স্মৃতিচারণ : জীবনের গল্প
স্মৃতিচারণ : জীবনের গল্প - অন্য এক দিগন্ত
‘বিলীয়মান কালের (সময়) শপথ! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তারা ব্যতীত-যারা ঈমান আনে, সৎ কাজ করে, পরস্পর পরস্পরকে হক ও সবরের পরামর্শ দেয়।’
- সূরা আল আসর
আসলে জীবন মানে কিছু সময়ের অবকাশ। একজন মানুষ পৃথিবীতে যতটুকু সময় অবস্থান করছেন এটাই তার জীবন বা হায়াত নামে অভিহিত। কুরআন মজিদের উল্লিখিত সূরার প্রথম আয়াতটি আমাদের হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে যে, তোমার হায়াত বা অবকাশ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সময় বহমান, প্রতিটি মুহূর্ত হারিয়ে যাচ্ছে মহাকালের অতল গর্ভে। কালস্রোতকে না ফিরিয়ে আনা যায়, না থামিয়ে দেয়া যায়।
অনিশ্চিত ও ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে সবারই কিছু স্বপ্ন থাকে, থাকাই স্বাভাবিক। এ স্বপ্নগুলোয় মানুষে মানুষে কিছু ভিন্নতা থাকে। তবে কিছু বিষয় আছে যা প্রায় সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ও সাধারণ। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। কত স্বপ্ন যে দেখেছি আর তা পূরণে ব্যস্ত থেকেছি! শুধু ব্যস্ত আর ব্যস্ত! খাওয়ার সময় নেই, ঘুমের সময় নেই, নেই পরিবার-পরিজনকে দেয়ার মতো সময়। সময় নেই ইবাদত-বন্দেগির। স্বপ্ন দেখেছি ভালো পাস করতে হবে, ভালো চাকরি পেতে হবে। কেটে গেছে বহু সময় সেই ধান্ধায়। এরপর কোনো সুন্দরী অপরূপা নারীর সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন, আর তাকে নিয়ে থাকার জন্য সুন্দর একটি বাড়ির স্বপ্ন। সন্তান লালন-পালন করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন। তাদের ভবিষ্যৎ নির্বিঘœ করার জন্য সম্পদ জোগাড়ে পাল্লা দেয়ার স্বপ্ন। কর্মস্থলে প্রমোশনের স্বপ্ন- একটার পর একটা সিঁড়ি পার হয়ে আরো ওপরে ওঠার স্বপ্ন।
কিন্তু ছিল না শুধু জীবনের এই অবকাশ বা হায়াত যিনি দিলেন, তাকে চেনার স্বপ্ন। তার কাছে ফিরে যেতে হবে এটা ভাবার সময়ও ছিল না মোটেই। আজকে পেছন ফিরে দেখি স্বপ্ন তো পূরণ হলো, কিন্তু সময় যে শেষ! প্রমোশন পেতে পেতে অনেক ওপরে উঠলাম, কিন্তু কাক্সিক্ষত সে জায়গায় উঠে দেখি চাকরি জীবন শেষের পথে; এখন ঘরে ফেরার পালা। এত সাধনা করে করে বাড়ি বানানোর স্বপ্ন যখন সফল হলো, তখন দেখি এ বাড়িতে থাকার সময় শেষ; ফিরে যেতে হবে আমার চিরন্তন আবাস স্থলে, আসল বাড়িতে। কিন্তু সেখানে বাড়ি বানানোর কোনো রশদসামগ্রী কি আমি পাঠাতে পেরেছি? তাহলে কোন মরীচীকার পেছনে ছুটলাম সারা জীবন! জীবনটাই বা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল কেন? কেবল তো সব জোগাড়যন্ত্র করে বসলাম! সেদিন মাত্র বাবার হাত ধরে মক্তবে গেলাম, আর এর মধ্যেই কোথায় গেল বাবা আর কোথায় গেল দাদা!
