ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের অভিলাষ
ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের অভিলাষ - ছবি : সংগ্রহ
ইউক্রেন পরিচিত ‘ইউরোপের শস্যভাণ্ডার’ হিসেবে। এখন সে দেশের পরিচিতি ‘ইউরোপের অস্ত্রভাণ্ডার’ হিসেবে। ইউক্রেনে রাশিয়া ও আমেরিকার প্রক্সিযুদ্ধ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। তা দু’বৃহৎ শক্তির প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৌনে এক শতক পরে আরেক বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অবতারণা করতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। তবে অনেকে মনে করেন, উভয় পক্ষের কাছেই পারমাণবিক হাতিয়ার থাকায় এবং আরো কোনো কোনো কারণে শেষাবধি মহাযুদ্ধ বাধবে না। তবে ইউক্রেন নিয়ে পরিস্থিতি যে খুব উত্তপ্ত এবং এর প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী তা নিঃসন্দেহ। ‘দাঁতাত’ মানে যেন ইউক্রেন নিয়ে মস্কো আর ওয়াশিংটনের দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধে কিড়মিড় করা। হুমকি-পাল্টা হুমকি, প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ হোক বা না হোক, ‘শীতল যুদ্ধ’ নতুন করে উষ্ণতা নয়, একেবারে উত্তাপ সঞ্চার করছে এবং স্নায়ুযুদ্ধের পুনরাবৃত্তি শান্তিকামী দুনিয়াবাসীর স্নায়ুর ওপর বিষম চাপ দিচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইদানীং বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ইউক্রেনের দিকে, যেমনটা হয়েছিল ২০১৪ সালে সে দেশের ভাগ্য নিয়ে রাশিয়া-আমেরিকার রশি টানাটানির সময়ে।
রাশিয়া তার পূর্বসূরি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের সমাজবাদে বিশ্বাসী নয় এখন। তবে পুঁজিবাদী হয়েও সে বিশ্ব পুঁজিবাদের কাণ্ডারী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে কথা বলছে না। আমেরিকা যতই নিজের জাতীয়তাবাদ নিয়ে উগ্র হয়ে উঠুক না কেন, রাশিয়াও তার জাতীয়তাবাদী উগ্রতা ও একগুঁয়েমি নিয়ে কম যায় না। ওয়াশিংটন মনে করে, মস্কো আসলে কমিউনিজম থেকে পতিত হয়ে অধঃপতিত ধনবাদকে আঁকড়ে ধরেছে। আর মস্কোর ক্রেমলিনের বিশ্বাস, ‘রাশিয়া আবার অতীতের মতো জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে রুশ সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। জার সম্রাট না থাকলে কী হবে, মহান পিটারের স্থানে না হয় ‘মহান পুতিন’ থাকছেন এ যুগে’। দেখা যাক, কেজিবির গোয়েন্দা স্বভাবের কুখ্যাতি কতটা ত্যাগ করা যায় এবং মস্কো কতখানি হতে পারে মানবিক।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বর্তমান সর্বাধিক গুরুত্ববহ ইস্যু ইউক্রেন। ইউক্রেনকে রাশিয়া তার অংশের মতো ব্যবহার করতে চায়। কারণ, দেশটির রাশিয়ার ‘সীমান্ত দেয়াল’ তুল্য। মস্কোতে ক্ষমতায় আছেন ‘ভ্লাদিমির’ পুতিন আর কিয়েভের ক্ষমতায় ‘ভলদিমির’ জেলেনস্কি। আসলে রুশ ‘ভ্লাদিমির’ই ইউক্রেনীয় ভাষায় খানিক বদলে গেছে। দু’দেশই মূলত স্লাভ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এবং সিরিলিক বর্ণমালার অনুসারী। তাই আরেক স্লাভ জনপদ সার্বিয়াকে তার গণহত্যায় রাশিয়া সমর্থন দিয়েছিল জোরেশোরে এবং স্বেচ্ছাসেবী সার্বরা যুদ্ধ করেছে ইউক্রেনের রুশপন্থীদের হয়ে। কথায় বলে, ‘রতনে রতন চেনে।’
রাশিয়া জানে, ইউক্রেনে তার সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া নতুন করে বিশ্ব সঙ্কটের জন্ম দিতে পারে। কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া নয় যে, প্রতিপক্ষ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কেবল প্রক্সি দেবে। ইউক্রেনের গুরত্ব রাশিয়া ও আমেরিকা- দু’রাষ্ট্রের কাছেই অনেক। রাশিয়া ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যেতে দিতে চায় না আর আমেরিকার কাছে ন্যাটো হলো তার কলিজার মতো গুরুত্বপূর্ণ। তবে আফগান ফ্রন্ট থেকে সরে এসে এখন আমেরিকা আহত বাঘের মতো থাবা চাটছে হয়তো। তাই শিগগরিই তার পক্ষে নতুন করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া হয়তো সম্ভব হবে না। মোট কথা, ইউক্রেন তারও মাথাব্যথার মতো, যেমনি রাশিয়ার উৎকণ্ঠার শেষ নেই ইউক্রেন নিয়ে।
