হতভাগী

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান | Dec 27, 2021 02:22 pm
হতভাগী

হতভাগী - অন্য এক দিগন্ত

 

বেশ কিছুদিন ধরে অশিতের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সংসারে একটার পর একটা সমস্যা লেগে আছে। এসব নিয়ে সারা দিন চিন্তায় থাকে অশিত। তার চোখের সামনে ভেঙে গেল সোনার সংসার, যা কখনো ভাবতে পারেনি। একটু একটু করে এই সংসারটাকে সাজিয়ে তুলেছে সে। এসব কথা মনে হলে ব্যথায় হৃদয়টা টন টন করে ওঠে। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে অশিত। পিনু, শিনু আর শিবু এখনো জেগে আছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় ১টা। তবুও তাদের চোখে ঘুম নেই। সবার মনে আতঙ্ক। বাইরে লোক লজ্জার ভয়। যদি বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। তাহলে আর সম্মান বাঁচবে না। কেউ জানার আগেই বিষয়টি থামাচাপা দিতে হবে। নিজেদের মধ্যে বেশ ক’দিন ধরে সেই আলোচনাই চলছে।

শিবুকে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়েছে অশিত। তার ধারণা, বিয়ের পর শিবু আর আগের মতো থাকবে না। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই সে কথা সত্য হতে লাগল। অশিত অত্যন্ত খুশি হলো। মনে মনে অশিত ভাবল, জীবনে এই প্রথম বোধহয় সে একটা ভালো কাজ করেছে। টাকা দিয়ে সুখ কিনতে না পারলেও সুখে থাকার একটা উপায় খুঁজে নিয়েছে। পিনু, শিনু ওরাও দারুণ খুশি হলো।

সীমা এখন মালঙ্গী পরিবারের বউ। বংশ-বুনিয়াদে তারা মালঙ্গী পরিবারের থেকে উচু হলেও শিবুকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। তাই বাবার অমতে সীমা নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছে। শেষপর্যন্ত বাবাও সব মেনে নিয়েছে। মেয়ে যদি ওকে নিয়ে সুখী হতে পারে সে কেনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই নিজের উদারতা দিয়ে মনের ব্যথাকে আড়াল করেছে। একসময় মেয়ের ওপরের সব অভিমান অন্তর থেকে ঝেড়ে দিয়ে শিবুকেও সে আপন করে নিয়েছে। নিজের কোনো ছেলে নেই। শিবু-ই এখন তার ছেলে।

অশিত বাবু এই মালঙ্গী পরিবারের বড় ছেলে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সে আর বিয়ে করেনি। বাবা তাকে অনেক জোরাজুরি করেছে। কিন্তু সে কোনোমতেই রাজি হয়নি। বাকি জীবনটা সে মা-বাবা আর ভাইদের জন্য কাটিয়ে দেবে। তারা জানে, অশিত বরাবরই এক কথার লোক। তাই বাবাও তাকে আর বিয়ে নিয়ে কখনো বলেননি। অনেকগুলো বছর অশিত এই সংসারের পেছনে ব্যয় করেছে। সবাইকে মানুষ করেছে। পিনু, শিনু ওরা সবাই যে যার মতো চাকরি করছে। একমাত্র শিবুটা কিছু করতে পারল না। এ কারণে শিবুকে নিয়ে অনেক কষ্ট ছিল অশিতের। সীমা এ পরিবারে আসার পর অশিতের সেই ব্যথা একটু একটু করে দূর হতে শুরু করল। শিবু চাকরি করে না তাতে কী। সীমা তো ঠিকই চাকরি করছে। শিবুকে সীমা ভালো একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

সীমা যে শুধু অশিতের জন্য গর্ব তা নয়, মালঙ্গী পরিবারের বাইরে সবাই সীমাকে পছন্দ করে। কারো সাথে কথা বললে মেয়েটি সেই চিরায়ত হাসিতে সবাইকে আপন করে নেয়। সবার সাহায্যে এগিয়ে যায়। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে সে মানুষকে যখন যেভাবে পারে সহযোগিতা করে। তার কাছে ধর্ম-বর্ণ- গোত্র জাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। সবার ধর্ম বিশ্বাসকে সে সমানভাবে শ্রদ্ধা করে। এই সংসারে সীমার আগমন মালঙ্গী পরিবারে প্রাণ পেয়েছে। বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের মর্যাদা।

