

মাঠ থেকে একটু পেছনে গেলে দুই তলার একটি লাইব্রেরি চোখে পড়ে । লাইব্রেরিটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে দেখে মনে হবে ডু প্লেক্স কোনো বাড়ি। যেহেতু স্কুলটি ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তাই একটি বড় কক্ষে অনেকগুলো সেলাই মেশিন রয়েছে। মূল দরজা দিয়ে ডুকতেই একটি দৃষ্টিনন্দন ভবন আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই ভবনে জার্মান ও অস্ট্রিয়ার কয়েকজন শিক্ষক এবং আমাদের দেশের কয়েকজন শিক্ষক পরিবারসহ থাকেন। পরিবেশ বান্ধব স্কুলটির নির্মাণশৈলী সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সবুজের মধ্যে একেকটি ভবন দেখে মনে হয়েছে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি করা হয়েছে চমৎকার দীপশিখা মেটি স্কুলটি।

আমাদের চারপাশে অনেক সুন্দর নির্মাণশৈলী রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর খোঁজ আমরা রাখি না। সেগুলোর সৌন্দর্যও আমরা অনুভব করতে পারি না। অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ আমাদের এই সোনার দেশ। তাই বিদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করার আগে বাংলার রূপ হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে হবে আমাদের সবাইকে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us