একজন জীবনসঙ্গী
একজন জীবনসঙ্গী - ছবি : সংগ্রহ
পাঁচ মাস পর মিসেস আহমেদ দেশে ফিরছেন। এত দিন নাতনীকে নিয়ে ভালোই সময় কাটছিল তার। নাতনী, মেয়ে আর তিনি মিলে তৈরি করছিলেন কতগুলো স্বপ্নবন্দী ফ্রেম। নাতনীর ছবি তুলে তার নানার কাছে পাঠানোই ছিল প্রতিদিনের অন্যতম কাজ। নাতনীর নানাভাইও দিনে একাধিকবার নাতনীকে না দেখে থাকতে পারতেন না। কেবল চোখ তুলে তাকানো নাতনী যখন তার হাত পা ছুঁড়তো সেই দৃশ্য একা একা উপভোগ করা তার জন্য অসম্ভবই ছিল।
কিন্তু পিছুটানও কম ছিল না। থাকবে না কেন? ষাটোর্ধ্ব মিসেস আহমেদের সাংসারিক জীবনও কম তো হলো না।
যদিও তার সাংসারিক জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে স্বামীর সাথে খুনসুটি করে। বয়সকালে তাদের দাম্পত্য জীবনে খুব পরিচিত একটা দৃশ্য সংসারে প্রায়ই দেখা যেত -আহমেদ সাহেব স্ত্রীর পিছে পিছে চিরুনি বা ক্রিম নিয়ে ঘুর ঘুর করছেন। আর স্ত্রী অব্যাহতভাবে ঝাড়ি মারছেন পিছে পিছে এসব নিয়ে দৌড়ানোর জন্য। মিসেস আহমেদের প্রচণ্ড অনীহা এসবে, নিজে খুব সুন্দরী হলেও রূপচর্চাকে হাস্যকর মনে করতেন তিনি। স্ত্রীর এই মানসিকতায় আহমেদ সাহেবের ছিল আক্ষেপ। তিনি নিজে পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতে। নিজের পছন্দ মতোই থাকতেন সব সময় টিপটপ হয়ে। মাথায় উচ্ছিষ্ট চুলগুলো নিয়েও তার অনেক যত্ন, আর স্ত্রী কি না সারাদিন থাকে উসখোখুসকো চুলে, মাথা আঁচড়াতে মনে থাকে না। স্ত্রীর এমন মানসিকতা তিনি মানতে পারতেন না। জীবনে যত না ক্রিম আহমেদ সাহেব ব্যবহার করেছেন; তার একভাগও মিসেস আহমেদ ব্যবহার করেননি। তাদের পরিবারের এসব অদ্ভুত বিষয়গুলো খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারতেন বাইরের কোনও অতিথি তাদের বাসায় বেড়াতে এরে। অতিথিরা এক ধরনের নির্মল আনন্দ পেতেন এই সব দেখে। মেহমানদের আরো কয়েকদিন থেকে যেতে মন চাইতো। সম্ভবত এ পরিবারের উদ্ভট বিষয়গুলোতে এক ধরনের টান অনুভব করতেন অতিথিরা। আর কে না চায় মিষ্টি মধুর সম্পর্ক সামনে থেকে দেখতে!
মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ‘প্রথম’ শব্দটা সবসময়ই অন্য রকম উপলব্ধি এনে দেয়। তা হোক সুখের বা দুঃখের; যেকোনো স্মৃতিই হোক না কেন। এবারই প্রথম মিসেস আহমেদ স্বামীকে ছেড়ে বেশি দিন দূরে থাকছেন। তা-ই আবার বিদেশ বিভূঁইয়ে। এই প্রথম আরেকটি প্রথমও যুক্ত হলো। এবারই প্রথম তাদের বিবাহবার্ষিকীতে মিসেস আহমেদ কোনো রজনীগন্ধা পাননি। এবারই আহমেদ সাহেব প্রথম স্ত্রীর হাতে সশরীরে কোনো উপহার দিতে পারেননি। ৪৮ বছরের সংসার জীবন আহমেদ সাহেবের। কখনো ভুল করেও ভুলে যাননি স্ত্রীর জন্য একগুচ্ছ রজনীগন্ধা আনতে এই বিশেষ দিনে। বরং মিসেস আহমেদই অসংখ্যবার ভুলে গেছেন এবং তাকে মনে করিয়ে দিতেন তার ছেলেমেয়েরা।
কিন্তু ব্যস্ততার দোহাই দেয়া অন্য অনেক পুরুষের মতো ভুলে যাওয়ার প্রবণতা সযত্নে এড়িয়ে যেতে পারতেন কাজ পাগল আহমেদ সাহেব। বেপারটি আমাদের স্যাঁতস্যাঁতে পুরনো ধূলি পড়া মানসিকতার সমাজে একটু অন্য রকম বৈকি। তবে এটিই ছিল আহমেদ সাহেবের পরিবারে খুব ঝরঝরে পরিছন্ন স্বাভাবিক একটা ঘটনা। যেন এমনটাই হওয়ার কথা; আহমেদ সাহেবের মনে থাকবে আর মিসেস আহমেদ ভুলে যাবেন। আহমেদ সাহেব অন্য যেকোনো ফুল না এনে নিয়ে আসবেন রজনীগন্ধা, সাথে কোনো উপহার, কখনো সাদামাটা, কখনোবা দামি। যখন আহমেদ সাহেব হাসিমুখে এসব নিয়ে বাসায় ঢুকতেন তখন মিসেস আহমেদ যতনা খুশি হতেন তার চেয়ে খানিকটা কম হতেন বিব্রত। আর আরেকটু আহ্লাদ ঝরিয়ে তিরস্কার করতেন অযথা টাকা নষ্ট করার জন্য। কিন্তু তার পুত্র কন্যা জানত তাদের বাবার রুচি আর দশজন মানুষের মতো নয়, তাদের মা যতই বলুন তিনি ভেতরে ঠিকই জানতেন তার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে সবচে রুচিশীল কোনো উপহার যা পছন্দ না করে উপায় নেই।
আহমেদ সাহেবের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর হলেও তার মনন রুচিবোধের কাছে অনেক হাল ফ্যাশনের মানুষও মুখ থুবড়ে পড়তেন। যে কারণে তার একবিংশ শতাব্দীর মানসিকতায় খাপ খাইয়ে চলা পুত্র আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের কন্যা যে কি না এক পোশাকের জন্য একাধিক শপিংমল ঘুরেও মন মতো না পেয়ে মুখ গোমড়া করে ঘরে ফিরত, তারাও নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারত বয়স্ক বাবার রুচির ওপর। বাবার নির্ভেজাল মমতা আর ভালোবাসায় ভরা উপহার তাদের মাকে খুশি করার পাশাপাশি বাকি সবার ভেতরেও একটা ঈদ ঈদ আমেজ নিয়ে আসত। মিসেস আহমেদ এইবার পেলেন না কিছুই। তিনি ছিলেন ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে নিজের বিশেষ দিনটিতে কন্যার কাছে।
আত্মগ্লানিতে ভরা তার কন্যা চেষ্টা করেছে দিনটি আগের মতো করার ভার্চুয়াল রিয়ালিটির সাহায্যে। পৃথিবীর এক প্রান্তে তাদের মা আর অন্য প্রান্তে বাবার মাঝে অসংখ্য ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ, সুগন্ধি শুভ্র রজনীগন্ধার বদলে সে তার কন্যাজামাতার কাছ থেকে পেয়েছেন গন্ধহীন রঙিন গ্লাডিওলাস; যার রঙ সৌন্দর্যের কাছে রজনীগন্ধা হেরে না গিয়ে বরং জিতে আছে। সব বাবার রজনীগন্ধার কাছে পৃথিবীর সব ফুল যে হেরেই থাকে।