অশিত নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করে। বিয়ে না করেই সে অনেক ভালো আছে। তাহলে জীবনে হয়তো এত ভাবার সুযোগ পেত না। যে সুযোগটা সে তার ভাইদের মানুষ করতে কাজে লাগিয়েছে। অশিতের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। তবুও শিবুকে নিয়ে কেন জানি ভয় হয়। অতীতের কিছু কথা তাকে ভাবিয়ে তুলে। সে কথা অশিত কাউকে বলতে পারে না। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে।

অশিতের কাছ থেকে সীমা বিষয়টিই বারবার জানতে চেয়েছে। কিন্তু সে বলতে যেয়েও বলতে পারেনি। তার বিশ^াস, যে মানুষটি বদলে গিয়েছে কেন তাকে অতীতের কথা মনে করিয়ে সংসারে অশান্তির ঝড় তুলব। তার চেয়ে বরং আমাদের নীরবতাই তাকে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাবে। তাই শিবুর দুর্বলতাকে সে আড়াল করেছে। সীমা অশিত বাবুকে ভালোবাসলেও এখন সন্দেহের চোখে দেখে। সে কষ্টকে অশিত বাবু মেনে নিয়েছে।
সবাই তার কাছে শিবুকে আড়াল করলেও সীমার কাছে ক্রমেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। সে-ও এখন জানে, শিবুর জীবনের দুর্বল দিকটি। এমন একটি সময়ে সে জানতে পেরেছে যখন তার করার কিছু নেই। একরাশ অভিমান নিয়ে দূরে সরে গেলেও জীবনের নিষ্ক্রিতি হবে না। এই কষ্ট নিয়েই তাকে বাঁচতে হবে। যখন সে অন্য কিছু ভাবতে চায়, আবির আর মিনতি তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ছেড়ে সীমা নতুন কিছু ভাবতে পারে না। ভাবতে চায়ও না। যখন ভাবার সময় ছিল তখন সে ভাবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। সত্য তখন নিজের অজান্তেই ছিল। আবির আর মিনতিকে ঘিরে কত স্বপ্ন বুনেছে সে। মেয়ে বড় হবে। ছেলে স্কুলে যাবে। সেই সুখের স্বপ্নকে শিবু এভাবে আঘাত করবে বুঝতেও পারেনি।

সীমা প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ। এ পরিবারে পা রাখার পর থেকেই তার ব্যস্ততা আরো বেড়েছে। নিজের কথা ভাবার চেয়ে অন্যের কথাই বেশি ভাবতে হয়। তাই স্বামীর দিকে আড়চোখে তাকানোর মতো সময় তার নেই। এখন না চাইলেও মাঝেমধ্যে একটু-আধটু ঝামেলায় জড়াতে হয়। অনেক দিন হলো শিবুর সাথে ভালো সময় যাচ্ছে না তার। শিবুও তার খবর খুব একটা রাখে না। তবুও একই ছাদের নিচে দু’টি প্রাণীর বসবাস।

রাগ করে শিবু দু’দিন বাড়িতে ফেরেনি। সীমাও কিছু বলছে না। অশিত বাবু তার কোনো খোঁজ নেয়নি। শিবু তার মনে দারুণ কষ্ট দিয়েছে। যে ভাইকে ছোট থেকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, ওদের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছে, সেই ভাই তাকে এত বড় আঘাত দিলো! অশিত তা সইতে পারেনি। আজ তার কথা শোনার মতো কেউ নেই।
শিবু দু’দিন ফেরেনি দেখে পিনু বলল- দাদা, তুমি কোনো খোঁজ নেবে না? অশিত বলল, তোরাই তো নিতে পারিস, আমার কী প্রয়োজন? শিনু বলল- দাদা, তুমি অমন করে বলছ কেন? শিবু না হয় একটা ভুল করেই বসেছে। তাই বলে ওতো আমাদের ভাই। ‘বড়রাই শুধু ছোটদের কথা ভাববে? ছোটরা বড়দের কষ্ট একটুও বুঝবে না? শিবু আমাদের এভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে কখনো ভাবতে পারিনি।’ বলল অশিত। শিবু সম্পর্কে অশিত আর কিছুই বলল না। রাগ করে উঠে গেল। পিনুকে বলল, ওই মেয়েটার বাড়ি কোথায়? পিনু হা করে অশিতের দিকে তাকিয়ে রইল। দাদাবাবু এ কী বলছেন!