কান পেতে শুনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমাকে ডেকে ডেকে বলছে, ‘আল্লাহর হুকুমে তোমাকে আমরা নোটিশ দিয়েছিলাম বারবার, কিন্তু বেভুলের মতো ছুটেছো তুমি। আমাদের নোটিশ বুঝতে চাওনি মোটেই!’ তাই তো! চোখে চশমা লেগেছে, চুলে কলপ লেগেছে, দাঁতে বাঁধাই লেগেছে; কিন্তু এ সিগনাল বোঝার মতো হুঁশে ছিলাম না আমি। আজকে মনে হচ্ছে জীবনের শুরুতে যদি এ ভাবনাটি ভাবতাম, তাহলে কি বেশি ভালো হতো না? সব স্বপ্নের সাথে এ স্বপ্নটি যোগ করতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হয়। কেননা বাকি স্বপ্নগুলো হচ্ছে ভীষণভাবে ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। আল কুরআনের সতর্কবাণী কি আমাদের কানে যাচ্ছে? ‘পার্থিব জীবন খেলতামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চয়ই আখিরাতের জীবনই হচ্ছে প্রকৃত স্থায়ী জীবন, যদি তারা বুঝত।’ সূরা আল আনকাবুত : ৬৪
অবসরের কড়চা :
যারে দেখিনি সে বড় সুন্দরী
গ্রাম বাংলায় এমনতরো বহু প্রবচন বা প্রবাদ আছে, যেগুলো খুবই জীবনঘনিষ্ঠ। সেগুলোরই একটা এমন, ‘যারে দেখিনি সে বড় সুন্দরী; যার রান্না খাইনি সে বড় রাঁধুনী।’ আমি যতটা বুঝেছি, অজানা-অচেনা সম্পর্কে মানুষের কল্পনামিশ্রিত ধারণা সবসময় অতিরঞ্জিত হয় এটাই এ ধরনের প্রবচনের মূল কথা। আমার আজকের বিষয়টিভাবের দিক থেকে কাছাকাছি হলেও অবয়বটা উল্টো। সেটি এভাবে বলা যায়, যা দেখিনি তা বড় কুৎসিত; যা খাইনি তা ভয়ঙ্কর তিতা। অবসর জীবন সম্পর্কে এমনই একটা ধারণা নিজে না করলেও আশপাশ থেকে কারুর কথায় এমনটাই মনে হচ্ছিল।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই আমার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল হিসাব মাফিক। চৌদ্দ সালের মাঝামাঝি থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিছু পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। জানতাম ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ এটা যেমন অনিবার্য সত্য, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবনেরও সমাপ্তি অবশ্যম্ভাবী। নিজের পরিকল্পনা গুছিয়ে নিচ্ছিলাম আর অনাগত সেই দিনটির অপেক্ষা করছিলাম ঔৎসুক্য ও আগ্রহ নিয়ে। অবসর নিয়ে আমার জল্পনা-কল্পনা ছিল খানিকটা রঙিন। ছকে বাঁধা জীবনটা কেমন যেন পানসে লাগছিল। মনে হচ্ছিল অবসর মানেই তো মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে ওড়া! ছুটব আর গাইব, ‘কোথাও আজ হারিয়ে যেতে নেই মানা।’ এভাবে অবসর জীবন সম্পর্কে একটা রঙিন ও চিত্তাকর্ষক ছবি এঁকে যাচ্ছিলাম মনে মনে। কিন্তু সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ মাঝে মধ্যে আমার এ স্বপ্নের রঙিন জাল ছিঁড়ে দিতেন। তারা অবশ্য হিতাকাক্সক্ষী হিসেবেই আমাকে সতর্ক করতেন। বলতেন অনেকেই অবসরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, বিমর্ষতায় ভোগেন। আমার মিসেস তার এক পরিচিতজনের স্বামীর গল্প শুনিয়েছিলেন, তিনি না কি অফিসের সময় হলেই জামা-কাপড় পরে ঘর থেকে বাইরে যেতেন এবং কোনো পার্কে গিয়ে বসে থাকতেন; আবার বিকেল হলে বাসায় আসতেন। কথাগুলো শুনে কৌতুক বোধ করতাম আবার মনে মনে ভয়ও পেতাম। আমার মন বলতো, ‘তোমার এমন হওয়ার কোনো কারণ নেই, তোমার অনেক কাজ আছে। তুমি খোদার বান্দা, মৃত্যুর আগে তোমার অবসরের সুযোগ কোথায়?’ হৃদয়ের ভেতর থেকে আত্মার এ কথাগুলো আমাকে সাহস জোগাতো এবং অবসরের অনাগত দিনগুলো আমার কল্পনায় সর্বদা রঙিন হয়েই থাকত।
