কালজ, কালোত্তর চিন্তক
শাহ আবদুল হান্নান - ছবি : সংগ্রহ
সংস্কৃতি নিয়ে তর্ক অনেক পুরনো। আর্ট ফর আর্টস সেক, না আর্ট ফর লাইফ সেক! শিল্প-সংস্কৃতি জীবনের জন্য না শিল্প শিল্পের জন্য। কমিউনিস্টদের তরফে জোর দেয়া হলো, শিল্প-সংস্কৃতি হবে জীবনের জন্য। কলাবাদীরা জোর দিলেন সৌন্দর্যিক চেতনা ও এর পরিশীলনের উপর। তাদের মনে হলো, যা কিছুই সুন্দর করে এবং জীবনের নানা দিককে সজ্জিত করে, ‘সাহিত্য-কলায় তাই সংস্কৃতি।’
কিন্তু আর্টের জন্য জীবনকে কিংবা জীবনের জন্য আর্টকে উপেক্ষা করতে হবে কেন? আর্ট জীবনের জন্য, ব্যক্তি ও সমাজের জন্যই হবে, একে বাদ দিয়ে নয়। আবার জীবন তো নিজেই এক আর্ট। সে কখন, কোথায় আর্টকে উপেক্ষা করে এগুলো? ফলে জীবন চাই, আর্টও চাই।
সংস্কৃতি নিয়ে এই তর্কে কলম ধরলেন শাহ আবদুল হান্নান। লিখলেন, ‘সংস্কৃতি গোটা জীবন ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। সংস্কৃতি একটি জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তার যেমন অনেক দিক বা ডাইমেনশন রয়েছে, তেমনি সর্বোপরি এটি জীবনকে সার্ভ করতে হবে। সৌন্দর্যকেও সার্ভ করতে হবে। আবারো বলি, এটিকে সুন্দরও হতে হবে, জীবনের জন্যও হতে হবে।’
এই যে সুন্দরের পাওনা সুন্দরকে দেয়া, জীবনের পাওনা জীবনকে দেয়া, শাহ আবদুুল হান্নানের শিল্প ও বাস্তববোধের বিঘোষক। এই বোধে ছিল সমন্বয়ের নৈয়ায়িকতা। ন্যায়তত্ত্ব বা কলাকে তিনি আপন বিষয় ধরে স্থির হননি কখনো। তার স্থিরতা ছিল ইসলামের জীবনবাদিতায়। এরই হাত দিয়ে তিনি রচনা করেন রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, অধিবিদ্যা, অর্থনীতি, আইন ও ধর্মতত্ত্বের এমন অবলোকন, যা যুগপৎ গতিশীলতা ও ঐতিহ্যের প্রতি প্রজ্ঞাপ্রসূত নিবেদনে ঋদ্ধ।
তার এই অবলোকন বহিরাবরণের দর্শনে সীমিত ছিল না। বরং দৃশ্যের তলায় যে সুগোপন সম্পদ, তাকে অনুসন্ধান করেছে ক্লান্তিহীনভাবে। অতএব আল্লাহর আয়াতকে তিনি আল কুরআনে যেমন পড়তেন, তেমনি নিখিলের সব চরাচরে এবং নিজেতেও পড়তেন। আয়াতে তানজিলি তথা নাজিলকৃত কুরআনের আয়াত এবং আয়াতে তাকবিনি তথা সৃষ্টিতত্ত্বে নিহিত নিদর্শনের মিলিত মোহনায় আপন জ্ঞানতত্ত্ব ও জ্ঞানপ্রস্তাবনা তিনি পেশ করেন। যা সৃষ্টিজগত ও জীবনের বস্তুগত বাস্তবতাকে যেমন যথাস্থান দেয়, তেমনি বিশ্বাসগত, নৈতিক-আধ্যাত্মিক মূল্যমানসমূহকে দেয় প্রতিষ্ঠা। নিখিলের সর্বত্র স্রষ্টার প্রজ্ঞা যে ঐক্য রচনা করেছে, তাকে তিনি জ্ঞানের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করতেন। ফলে জ্ঞানের সাথে জ্ঞানের দ্বন্দ্ব তার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তাওহিদুল উলুম তথা জ্ঞান-শাস্ত্রসমূহের একত্ব ও ঐক্য ছিল তার বাস্তবদৃষ্টির এমন প্রত্যক্ষণ, যার সাক্ষ্য নিহিত আছে প্রতিটি শাস্ত্রের অস্তঃসারে।
