বাংলাদেশ সম্পর্কে যা বলেছেন ইবনে বতুতা
বাংলাদেশ সম্পর্কে যা বলেছেন ইবনে বতুতা - ছবি : সংগ্রহ
উত্তর আফ্রিকার প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বাংলাদেশ ভ্রমণ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি প্রায় দু’মাসব্যাপী বেশির ভাগ সময় নদীপথে বাংলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘আর-রেহলা’ চতুর্দশ শতকের বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটি নির্ভরযোগ্য বিবরণ সরবরাহ করে। তৎকালীন ধর্মীয় অবস্থার রেখাচিত্র এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। সে সময়ের বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ইবনে বতুতার নিজস্ব মন্তব্য রয়েছে। তিনি নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের একটি তালিকা সংযোজন করেন তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে। তার বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়, চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গকে ‘বাঙ্গালা’ বলা হতো। এ অঞ্চলের অধিবাসীরা ‘বাঙ্গালী’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে ‘বাঙলা’ ও ‘বাঙালী’ শব্দ দু’টি এ অঞ্চলের সাথে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।
ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ছিলেন তখন বাংলার সুলতান এবং তার রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। তিনি প্রজাহিতৈষী শাসক ও অতিথিদের প্রতি অত্যন্ত সদয় ছিলেন বলে ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন। ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে মালদ্বীপ থেকে ৪৩ দিনে চট্টগ্রামের পথে বাংলায় প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রথম প্রবেশ করি তার নাম ‘সোদকাওয়ান’। এটা সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত একটি বড় শহর। মুদ্রাতত্ত্ববিদ ড. নলিনী কান্ত ভট্টশালী ও ড. আবদুল করিমের মতো বরেণ্য ইতিহাসবিদ ‘সোদকাওয়ান’কে চট্টগ্রাম বলে উল্লেখ করেন (এইচ এ আর গীব-ইবনে বতুতা, পৃষ্টা-৬১২, ড. এন কে ভট্টশালী- কয়েনস অ্যান্ড ক্রোনলজি অব আরলি ইনডিপেনডেন্ট সুলতান অব বেঙ্গল, পৃষ্ঠাÑ১৪৫-১৪৯, ড. আবদুল করিম- সোশ্যাল হিস্টোরি অব দি মুসলিমস ইন বেঙ্গল, পৃষ্টা-৩২)। অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস (১২০৪-১৫৭৬) পৃষ্ঠা-১৯৮, ৬০৫; ড. এম এ রহীম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রথম খণ্ড,পৃষ্ঠা-৩)
ইবনে বতুতা বাংলাদেশে এসে প্রথমে চট্টগ্রাম প্রবেশ করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে তিনি অনেক সমুদ্রগামী জাহাজ দেখতে পান। তাতে বোঝা যায় যে, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। তিনি একমাত্র হজরত শাহ জালালের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট রওনা হন। তার বর্ণনায় শায়খের কৃচ্ছ্রতা, সংযম, নিষ্ঠা ও সেবাধর্মী জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। ইবনে বতুতা বর্ণনা করেন, আমি ‘সোদকাওয়ান’ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম। ওই পর্বতমালাতে আমার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল একজন দরবেশকে দর্শন করা। আমি যখন আসাম অঞ্চলে প্রবেশ করি দরবেশ তখন স্বজ্ঞালব্ধ জ্ঞানে আগমনবার্তা জানতে পেরে চারজন লোক পাঠান আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে। দরবেশের খানকাহ থেকে চার দিনের দূরত্বে থাকতেই তারা আমার সাথে সাক্ষাত করে জানান, দরবেশ তাদের পাঠিয়েছেন আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য। তাদের সমভিব্যহারে আমি যখন শায়খের সম্মুখে উপস্থিত হই, তিনি দাঁড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানান। বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি আমার দেশ কোথায় এবং সফরের উদ্দেশ্য কি জানতে চান। অতঃপর তিনি আমাকে সসম্মানে আপ্যায়নের জন্য তাদের নির্দেশ দেন।’