পরের দিন সকালে অশিতের কাছে খবর এলো- শিবু তার এক বন্ধুর বাসায় উঠেছে। সে বাসার অসীম বাবু তাকে জানিয়েছে সে যেন শিবুকে নিয়ে আসে, যা কখনোই হওয়ার ছিল না তা-ই হয়েছে। শিবু তার চাচাতো বোন লাবণ্যকে নিয়ে ওখানে ওঠেছে। লাবণ্যের নামটা শুনে আরো অবাক সবাই!

লাবণ্যকে এক সময় ভালোবাসত শিবু। কিন্তু শিবুকে ছেড়ে অন্য একটি ছেলেকে বিয়ে করে লাবণ্য। শিবুর পরিবার থেকে লাবণ্যকে বউ করার প্রস্তাব পাঠালেও তা ফিরিয়ে দেয়। কারণ শিবু বেকার। ওর কিছু নেই। এরপর সে নতুন স্বামীর হাতটি ধরে সুখের সন্ধানে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়। শিবুর সাথে লাবণ্যের আর কোনো পরিচয় নেই। এভাবে কেটে গেছে দীর্ঘ ১০ বছর। শিবুর পরিবার ভুলে গেছে লাবণ্যকে।
অশিত নিজেকে আজ খুব অপরাধী ভাবছে। সীমার মতো একটি মেয়েকে সে নিজের স্বার্থে মেরে ফেলেছে। ভাইয়ের কাছে তার সিদ্ধান্ত এত যে মূল্যহীন তা কখনো ভাবতে পারেনি। আজ লাবণ্যকে নিয়ে সে রঙিন পৃথিবীর কথা ভাবছে। সেদিনের সে অপমান শিবু ভুলে গেলেও অশিত ভুলতে পারেনি। তাই তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ভেবে পাচ্ছে না, অসীমকে সে কী বলবে। না শিবুকে তার মতে চলতে দেবে। তাহলে এত দিনের মমত্ব, ভালোবাসার এসবই কি মিথ্যে? অশিত ভাবছে, দায়িত্বহীন হয়ে কখনো দায়িত্ব এড়ানো যায় না। তাতে নিজেকে আরো ছোট করে দেয়। বিপদ যখন এসেছে তাকে সামনাসামনি মোকাবেলা করে সামলে নেয়াই উচিত। অসীমের কথায় লাবণ্যের খোঁজ নিলো অশিত।

লাবণ্য বলল- দাদা, জানি আমি ভুল করেছি। কেবল নিজের কথাই ভেবেছি। আমি যা করেছি সবই অন্যায়। আমি জানতাম না শিবু বিয়ে করেছে। তবও শিবুকে ভুল বুঝবেন না। হয়তো আমার কথা ভেবে নিজের এত বড় সর্বনাশ করেছে। ভুল আমারও কম নয়। গত ছ’মাস আগে আমি বাংলাদেশে আসি। এখানে আমার মা মারা যায়। এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই খবর পাই আমার স্বামীও অস্ট্রেলিয়ায় রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। এ খবর শুনে পাগলপ্রায় হয়ে যাই। শিবু আমাকে বাঁচিয়ে তোলে।

এরপর ওখানে আমি আর ফিরে যাইনি। গিয়ে আর কী হবে। ধীরে ধীরে শিবুর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। শিবুও এখানে আসা-যাওয়া করতে থাকে। চারপাশের লোকজন শিবুর এ অবাধ বিচরণ মেনে নিতে পারে না। একপর্যায় শিবুকে সবাই আটকে দেয়। আমিও নিজের অবস্থানে থেকে কিছু বলতে পারিনি।

অশিত বাবু সব বুঝতে পারেন। সীমাকে ডেকে বললেন- এখন তুমিই বল আমি কী করব? আমি ভুল করেছি, তোমার মতো একটি মেয়েকে আমার ভাইয়ের জীবনে জড়িয়ে। বুঝতে পারিনি, নিজের ভালো করতে গিয়ে অপরের মন্দ করাটাও অন্যায়। সীমা বলল- দাদাবাবু, তুমি জেনেশুনে আমাকে এভাবে কাঁদালে? শুধু ভাইয়ের কথা ভাবলে। অভাগীর কথাটা ভাবলে না?

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us