অতএব ধর্ম ও বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শন, ধর্ম ও কলার দ্বন্দ্ব একটি এমন অসুস্থতা হিসেবে তিনি ধরতে সক্ষম হলেন, যার সূচনা অজ্ঞতার গর্ভে। সাধারণভাবে তাকে ইসলামিক-অনৈসলামিক, শরয়ি-গয়রে শরয়ি, পার্থক্য করার যে প্রবণতা, তা আমাদের বিকারের একটি বাস্তবতাকে দেখাচ্ছে। ইসলাম যেখানে জ্ঞানের প্রকরণ ও ব্যবহারসমূহকে উপকারী-অনুপকারী হিসেবে দেখে ও দেখায়। রাসূল সা: পার্থিব-অপার্থিব বলে কোনো বিভাজনের পথ ধরে জ্ঞানকে প্রত্যাখান করেননি। তিনি আশ্রয় চাইতেন এমন জ্ঞান থেকে, যা কল্যাণের বিচারে রিক্ত। তার প্রার্থনা ছিল ‘আমি সেই জ্ঞান থেকে পানাহ চাই যেই জ্ঞান কোনো ধরনের উপকার করে না।’
ওহি থেকে মানুষকে এবং মানুষ থেকে ওহিকে আলাদা করা যেমন বিপজ্জনক, তেমনি জগতবাস্তবতার দক্ষতা থেকে মানুষকে এবং মানুষ থেকে জগতকে আলাদা করা ধ্বংসই ডেকে আনবে। অতএব জ্ঞানে সক্রিয় থাকবে তিন মৌলিক প্রতীতি ও নির্ণায়ক। তা হচ্ছে ওহি, মানুষ ও সৃষ্টিজগত। কেউ অন্য থেকে পৃথক হবে না। এতে পৃথকতা আমাদের একাংশ থেকে আমাদের অন্য অংশকে আলাদা করবে। মানে আমাদের খণ্ডিত করবে, বিচ্ছিন্ন করবে নিজের থেকে নিজেকে। রিক্ত করবে হয় বস্তুতে, নয় আত্মায়। অতএব আমরা আত্মাকে বিকশিত করব বলে বস্তুগত বাস্তবতা উপেক্ষা করতে পারি না। বস্তুজগতে দক্ষতার ব্যবহার নিশ্চিত করব বলে আত্মাকে গরিব ও ক্ষুধার্ত রাখতে পারি না।
ইলম বা জ্ঞান কখনো কর্মশূন্য হতে পারে না। আমলের যোগ না থাকলে ইলম নিজেকে বিকশিত করতে পারে না। সে হয় নি®প্রাণ। ফলে জ্ঞানের সমন্বয়ী অন্বয় যতটা আবশ্যিক, সমান আবশ্যিক কাজের মধ্যে এর প্রতিফলন। জ্ঞানদক্ষতার ব্যবহারিক বিকাশ এবং বাস্তবতার পরিসরে তার রূপায়ন। এ যেমন ব্যক্তিগত নৈতিকতায়, তেমনি সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি তথা বৃহত্তর বাস্তবতায়। ইসলামপন্থীদের মধ্যে এর প্রতিফলন তিনি কামনা করতেন এবং দ্বীন ও জীবনের গতিশীলতার অভিমুখী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দেন।
স্মরণ করিয়ে দেন, ইবাদতের বিষয়গুলোকে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে বলেছেন, সেগুলো হুবহু সেভাবেই করতে হয় বা হবে। কম করা হলে তা ইবাদতই হবে না। যা যতটুকু যেভাবে করতে বলা হয়েছে। তার চেয়ে বেশি কিছু করলে তা বিদয়াত হিসেবে গণ্য গবে। কিন্তু, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, যা মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত তা কি একেবারেই সুনির্দিষ্ট, একেবারেই আক্ষরিক?
‘একটা গতিশীল জীবনাদর্শ, যা মানুষের জীবনে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী বা সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ পর্যন্ত চলার দাবি’ নিয়ে গতিমান, ‘সেটা যদি অনমনীয় কাঠামোর হয়, তাহলে স্বভাবতই এটি যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। এক পর্যায়ে ভেঙে পড়বে। পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে অ্যাডজাস্ট করতে না পারার কারণে কমিউনিজম যে কারণে ফ্রম উইদিন কলাপ্স করেছে।’
তিনি এ প্রশ্নে মুখোমুখি হন যে, ‘সবকিছুরই যদি পরিবর্তন ঘটে, তাহলে দুনিয়ার সব মানুষের জন্য একটা স্থায়ী বা কালোত্তীর্ণ আদর্শ ও জীবনব্যবস্থার প্রস্তাবনা কি স্ববিরোধী নয়?’