(এইচ এ আর গীবÑইবনে বতুতা, পৃষ্ঠাÑ৬১২-৬১৩); অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস (১২০৪-১৫৭৬) পৃষ্ঠা-৬০৭)। ইবনে বতুতার ভাষ্য মতে, এ শায়খ ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ বুজুুর্গ, তার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ। তার কেরামত এবং মহৎ কর্মগুলো জনসাধারণ্যে সুপরিচিত। অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এ দরবেশ ছিলেন ক্ষীণদেহ, দীর্ঘকায় ও বিরল শ্মশ্র“। তিনি প্রায় ৪০ বছর রোজা রাখেন। ১০ দিন অন্তর রোজা খুলতেন। তিনি একটি গাভী পুষতেন। এর দুধই ছিল তার খাদ্য। তিনি সারা রাত ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এ ফকির প্রতিদিন প্রভাতে মক্কায় তার প্রভাতী নামাজ স¤পন্ন করতেন। দিবসের অবশিষ্টকাল তিনি পর্বত কন্দরেই অবস্থান করতেন। এ ছাড়া প্রতি বছর ঈদ উপলক্ষে মক্কায় গমন করতেন। ইবনে বতুতা আরো বলেন, এ শায়খের শ্রমের ফলে ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা ইসলামে দীক্ষিত হয়। এ জন্য তিনি তাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেন। সেখানের এক পর্বত কন্দরে তিনি ‘খানকাহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই খানকাহ ছিল সাধু, দরবেশ, পরিব্রাজক ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত। তার জন্য খাদ্যদ্রব্যসহ নানা সামগ্রী উপহার আনত। এসব উপহার সামগ্রী দিয়ে তার আস্তানায় বহু লোককে খাওয়ানো হতো। তার অনুসারীরা পরবর্তী সময়ে ইবনে বতুতাকে জানান যে, এ দরবেশ ১৫০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন (ইবনে বতুতা, পৃষ্ঠা-১৪৪-১৪৫); ড. এনামুল হক, বঙ্গে সুফি প্রভাব,পৃষ্ঠা-৯৮)
সিলেটে তিন দিন অবস্থান শেষে ইবনে বতুতা মেঘনা দিয়ে সোনারগাঁও আসেন ১৫ দিনে। নদীপথের ভ্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘নদীর দু’ধারে ডানে ও বামে ছিল বহু উদ্যানরাজি ও অসংখ্য গ্রাম, অনেকটা মিসরের নীল নদপথের মতো। আমরা ১৫ দিন ধরে গ্রাম ও উদ্যানরাজির মধ্য দিয়ে নদীপথে চললাম, মনে হয়েছিল যেন আমরা একটি বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।’ সোনারগাঁ ছিল সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের অধীন তৎকালীন বাংলার রাজধানী এবং মুদ্রা তৈরির টাকশাল। রাজধানীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অতি সুদৃঢ় ছিল বলে ইবনে বতুতা সোনারগাঁকে দুর্ভেদ্য নগরী রূপে উল্লেখ করেন। মুসলমান রাজত্বের প্রথম দিকে সোনারগাঁকে দেখা যায় একটি প্রসিদ্ধ ও সমৃদ্ধশালী শহর ও বন্দর রূপে, যেখানে বৈদেশিক বাণিজ্য পোতসমূহ পণ্যদ্রব্যের জন্য আগমন করত। ইবনে বতুতা বলেন, ‘সোনারগাঁওয়ে আগমনের পর আমরা একটি চীন দেশীয় পালতোলা তলদেশ চেপটা বাণিজ্য জাহাজ দেখতে পেলাম। জাহাজটি জাভা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সোনারগাঁ থেকে জাভার দূরত্ব ৪০ দিন।’(এইচ এ আর গীব, ইবনে বতুতা, পৃষ্ঠা-৬১৫)।
ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনী থেকে জানা যায়, সে সময় বাংলাদেশ ইসলাম ধর্ম প্রচারের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু দরবেশ, ফকির ও উলামা বাস করতেন। বাংলাদেশে তখন তাদের বেশ প্রতিপত্তি ছিল। বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ফকির দরবেশদের অত্যন্ত ভক্তি করতেন। সাধারণ জনগণের কাছেও তারা শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। সুফি দরবেশদের নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। নৌকায় যাতায়াত করলে তাদের ভাড়া দিতে হতো না, তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও বিনামূল্যে সরবরাহ করা হতো। ফকিররা কোনো শহরে প্রবেশ করলে অর্ধ দিনার দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হতো (তারিখ-ইফিরুজশাহী, পৃষ্ঠাÑ৯১; কে এম রাইছউদ্দিন খান, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা, পৃষ্ঠা-২৭৭)
ইবনে বতুতা বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর যে মন্তব্য করেন, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘মুসলমানদের ধর্মের গোঁড়ামি যেমন হিন্দুদেরকে তাদের প্রতি বিমুখ করেছিল, হিন্দুদের সামাজিক গোঁড়ামিও মুসলমানদের তাদের প্রতি সেরূপ বিমুখ করেছিল। হিন্দুরা মুসলমানদের অস্পৃশ্য, ম্লেচ্ছ, যবন বলে ঘৃণা করত, তাদের সাথে কোনো প্রকার সামাজিক বন্ধন রাখত না। গৃহের অভ্যন্তরে তাদের প্রবেশ করতে দিত না, তাদের স্পৃষ্ট কোনো জিনিস ব্যবহার করত না। তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পানি চাইলে বাসন অপবিত্র হবে বলে হিন্দু তা দেয় না, ইবনে বতুতা এরূপ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তার সপক্ষে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে হিন্দুরা যেমন নিজেদের আচরণ সমর্থন করত, মুসলমানরাও তেমনি শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংসের সমর্থন করত। বস্তুত উভয় পক্ষের আচরণের মূল কারণ একই যুক্তি ও বিচার নিরপেক্ষ ধর্মান্ধতা কিন্তু ন্যায্য, হোক বা অন্যায্য হোক পরস্পরের প্রতি এরূপ আচরণ যে উভয়ের মধ্যে প্রীতির সম্বন্ধ স্থাপনের দুস্তর বাধা সৃষ্টি করেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক দিন যাবৎ অভ্যস্ত হলে অত্যাচারও গা-সওয়া হয়ে যায়, যেমন সতীদাহ বা অন্যান্য নিষ্টুর প্রথাও হিন্দুর মনে এক সময়ে কোনো বিকার আনতে পারত না। হিন্দু-মুসলমান ও তেমনি এ সব সত্ত্বেও পাশাপাশি বাস করেছে কিন্তু দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃভাব তো দূরের কথা স্থায়ী প্রীতির বন্ধনও প্রকৃতরূপে স্থাপিত হয়নি।’ (ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ,পৃষ্ঠা : ৩২৪-৩২৫)।
ইবনে বতুতা পশ্চিমে মরক্কো থেকে সুদূর চীন পর্যন্ত অনেক দেশ ও সমৃদ্ধ অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। তিনি বিখ্যাত নগরী কায়রো, বসরা, শিরাজ, ইসফাহান, বুখারা, সমরকন্দ, তিরমিজ, বালক, হিরাত, বেইজিং পরিদর্শন করেন, কিন্তু বাংলার মতো ধানের প্রাচুর্য এবং জিনিসপত্রের এত স্বল্পমূল্য তিনি আর কোথাও দেখেননি। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনীতে নিত্য ব্যবহার্য কিছু দ্রব্যের দাম উল্লেখ করেন কিন্তু তা বর্তমানে টাকার হিসাবে নির্ণয় করা কঠিন। বিগত কয়েক শ’ বছরে স্বর্ণ ও রৌপ্যের দাম অনেক পরিবর্তিত হয়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, এ কথা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। তিনি দিল্লির রৎল বা ওজনের পরিমাপ অনুযায়ী দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করেন। এক রৎলের ওজন প্রায় ২৮.৮ পাউন্ড বা বঙ্গের ওজনের ১৪ সেরের সমান। একটি স্বর্ণ দিনার ছিল ১০টি রৌপ্য দিনারের সমান মূল্যবান এবং একটি রৌপ্য দিনার ছিল আট দিরহামের সমতুল্য অর্থাৎ বর্তমান এক টাকার সমান। এসব দিক বিবেচনা করে প্রফেসর নীরদ ভূষণ রায় ১৯৪৮ সালে ইবনে বতুতার সময়ের জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক পর্যালোচনাপূর্বক নির্ধারণ করেন।