যার হাতে জীবনের নাটাই, আমার সে মালিকের ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত আমার অবসর বিলম্বিত হয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এলো। আগামীকাল ৪ এপ্রিল অবসরের দু’মাস পূর্ণ হবে। সহকর্মীদের কেউ কেউ, শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই খোঁজখবর নিচ্ছেন, ফোন করছেন, কেমন আছি জানতে চাচ্ছেন, শুনতে চাচ্ছেন কী করে দিন কাটাই, এত বড় পজিশন থেকে ঘরে ফিরে কেমন লাগছে ইত্যাদি। সে দিন একজন ফোন করে বলছিলেন, ‘আপনাকে দেখতে যাব। এখন আপনাকে কেমন দেখায়, দেখতে ইচ্ছে করছে।’ দরদি মনের এ সব ভাই-বোনের জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা রইল। আমার জবাব, ‘ভালোই তো আছি। আর সময় কাটানো? সময় তো ভাগেই পাচ্ছি না, কাজেই কেমনে কাটাই তা তো টের পাচ্ছি না। মনে হয় আরো সময় দরকার। তবে দেখতে বোধ হয় আগের মতোই লাগবে। এ ক’দিনে সব চুল সাদা হয়ে যায়নি। বছর তিনেক আগে অবসর শুরু হলেই বোধ হয় আরো ভালো হতো। অবশ্য আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্তই সবচেয়ে ভালো। পদ-পদবিকে আমার কাছে কখনো দায়িত্ব ও কর্তব্যের চেয়ে বড় কিছু মনে হয়নি। হ্যাঁ, কাজকে উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। এখন তাই কী ছিলাম, ক্যায়ছা বড় ছিলাম না কি ছোট ছিলাম এগুলো সারা দিনেও মনে পড়ে না; কোনো দাগ কাটে না এখনকার প্রাত্যাহিক জীবনে। এটিকে আমার মালিকের রহমত হিসেবেই আমি মনে করি এবং তার কাছে সিজদাবনত হই।’
অবসরে সবচেয়ে বড় সাপোর্ট হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। যে দিন অফিস থেকে ফেয়ারওয়েল নিয়ে বাসায় ফিরলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ঘরের দরজায় গিন্নি, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী, পুত্রবধূরা ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে অভ্যর্থনায় দাঁড়ানো। আনন্দে দু’ফোঁটা অশ্রুতে চোখের কোনা সিক্ত হয়ে উঠল। পরিবারের সাথে অবস্থানের মুহূর্তগুলো অসম্ভব আনন্দের এবং নিসন্দেহে আল্লাহর বিরাট রহমত! আমার বুঝে আসে না একজন মোমিনের সময় কাটানো সমস্যা কোথায়? এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে গনিমত মনে হয়। মসজিদ, নামাজ, তিলাওয়াত, মর্নিংওয়াক, মন ভরে পড়াশোনা, লেখালেখি, আপনজনদের খোঁজখবর নেয়া, রক্ত সম্পর্কিত দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের খোঁজ রাখা, পরিবারকে সময় দেয়া, কিছু সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করা। এর পরে সময় কোথায় যে, সময় কাটে না? এ কাজগুলো প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবনে চাইলেও তো ভালোভাবে করার অবকাশ ছিল না। বিষণœতা আর হতাশা কেন হবে আমি বুঝি না। এগুলো থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই। বাকি থাকে অসুখ-বিসুখ আর মৃত্যু। এগুলো তো জীবন-মরণের মালিকের সিদ্ধান্ত, এর সাথে অবসরের কী সম্পর্ক? চুপি চুপি বলে রাখি আগামীকাল ৪ এপ্রিল ‘অজুফা’র সাথে আমার গাঁটছড়া বাঁধার ৪৫তম বর্ষপূর্তি। শৈশবের সেই খেলার সাথী জীবনসাথী হিসেবে হাত ধরেছেন, আজ পঁয়তাল্লিশ বছর হয়ে গেল। সেদিনের সাথে এ বছরের ৪ এপ্রিলের মিল আছে। ১৯৭৩ সালের ৪ এপ্রিল আমি বেকার ছিলাম; ২০১৮ সালের এ দিনেও আমি বেকার। কিন্তু আমাদের ভালোবাসাবাসির কোনো বেকারত্ব নেই! পার্থক্য : সেদিন ছিলাম দু’জনেই ঝরনার মতো উচ্ছল, একে-অপরকে আবিষ্কারের নেশায় মগ্ন; আজ দু’জনে সমুদ্রের মতো প্রশান্ত-তৃপ্ত! একে অপরের মাঝে লীন! একের চোখের তারায় অপরের প্রতিবিম্ব। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী হলে বলতাম, ‘মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম।’
অনেক ধন্যবাদ অবসর জীবনকে! অনেক কৃতজ্ঞতা আমাদের মহান দয়ালু মুনিবকে!
