ডুবে যাচ্ছে দ্বীপদেশ টুভালু
ডুবে যাচ্ছে দ্বীপদেশ টুভালু - ছবি : সংগ্রহ
‘টুভালু ইজ সিংকিং- টুভালু ডুবে যাচ্ছে।’ ১৯৯৩ থেকে দেশটি প্রতি বছর ০.৫ সেন্টিমিটার (০.২ ইঞ্চি) করে পানিতে তলিয়ে গেছে। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনের আগে সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের দেশের কথা বলছিলেন টুভালুর অর্থমন্ত্রী সিভ পিনিউ। ১১ হাজারের কিছু বেশি মানুষের দেশ টুভালু দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য। ৯টি ছোট ছোট এটল গঠিত দ্বীপের দেশ টুভালু। রিং আকারের প্রবাল প্রাচীরে গঠিত স্বাধীন দ্বীপ দেশ টুভালুর আয়তন ২৫.৯ বর্গকিলোমিটার। এই দেশটিরই উপকূল ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। টুভালুর সর্বোচ্চ ভূমিটির উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ১৫ ফুট (৪.৫ মিটার) উঁচু। প্রতিটা দ্বীপই সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৩ থেকে ১৬ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
দ্বীপবাসীর ৯৬ শতাংশই পলিনেশিয়ান। পলিনেশিয়ান নাচ-গান ও ঐতিহ্যবাহী হাতের কাজের জন্য টুভালু বিখ্যাত। প্রায় ২৬ কিলোমিটার আয়তনের দেশ হলেও প্রকৃতপক্ষে টুভালুর আয়তন ৫৯৫ বর্গকিলোমিটার। জলসীমার আয়তন ১৩ লাখ বর্গকিলোমিটার। টুভালুর অবস্থান ফিজির সুভা থেকে এক হাজার ৫০ কিলোমিটার উত্তরে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে চার হাজার কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে।
দেশটির রাজধানী ফুনাফাতি। প্রকৃত রাজধানীর কাজটি করা হয় ভেইয়াকু নামক গ্রামে থেকে। বেশির ভাগ সরকারি অফিস এই গ্রামেই হয়ে থাকে। ভেইয়াকু ফঙ্গালে দ্বীপের একটি গ্রাম। কিন্তু এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ফুনাফতিতে বাস করে। টুভালুর মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ বিদেশে চাকরি করে। পাশের আরেক ছোট দ্বীপ দেশ নাউরুর ফসফেট শিল্পে অথবা বিদেশী বাণিজ্যিক জাহাজে কাজ করে জনগণ। ১৯৭৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের আগে ব্রিটিশ গিলবার্ট অ্যান্ড এলিস দ্বীপ নামে পরিচিত ছিল টুভালু। আগের গিলবার্ট দ্বীপ এখন কিরিবাতি নামে স্বাধীন দেশ। বহির্বিশ্বের সাথে টুভালুর যোগাযোগ হয়ে থাকে ফুনাফুতি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের মাধ্যমে। এটাই টুভালুর একমাত্র বিমানবন্দর। ফিজি এয়ারওয়েজ নিয়মিত ফুনাফুতির সাথে বিমান যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। পাশের আরেক দ্বীপদেশ কিরিবাতি এয়ার সপ্তাহে একবার ফুনাফুতি যায়। টুভালুর অর্থনীতির পুরোটাই বিদেশীদের ওপর নির্ভরশীল। খাবার, জ্বালানি এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসে ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং জাপান থেকে। টুভালু অস্ট্রেলিয়ান ডলার ব্যবহার করে মুদ্রা হিসেবে। তবে টুভালুর মুদ্রার ভাঙা পয়সা (কয়েন) নিজেরা তৈরি করে। একটি মাত্র ব্যাংক রয়েছে এ দেশে যাতে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্ব রয়েছে। স্থলভাগে মটরসাইকেল দিয়ে চলাচল করা যায়। তবে হাতে গোনা অন্যান্য কিছু গাড়িও আছে। এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে সি প্ল্যান রয়েছে। এগুলো ব্যবহার হয় পর্যটকদের জন্য। পর্যটনে বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে।
সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশ টুভালু। প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন। ১৯৭৮ সালে ব্রিটেন থেকে দেশটি স্বাধীন হলেও ১৯৮৬ সালে দেশটির সংবিধান গ্রহণ করা হয়। সংবিধানে টুভালুয়ান কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে। ওয়েস্টমিনিস্টার ধরনের গণতন্ত্র চালু থাকলেও দেশটিতে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। টুভালুর সংসদের আসন সংখ্যা সংবিধান গ্রহণের শুরুতে ১২টি থাকলেও পরে সংশোধন করে ১৬টি করা হয়। ৮টি দ্বীপের প্রতিটি থেকে দু’জন করে ১৬ জনই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে পাস করে আসেন। ২০০৮ সালে রাজা অথবা রানীর পরিবর্তে নির্বাচিত প্রসিডেন্টের অধীন টুভালু শাসিত হবে কি না এ সংক্রান্ত একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল; কিন্তু জনগণ ভোটের মাধ্যমে তা নাকচ করে দেয়। তার মানে জনগণ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রেই আস্থাশীল। টুভালুর সরকারের প্রধান আইনজ্ঞের (অ্যাটর্নি জেনারেল) জন্যও সংসদে একটি আসন আছে; কিন্তু তিনি বিল পাসে কোনো ভোট দিতে পারেন না। একজন রাজ্যপালও (অমবুডসম্যান) আছে টুভালুতে। ১১ হাজার মানুষের মধ্যে ছয় হাজার মানুষই টুভালুর ভোটার। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ফুনাফুতি থেকে নির্বাচিত ক’সি নাতানু ১০-৬ ভোটে বিজয়ী হয়ে প্রধামন্ত্রী হয়েছিলেন।
ফুনাফুতি একটি সংরক্ষিত এলাকা। চার দিকে শান্ত শীতল আকাশের মতো নীল জলরাশি ডাইভারদের প্রিয় স্থান। টুভালুয়ান ভাষা ছাড়া ইংরেজি ভাষায়ও এখান মানুষ কথা বলেন। অসম্ভব সুন্দর এই দেশটির খাবারেও রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। সিদ্ধ অথবা কাঁচা মাছ, সিদ্ধ কলার খাবার ফুটি, ব্রেডফ্রুট (বাংলা অনুবাদ রুটি-ফল নয়, এটা এক ধরনের ফল) দিয়ে তৈরি খাবার পুলাকা, ফুয়াগা এদের প্রিয় খাবার। নারকেলের ক্রিম দিয়ে প্রিয় খাবারের নাম লোলো। গ্রীষ্মকালের ফল পেঁপে এবং কলা। দ্বীপটিতে কোনো নদী নেই। বৃষ্টির পানি এবং মাটির নিচ থেকে টিউবওয়েলের পানিই একমাত্র খাবার পানি। এই দ্বীপে বছরে আড়াই হাজার মিলিমিটার (১০০ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গড় তাপমাত্রা ২৭ থেকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমা বায়ু থেকে ঝড় হয়ে থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটি পানিতে তলিয়ে যেতে পারে এবং সে কারণে দেশটি একটি আইনী পথ খুঁজছে যেন দেশটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও সমুদ্রে এর মালিকানা বহাল থাকে। জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই টুভালু নামে যেন টিকে থাকতে পারে দেশটি। টুভালুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিমন কোফে বলেন, আমাদের দেশটা যদি ডুবে যায় এবং এরপর আমরা আমাদের দেশকে অন্য কোথাও স্থানান্তর করলেও সমুদ্রের পানিতে থেকেও যেন দেশটা টিকে থাকে এমন একটি আইনি কাঠামোর তৈরি করার চিন্তা করছি। আমরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিটাই চিন্তা করছি।’ জাতিসঙ্ঘের কপ-২৬ সম্মেলনে সিমন কোফে টুভালু পানিতে তলিয়ে যাওয়া অংশের হাঁটু পানিতে নেমে তার বক্তৃতার রেকর্ডিং করেন। সিমন কোফে যে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ভিডিও ফুটেজ দিয়েছেন সে স্থানটি এক সময় শুকনো ছিল। ক্রমেই প্রশান্ত মহাসাগরে ডুবে যাওয়া এই দ্বীপটি থেকে বিত্তবানরা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন; কিন্তু টুভালুকে ভালোবাসেন প্রবীণ যে জনগোষ্ঠী তারা এখানেই থাকতে চান। ডুবলেও এখানেই থাকতে চান, তারা চান পানিতেই যেন হয় তাদের শেষ কৃত্য। এ জন্য তারা কোনো আফসোস করবেন না। কারণ তারা তাদের প্রিয় টুভালুকে ভালোবাসেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে নিচের দিক থেকে চতুর্থ দরিদ্রতম দেশ টুভালু। দরিদ্র দেশগুলোর অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো সেখানে আইনের শাসন থাকে না। সর্বত্র আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। সমাজটাই অপরাধ প্রবণ হয়ে থাকে কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে। কিন্তু পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ হলেও টুভালুতে অপরাধ নেই বললেই চলে। এর আরেকটি কারণ হলো জনসংখ্যা কম, এখানে সবাই সবাইকে চিনে। তা ছাড়া সবগুলো পর্যটন প্রধান দেশেই অপরাধ কমিয়ে রাখা হয়।