নিম্নলিখিত তালিকা থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর দ্রব্যমূল্যের একটি চিত্র পাওয়া যাবে-
চাল আনুমানিক আট মণ (২৫ দিল্লির রৎল) ৭ টাকা
ধান ” ২৮ ” ( ৮০ ” ” ) ৭.০০ টাকা
ঘি ” ১৪ সের ( ১ ” ” ) ৩.৫০ টাকা
তিলের তেল ” ১৪ সের ( ১ ” ” ) ১.৭৫ টাকা
গোলাপজল ” ১৪ সের ( ১ ” ” ) ৭.০০ টাকা
চিনি ” ১৪ সের ( ১ ” ” ) ৩.৫০ টাকা
আটটি তাজা মুরগি ০.৮৮ টাকা
আটটি তাজা ভেড়া ০.৭৫ টাকা
একটি দুগ্ধবতী গাভী ২১.০০ টাকা
১৫টি পায়রা ০.৮৮ টাকা
১৫ গজ সূক্ষ্ম সুতি কাপড় ১৪.০০ টাকা
ইবনে বতুতা আরো জানান, সেই সময় সুতি কাপড় ছিল বাংলার অন্যতম রফতানি পণ্য। সোনারগাঁ থেকে দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দূত হিসেবে চীন যাওয়ার পথে ১৫ দিন পর তার জাহাজ বারাহনাকার নামের স্থানে পৌঁছলে তিনি কিছু মুসলিম অধিবাসীর সন্ধান পান, যারা বাঙ্গালা থেকে উন্নত সুতি বস্ত্র এনে সেখানে বিক্রি করে। এখান (সোনারগাঁ) থেকে প্রচুর পরিমাণে সুতিবস্ত্র বিদেশে যায় এবং প্রচুর চাল পুরো ভারত, সিংহল, পেগু, মালাক্কা, সুমাত্রা এবং অন্যান্য স্থানে পাঠানো হয়।
ইবনে বতুতা বাংলার গ্রামীণ জনপদের নৈসর্গিক রূপমাধুর্য, শ্যামল শোভা ও ফলশোভিত বৃক্ষরাজি হৃদয় মন দিয়ে উপভোগ করেন। নদী বক্ষ ও তটপ্রান্ত থেকে নগর জীবন অপেক্ষা পল্লী বাংলার জীবনধারাকে অধিকতর উপলব্ধি করার সুযোগ পান। প্রধানত জলপথেই দেশের বাণিজ্য চলাচল হতো এবং নদীগুলোতে নৌযান শ্রেণিবদ্ধভাবে চলত। ইবনে বতুতা বলেন, ‘বঙ্গদেশের নদীতে অসংখ্য নৌকা চলাচল করে। প্রত্যেক নৌকায় একটি করে ডঙ্কা থাকে। যখন নৌকাগুলো পরস্পর অতিক্রম করে তখন ওই সব নৌকা থেকে ডঙ্কাধ্বনি করা হয়- পরস্পর সম্মান বিনিময় হয়। সম্ভবত জলদস্যুতা নিবারণের জন্য এ রূপ ব্যবস্থা ছিল।’ মুসলমান আমলে বাংলাদেশে দাস প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতা যখন বাংলাদেশ পরিভ্রমণে আসেন তখন তিনি বাজারে দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয় হতে দেখেন।
তিনি লিখেছেন, ‘উপপত্মীরূপে সেবাকর্মের উপযুক্ত একটি সুন্দরী যুবতীকে এক স্বর্ণ দিনারে আমার সামনে বিক্রি করা হয়। একটি স্বর্ণ দিনার মরক্কোর স্বর্ণ দিনারের ২.৫০ দিনারের সমান। আমি ‘আশুরা’ নামি একটি যুবতী দাসীকে প্রায় একই মূল্যে ক্রয় করি। দাসীটি অসাধারণ সুন্দরী ছিল। আমার সঙ্গীদের একজন এক স্বর্ণ দিনারে ‘লুলু’ নামে একটি ছোট সুন্দর ক্রীতদাস ক্রয় করেন।’(গীব, ইবনে বতুতা, পৃষ্ঠা-২৭১)।
মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও খাদ্যদ্রব্যের প্রাচুর্যের জন্য বিদেশীরা বাংলাদেশকে খুব পছন্দ করলেও তারা এই দেশের আবহাওয়া মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। বর্ষাকালে পানিবাহিত রোগ ব্যাধিতে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ত। তাই খুরাসানবাসী ইবনে বতুতার কাছে বাংলাদেশকে অভিহিত করেন ‘দোজখপুর আজ নিয়ামত’ বা ধন-ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এক নরক রূপে অভিহিত করেন। পরবর্তী বহু ঘটনায় ইবনে বতুতার উপর্যুক্ত মন্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি সম্রাট আকবরের রাজত্বের প্রথম দিকে দ্বিগুণ বেতন দিলেও মুঘল সেনারা বাংলায় চাকরি করতে পছন্দ করত না। ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনী বাংলার জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তার বর্ণিত তথ্যবিবরণী পরবর্তী পর্যায়ে বাংলায় আসা পর্যটক ও ইতিহাসবিদরা সত্য বলে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com