জবাব নিহিত ছিল ইসলামের দার্শনিক ঐতিহ্যে এবং সেটাই তিনি উচ্চারণ করেন ‘স্বতঃপরিবর্তন সত্ত্বেও মানুষের জন্য একটা স্থায়ী জীবনদর্শন ও জীবনব্যবস্থা থাকা দরকার। কেননা, যত পরিবর্তনই হোক না কেন, মানুষের বেসিক ফিজিক্যাল, মেন্টাল ও মোরাল এনটিটি বা সত্তার বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটে না। মানুষ মানুষ হয়েছে এসব স্থায়ী বৈশিষ্ট্যের কারণে। এ কারণে মানুষের জন্য একটি স্থায়ী আদর্শ ও জীবনবিধান থাকাই স্বাভাবিক। এ ধরনের কালোত্তীর্ণ হিসেবে কোনো কিছু যদি প্রস্তাব করা হয়, তাহলে সেটাকে হতে হবে যুগোপযোগী হিসেবে নির্মাণযোগ্য বা পঁংঃড়সরুধনষব.
শাহ আবদুল হান্নানের ছিল নানা পরিসরে বিস্তৃত বিবেচনা। তার বিবেচনা ও প্রস্তাবনাসমূহের সাথে একমত হতে হবে, তা জরুরি নয়। কিন্তু বিনা দলিল ও বিশ্লেষণে তাকে উপেক্ষা করা যায় না। ভিন্নমতকে তিনি স্বাগত জানাতেন। নিজেই তার সাথে ভিন্নমত করেছি ইসলাম ব্যাখ্যার নানা ক্ষেত্রে। এখতেলাফ বা ভিন্নমতকে খেলাফ বা বিরোধিতা ভাবার সঙ্কট তার মধ্যে দেখা যেত না।
এই যে জ্ঞান, চিন্তা ও কর্মসমন্বয়ের দাবি, শাহ আবদুল হান্নান সেখানে কেবল জ্ঞান ও চিন্তার ভ্রমণে উপনীতি হননি, বরং নিজের জীবনকে তার বাস্তব রূপায়নে বিভাষিত করেছেন। যার আন্তঃসলীলে প্রগাঢ় বিশ্বাস ও নিরাপস নৈতিকতা এবং প্রবল- শীলিত দক্ষতা ও জ্ঞানপ্রজ্ঞা ছিল একাকার। তার চিন্তা ও দর্শন কখনো তার যাপিত জীবনের সাথে ভিন্নমত করেনি। বরং উভয়েই ছিল উভয়ের সহযোগী, ব্যাখ্যাতা ও সহযাত্রী।
এই ঐচিত্য তাকে প্রয়াসী করে বুদ্ধি ও চিত্তবৃত্তির সেই প্রসারে, যা সমাজের নিরাময়ে সক্রিয় হবে। যুবকরা ছিল এ পথে প্রধান অবলম্বন। যেমনটি দেখিয়েছে মানবপ্রগতির ইতিহাস এবং ধর্মসত্যের প্রতিষ্ঠার পরম্পরা। অতএব যুবকদের শিক্ষা ও পথপ্রদর্শনে গঠন করলেন পাইওনিয়ার, নারীদের জন্য গঠন করলেন উইটনেস। কেননা, নারীদের সক্রিয়, সক্ষম ও দক্ষ প্রয়াসকে উপেক্ষা করলে কোনো পরিবর্তন ও সংস্কার স্থিতির ঘর খুঁজে পায় না। সমাজ-রাষ্ট্রের চাবিকেন্দ্রগুলোতে নজর দিয়েছিলেন। কুরআনের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ডিগ্রিধারী তার মাধ্যমে কুরআনের আলোক লাভ করে নিজের এমন দারিদ্র্য প্রত্যক্ষ করতেন, যার মধ্যে তিনি ছিলেন ইতোপূর্বে। কিন্তু এই দারিদ্র্য সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। সর্বস্তরের আমলা ও পেশাজীবীদের সত্য ও কল্যাণের পথে আহ্বায়কের কাজ করেছেন, শিক্ষকের ভূমিকা উদযাপন করেছেন। ফলে যে মাত্রায় তিনি চিন্তাবিদ, সেভাবে প্রায়োগিক থাকতে চেয়েছেন।
এই দ্বিবিধ সংশ্লেষের উত্তম নজির বহন করে তার বিচরণক্ষেত্র শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রশাসন, সমাজসংস্কার, গবেষণা, রাজনৈতিক তাত্ত্বিকতা, দাওয়াহ এবং শিল্পপৃষ্ঠপোষকতা। এসব ক্ষেত্রে উচ্চমার্গীয় সাফল্য ও পথিকৃতি তাকে শুধু আপন কালের এক নায়কের জায়গা দেয় না, কালাতিক্রমী বিভাও দান করে। তিনি এভাবেই হয়ে ওঠেন আমাদের বিচিত্র অসুখ ও দারিদ্র্যের মধ্যে এক স্বতোশ্চল কর্ম ও সৃষ্টিপ্রচুরতার প্রবাহ, যা সিক্ত করেছে চলমান ইতিহাসের মৃত্তিকাকে, নতুন উর্বরতার ঋতুকে আমন্ত্রণ করবে বলে!