ইয়াতিমের কান্না
হাসপাতালের লবিতে ডেডবডি একটি স্ট্রেচারে শোয়ানো। চার দিকে লোকজন ঘিরে আছে, আপনজনেরা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। কিছু লোক, যারা হাসপাতালে আসছেন বা যাচ্ছেন, তারাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। সাত আট বছরের একটি ছেলেকে তিন-চারজনেও ধরে রাখতে পারছে না। ছুটে গিয়ে মৃতদেহটি জড়িয়ে ধরছে আর আব্বু আব্বু বলে কাঁদছে। তার বুক ফাটা চিৎকারে উপস্থিত প্রায় সবারই চোখ সিক্ত। আপনজনদের কেউ কেউ বলছিলেন : বাবার কাছে শোয়া, বাবার সাথে খাওয়া আর বাবার কাছেই তার সব আবদার ছিল। সবার ছোট হিসেবে বাবাও বাইরে থেকে এলেই তার খোঁজ নিতেন। ব্রেইন স্ট্রোকের পরেও হাসপাতালে বসে বাবা তাকে খুঁজতেন। একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে লাশ তুলে দিয়ে বেদনাবিধুর মনে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসছিলাম। ছেলেটির বুক ফাটা করুণ কান্না তখনো যেন আমার বুকটাকে বিদীর্ণ করছিল। মৃত মানুষটি আমার চাচাতো ভগ্নিপতি মোখলেসুর রহমান। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রী ও তিনটি নাবালক ছেলে রেখে চলে গেলেন তার প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম কী হবে এই পরিবারের? একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি চলে গেলেন। ছোট্ট এই অবুঝ বালকটি কাকে জড়িয়ে ধরবে আব্বু বলে? তার আবদারের জায়গাটুকু নদী ভাঙনের মতো বিলীন হয়ে গেল চিরতরে। ওর কথা ভাবতে গিয়ে দুনিয়ার তামাম ইয়াতিমের মুখ যেন ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। আমি বাবাকে হারিয়েছি তখন আমার বয়স চল্লিশ বছর, যখন আমি পাঁচ সন্তানের পিতা। তারপরেও বাবা চলে যাওয়ার পর মনে হলো মাথার ওপর থেকে একটি আশ্রয়, একটি ছায়া সরে গেল আর প্রচণ্ড রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আজো যেন সে ছায়ার অভাব বোধ করছি। একটি শূন্যতা আজো বুকের মাঝে হু হু করে বয়ে চলছে। তাহলে এই ইয়াতিম শিশুগুলোর কী অবস্থা? ওদের চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিমান সর্বোপরি কার প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে অবসান ঘটাবে তাদের সব ব্যথা-বেদনা আর দুঃখ-কষ্টের বোঝা? এখানেই সমাজের সক্ষম লোকদের দায়িত্বের বিষয়টি চলে আসে। সক্ষম প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে ইয়াতিম শিশুদের দায়িত্ব নিতে। সহমর্মিতা আর সহযোগিতায় পূর্ণ একটি দরদি সমাজ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে। প্রতিটি ইয়াতিম শিশু যেন অনুভব করে এ সমাজে তাদের বাবা না থাকলেও দরদি অভিভাবকের অভাব নেই। বাবার প্রশস্ত বুকে মুখ লুকানোর সুযোগ না থাকলেও অনেকেই তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে খোঁজখবর নেয়। তার পছন্দের লাল জামাটা কিনে দেয়ার মতো আপনজনেরা সমাজে আছে।