অনেকের শঙ্কা, ইউক্রেন নিয়ে শেষাবধি দু’বৃহৎশক্তির বৃহৎ লড়াই বেধে যাবে। কারণ ইউক্রেনকে, তথা এ দেশটার পাশ্চাত্যপন্থী বর্তমান সরকারকে নিরাপত্তা দেয়া মার্কিন বাইডেন প্রশাসনের একটি বড় রকম দুশ্চিন্তা। অপরদিকে, রাশিয়া ইউক্রেন হারাতে চায় না কিছুতেই। যদি ইউক্রেনে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব না হয়, তা হলে মস্কো আগ্রাসী হওয়াও বিচিত্র নয়। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ রুশপন্থীদের জবরদখলে। রাশিয়া তার ছদ্ম গণতান্ত্রিক নেতা পুতিনের চিন্তাধারা বাস্তবায়নে মরিয়া। তিনি তার কর্মকাণ্ডে কেজিবির সাবেক গুপ্তচরের মতোই ভূমিকা রাখছেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা চান না- না ঘরে, না বাইরে এবং ক্ষমতা ধরে রাখতে ইচ্ছুক একেবারে অশীতিপর হওয়া নাগাদ একটানা। যা হোক, ইউক্রেনে রাশিয়া তা-ই করছে, ইয়েমেনে দু’টি রাষ্ট্র যা করে চলেছে। তার নাম ‘প্রক্সি ওয়্যার।’ রাশিয়া চায়, তার প্রতিপক্ষকে আইনের ফাঁদে ফেলে স্বার্থ পূরণ করতে। এ জন্য তার কথা, মস্কো এবং ওয়াশিংটনকে আইনি বাধ্যতামূলক ওয়াদায় স্বাক্ষর দিতে হবে এবং পরস্পরকে হুমকি মনে করা যাবে না। সে সুকৌশলে আমেরিকাকে কোণঠাসা করতে চাচ্ছে। মস্কো খুব ভালো করেই জানে, পরমাণু অস্ত্রসজ্জা হচ্ছে আমেরিকার একটি ব্লাকস্পট বা কলঙ্ক। তাই তার দাবি, সে ও তার প্রতিপক্ষ বিদেশে কোনো পারমাণবিক সমরাস্ত্র মোতায়েন যেন না করে বরং মোতায়েনকৃতগুলো ফিরিয়ে আনে। মার্কিন প্রশাসন এখন কী করে, দেখার বিষয়। তবে তারাও সুকৌশলে তাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য না হলেও ইউক্রেন থেকে এর পক্ষে সব সার্ভিস আদায় করে নেবে। একদিকে দেখাবে, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হয়নি; অন্যদিকে ন্যাটোকে কার্যত রাশিয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দেবে যাতে মস্কোকে উত্যক্ত করে নিজে ‘নিরাপদ’ থাকা যায়।
সোভিয়েত আমলে মূল রাশিয়ার পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে ছিল দু’টি বড়’ প্রজাতন্ত্র- পশ্চিমে মূলত খ্রিষ্টান অধ্যুষিত ইউক্রেন আর পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাজাখস্তান। তবে মস্কো কাজাখ মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটালেও পরমাণু মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত করে তুলেছিল আসলে ইউক্রেনকে। ১৯৮৫ সালের চেরনোবিল পরমাণু ভাণ্ডারে মহাবিস্ফোরণ (যাকে দুর্ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়) ইউক্রেনের জন্য ছিল অপূরণীয় ভয়াবহ ক্ষতি। এই বিরাট ভূখণ্ডের ‘ইউক্রেন’ নামের অর্থ প্রকৃতপক্ষে ‘সীমান্ত ভূমি’ বলে অনেকে মনে করে থাকেন। বাস্তবেও ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ছিল যা সীমান্ত নির্দেশ করত ডজন খানেক বা বহু রাষ্ট্রের সাথে। এখন রাশিয়া একে ব্যবহার করতে চায় তার ‘সীমানা দেয়াল’ হিসেবে। অতীতে বহুবার বহু বৈদেশিক শক্তির অধীনে যাওয়া ইউক্রেন এখন পাশ্চাত্য ও রুশ- উভয় বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তবে তা ‘বানরের পিঠা ভাগে’র মতো কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ এবং ওডেসা বন্দর খ্যাতনামা। এ দেশের সাবেক ভূখণ্ড ক্রিমিয়ার রাজধানী সেমফারোপোল, জেপোরোজিয়ে, ডোনেৎস্ক, প্রভৃতি স্থানও উল্লেখযোগ্য। ওডেসায় লেখাপড়া করেছেন বাংলাদেশের কিছু শিক্ষার্থী।
জেপোরোজিয়ের একটি ঘটনা বলতে হয় প্রসঙ্গক্রমে। আমার পরিচিত এক রসায়নবিদ ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন ওই শহরে। তখন সোভিয়েত আমলের শেষ দশক। তবুও ধর্ম নিয়ে কড়াকড়ি। ধর্মকর্মকে কেজিবির গোয়েন্দারা মনে করতেন ‘বাড়াবাড়ি’। তিনি জানালেন, তারা নামাজ আদায়ের সময়ে সরকারের লোকজন কঠোর নজরদারি করতেন তাদের ওপর। সম্ভবত তখন মিখাইল গর্বাচেভের পূর্বসূরি কমরেড কনস্তানতিন শেরনেঙ্কোর শাসনামল। তবে কয়েক বছরেই ধসে পড়ে সোভিয়েত নাস্তিক্যের ৭৪ বছর বয়সী প্রাসাদ আর সে দেশে মানুষ ফিরে যায় নিজ নিজ ধর্মের দিকেই। এখন রাশিয়াতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী খ্রিষ্টান। এর পরই মুসলমানের স্থান (প্রায় ২০ কোটি) যে কারণে ভ্লাদিমির পুতিন চান, রাশিয়াকে যেন ওআইসির সদস্য করা হয়।