মিসেস আহমেদ প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন ব্যাপারটি হালকা করে দেখতে, নিজের বিশেষ দিনের অপ্রাপ্তিকে উপেক্ষা করতে। কিন্তু এই অপ্রাপ্তি মা-মেয়ে দু’জনের কাছেই আরো শতগুণে বেড়ে হাজির হলো যখন আহমেদ সাহেবের মলিন মুখটা দেখা গেল ৫ ইঞ্চি স্ক্রিনে। মা-মেয়ে দু’জনেই বুঝতে পারল মানুষটা ৭৩ বছরে এসেও অনেক বেশি শিশু। যদিও তার মলিনতা কিছুটা লাঘব করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার ভাবী, ঘরে বানানো কেক উপহার দিয়ে। তিনি হয়তো এই ভেবে নিজেকে একটু আশ্বস্ত করছিলেন যে তার বিশেষ দিনটাকে কয়েকজন এখনো বিশেষভাবেই মনে রেখেছেন।
মিসেস আহমেদ ভাবছেন, যে মানুষটাকে রেখে এসেছেন তিনি এক গ্লাস পানি নিজে ঢেলে খেতে গেলে কিছু পানি গড়াবে টেবিলে, কিছু দাড়িতে, কিছু পরনের ফতুয়ায়। বেখেয়ালি স্বভাবের মানুষটা একা একা ঘরের তেমন কিছুই করতে পারেন না; তবুও প্রয়োজনে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করে খাওয়া আবার ঠাণ্ডা হলে ফ্রিজে রেখে দেয়ার ব্যাপারে মিসেস আহমেদকে বারবার বলে দিতে হয়নি। বাধ্য ছাত্রের মতো সুচারুভাবে করে গেছেন মিসেস আহমেদকে অবাক করে দিয়ে। মিসেস আহমেদ ভাবতে বাধ্য হয়েছেন যে, আসলে ভুলটা তারই ছিল, দায়িত্ববান মানুষটাকে আরো আগে থেকে ঘরের কাজ শেখালে অনেক কিছুই হয়তো বহু আগে থেকেই সহজ হতো। আজ ৫ মাস পর সত্যিকার মানুষটাকে আপাদমস্তক দেখতে মুখিয়ে আছেন মিসেস আহমেদ। নিজের ঘর, নিজের সংসারটান বড়ো অমোঘ। তিনি হিসেব করলেন, ৩৩ ঘণ্টা যাত্রা শেষে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে তাদের বাসায় যেতে লাগবে আরো কয়েক ঘণ্টা। নিজের দেশের এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা যেন ভিনদেশের এয়ারপোর্টের চেয়ে হাজারো কঠিন। এ দিকে দেশে করোনা পরিস্থিতি মাথা চাড়া দেয়ায়, তিনি সর্বাত্মক প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে পরে আছেন আপাদমস্তক পিপিই। এখন দ্রুত সুস্থভাবে বাসায় পৌঁছাতে পারাই যেন সব। তিনি স্বামীকে নিষেধ করেন এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করতে। দেশের এই পরিস্থিতিতে বয়োজ্যেষ্ঠ কারো বের হওয়ার কোনো মানেই হয় না।
যা হোক, প্লেন ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়েতে নেমে গেছে ইতোমধ্যে, আর তো কয়েকটা ঘণ্টা মাত্র তারপরই মিসেস আহমেদ দেখবেন তার ভালোবাসার মানুষটাকে। দূর থেকে হেলেদুলে হাঁটতে থাকা মানুষ বাসার কাছে পৌঁছে যেমন দৌড়াতে শুরু করে মিসেস আহমেদের এখন ইচ্ছা করছে দৌড় দিয়ে বাসায় ঢুকে যেতে, ৩৩ ঘণ্টার যাত্রার কাছে কয়েক ঘণ্টাই যেন আরো যন্ত্রণাদায়ক। বড়ই পীড়াদায়ক।