ইসলাম ও ইসলামের নবী সা: ইয়াতিমদের সাথে সদাচারণের ব্যাপারে যথেষ্ট তাকিদ দিয়েছেন এবং এ কাজটিকে খুবই মর্যাদা দিয়েছেন। প্রিয় নবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ইয়াতিমের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেবে, তার হাতের নিচে যত চুল পড়বে, আল্লাহতায়ালা তাকে তত বিনিময় প্রদান করবেন।’ অন্য হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো ইয়াতিমের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে, সে আর আমি জান্নাতে এ রকম পাশাপাশি থাকব। এ কথা বলে রাসূল সা: হাতের তর্জনি ও মধ্যমা আঙুলকে দেখালেন।’ সূরা আল মাউনে আল্লাহ তায়ালা যারা ইয়াতিমের খাবার দিতে নিরুৎসাহিত করে তাদের আখেরাত অস্বীকারকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এভাবে অনেক আয়াতে কারিমায় আল্লাহতায়ালা ইয়াতিমদের অধিকারের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং এদের প্রতি দয়া ও সদাচরণের প্রশংসা করেছেন। এক কথায় পিতা নামক স্নেহ, মমতা ও নির্ভরতার আধার থেকে যারা বঞ্চিত, তাদের বিষয়ে ব্যক্তি ও সমাজের কর্তব্যের বিষয়ে অনেক তাগিদ রয়েছে আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহতে।
আসুন না স্নেহ ও মমতাবঞ্চিত এ সমস্ত মানব শিশুর জন্য আমরা অভিভাবকত্বের হাত বাড়াই। সম্ভব হলে প্রত্যেকে কমপক্ষে একজন ইয়াতিমের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিই আর পরকালের কঠিন দিনে মুহাম্মদ সা:-এর প্রতিবেশী হওয়ার আশায় থাকি। না পারলে সাধ্যমতো আমাদের দান-সাদাকার একটা ভালো অংশ সমাজের ইয়াতিমখানাগুলোতে দেই। মনে রাখা খুবই জরুরি যে, আজকে যার সন্তানটি ইয়াতিম হয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখছে, আগামীকাল আমার সন্তানটিও তেমন ভাগ্য বরণ করতে পারে। তাহলে আমরা এমন একটা দরদি সমাজ গঠনে মনোযোগী হই, যেখানে অন্তত এই প্রশান্তিটুকু থাকবে যে, নাবালক সন্তানটি রেখে মারা গেলে সে হয়তো বাবাকে পাবে না, কিন্তু সমাজে সে অভিভাবকহীন হয়েও থাকবে না। এটাই ইসলামের সমাজ জীবনের একটি নমুনা।
সময় কাউকে ছেড়ে কথা বলে না
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে আমি মর্নিংওয়াকে নিয়মিত। বছর দশেক সময় পার হয়ে গেল। এখানে অবস্থান মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের মতো। এই সময়ের মধ্যে কত পরিবর্তন দেখলাম! পরিবর্তন দেখলাম সংশ্লিষ্ট এলাকার, পরিবর্তন দেখলাম মানুষের, দেখলাম নিজের মধ্যেও। এক বৃদ্ধাকে দেখতাম নিয়মিত পার্কের গেটের কাছে বসে ভিক্ষা করছে; লোকজন দেখলেই বলছে, ‘কিছু দিয়ে যাও নানু ভাই!’ মাঝখানে সাময়িক অনুপস্থিতি; আবার দেখলাম সেখানেই বসা, তবে ভগ্ন শরীর। বুঝলাম অসুখে আক্রান্ত হয়েছিল। মাস কয়েক পর আবার নেই; প্রায় তিন বছর হতে চলল, আর দেখা নেই। বুঝলাম তার সময় ফুরিয়ে গেছে, আর আসবে না নানু ভাই বলে লোকদের কাছে ভিক্ষা চাইতে।