দেশটি পানিতে তলিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে টুভালুর অর্থমন্ত্রী সিভ পিনিউ কপ-২৬ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতি বছরই আমাদের ভূমি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দুঃখের কথা বিশ্ববাসীকে শোনাতে আমি এখানে এসেছি। পৃথিবীবাসীর এখন সময় এসেছে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার। টুভালুর ডুবে যাওয়ার বিষয়টি পরের বছরের এজেন্ডাভুক্ত করার সময় এখন নয়। টুভালুর ভূমির নিচে পানির স্তরে পৌঁছে গেছে লবণাক্ততা। আগে যেখানে পানি উঠত না, এখন সেখানেও পানি এসে গেছে।’ সিভ পিনিউ বলেন, ‘সাইক্লোনের সময় জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যাচ্ছে আমাদের ভূমি, আগে এমন ঘটেনি। আমাদের ভূখণ্ড জলমগ্ন হয়ে যাচ্ছে। যেখানে আগে আমরা ফল, সবজি ফলাতাম যেখানে কৃষিকাজ করতাম সেখানে এখন পানি উঠে গেছে।’
নদী কিংবা মিষ্টি পানির কোনো কূপ না থাকায় টুভালুর অধিবাসীরা বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা পান করেন। বিকল্প হিসেবে সমুদ্রের পানিকে লবণমুক্ত করতে ‘ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট’ বাসনো হয়েছে। এ জন্য প্রচুর ডিজেল আমদানি করতে হয়। খুবই সীমাবদ্ধ অর্থনীতির দেশ বলে ডিজেল আমদানি করাটাও তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। কৃষিজ দ্রব্যও এখন ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। আগে প্রচুর মাছ পাওয়া গেলেও এখন মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। খাদ্য নিরাপত্তা বিপজ্জনকভাবে হুমকির মুখে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় টুভালু এবং অন্যান্য দ্বীপবাসীর অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন। ভারতের পাশে সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপের একই অবস্থা হবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরেকটু বেড়ে গেছে। পানি যেন ছুতে না পারে, ভেতরের আসবাব ও অন্যান্য কিছুতে যেন সমুদ্রের পানি স্পর্শ করতে না পারে সেজন্য টুভালুবাসী ঘরগুলো বানিয়েছেন উঁচ খুঁটির উপরে। ২০২০ সালে সঙ্ঘটিত ক্যাটাগরি-৪ মানের সাইক্লোন ‘টিনু’ ছিল সর্বকালের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় যা টুভালুর উপর দিয়ে বয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় টিনুর আঘাতে সেই উঁচু করে তোলা বাড়ি-ঘরগুলো ভেঙে নিয়ে গেছে, সেই সাথে একান্ত ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও ধূয়ে নিয়ে গেছে। এমনিক মজবুত শিকড় সংবলিত ফসলও ধুয়ে নিয়ে গেছে।
টুভালু টিকে থাকার জন্য একটি ব্যয় বহুল প্রকল্প হাতে নিতে চায়। তারা বলছে, জাতিসঙ্ঘ তাপমাত্রা এই শতাব্দীর মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ধরে রাখার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে পানির নিচে টুভালুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়াকে ঠেকাতে পারবে না। এ অবস্থায় টুভালু মালদ্বীপের মতো তাদের ভুখণ্ডে বালু দিয়ে উঁচু করতে চায়। তারা সমুদ্রের নিচ থেকে বালু তুলে প্রবাল দ্বীপটিতে নিয়ে আসতে চায় এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তাদের ছোট দেশটিকে উঁচু করে ফেলতে চান প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেন পানির উচ্চতা বাড়লে তাদের ভুখণ্ডকে ডুবিয়ে দিতে না পারে। এটি একটি উচ্চাকাক্সিক্ষ প্রকল্প হলেও টুভালুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোফে বলছেন- এটাই একমাত্র বিকল্প সমাধান যদিও তা ব্যয় বহুল। তিনি বলেন, আমরা টুভালু ত্যাগ করতে চাই না, টুভালুকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চাই না অথবা অভিবাসিতও হতে চাই না। কারণ টুভালুই আমাদের সংস্কৃতির অংশ, আমাদের পরিচয় এবং আমাদের ঐতিহ্য। আমরা আমাদের সংবিধান সংশোধন করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছি রাষ্ট্র হিসেবে যেন তা স্থায়ীত্ব পায়। সমুদ্র পৃষ্ঠ যতোই উঁচু হোক না কেন তা যেন চিরদিন টুভালু রাষ্ট্রই থাকে সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে আমরা একটি নতুন নজির স্থাপন করতে যাচ্ছি। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলেও আমরা সে আইনের অধীনে আমাদের সার্বভৌম ভুখণ্ডের দাবি স্থায়ী করে যাবো।