এক ভদ্রলোককে দেখতাম হাঁটা শেষ করে অনেক রকম শারীরিক কসরত করতেন। ক্লিন শেভড, ঋজু দেহ, তবে কিছুটা খর্বকায়। একদিন বলছিলেন তার বয়স তখন ৭২ চলছে, সেই ২০০৮-এ। বছর তিনেক পরে দেখলাম মুখ ভরা চাপদাড়ি। চেহারার মধ্যে বেশ ঔজ্জ্বল্য। হজ করে এসেছেন। আরো বছর তিনেক পরে দেখি খানিকটা খুঁড়িয়ে হাঁটছেন; তবে নিয়মিত। বছর খানেক আগে দেখেছি অনিয়মিত, নিয়মিত আসেন না বা আসতে পারেন না। সম্প্রতি দেখছি না; হতে পারে প্রতিকূল আবহাওয়ায় আসতে পারেন না। হতে পারে তার সময় শেষ, ফিরে গেছেন না ফেরার দেশে। জনৈক পাটওয়ারী সাহেবকে দেখতাম। ছ’ফুটের চেয়েও বেশি লম্বা, চওড়া বুকের ছাতি, সুগঠিত শরীরের অধিকারী। উনি পার্কে প্রবেশ করলেই টের পাওয়া যেত। কারণ ওনার সাইজের সাথে সঙ্গতি রেখেই বিধাতা ওনার কণ্ঠের আওয়াজ দিয়েছিলেন। হাঁটা শেষে যে জায়গায় আমি কিছু শারীরিক কসরত করি, উনিও ওখানে এসে বসতেন। সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হতো। মাঝখানে আমি কিছু দিন অনুপস্থিত ছিলাম। এরপরে বেশ কয়েক দিন যাবৎ ওনাকে দেখছি না; কয়েকজন সাথীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তিনিও চলে গেছেন তার চিরন্তন গন্তব্যে। ভাবছিলাম, এমন সুঠাম দেহের মানুষ!
পরিবর্তন দেখছি নিজের মধ্যেও। দাড়ি প্রায় সবই সফেদ হয়ে গেছে, কানের পাশের চুল জানান দিচ্ছে, তোমার সময় কমে যাচ্ছে। হাঁটার গতি শুরুর সময়ের চেয়ে কমে গেছে খানিকটা, কিছু কিছু ব্যায়াম বাদ দিয়েছি, দিতে বাধ্য হয়েছি। জীবনের সবচেয়ে রূঢ় বাস্তবতা : সময় কাউকে ছাড় দেয় না। সে তার স্বাক্ষর রেখে যায় সব কিছুর ওপর। এক সময় যে চিত্রনায়িকা বা নায়ক বুকে কাঁপন ধরাতেন হাজারও যুবক-যুবতীর বুকে, সময় তাকে এমন করে নিয়ে আসে, কেউ আর ফিরে তাকাতে চায় না।
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা-মহারাজা, পীর-পয়গম্বর, বাদশা-স¤্রাট কাউকেই ছাড় দেয় না সময় বা মহাকাল। ইতিহাসের জানালা দিয়ে তাকালেই আপনি দেখতে পাবেন কত আলেকজান্ডার, সাইরাস, চেংগিজ-হালাকু-তৈমুর আরো কত শত জন মানুষের সমাজে গজব হয়ে এসেছিলেন! মানুষের ছিন্ন মুণ্ডু দিয়ে মালা গেঁথে পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়েছেন! কিন্তু মহাকালের অমোঘ চাবুকের আঘাতে লুটিয়ে পড়েছেন, কোনো শক্তিমত্তা আর প্রতাপ সময়কে চোখ রাঙাতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং সময় হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান মূলধন। যদি আমরা এটিকে কাজে লাগাতে পারি খোদার দেয়া নির্দেশমতো, সাফল্য ধরা দেবে আমাদের হাতের মুঠোয়। সময় মানেই জীবনের অবকাশ। হাশরের মাঠে যে চারটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদম সন্তান তার কদম ওঠাতে পারবে না, তার দু’টি প্রশ্নই সময় সংক্রান্ত : জীবন ও যৌবন কোনো কাজে লাগিয়েছ। সময় তাই আমাদের ডেকে ডেকে বলছে, হে মানুষ! দাম্ভিক হয়ো না। কিসের তোমার এত অহঙ্কার? ক্ষমতার দাপটে তুমি সত্যকে মিথ্যা বানাচ্ছো, রাতকে দিন বানাচ্ছো, অপরাধীকে নিরপরাধ বলছো আর নিরপরাধকে দোষী বানাচ্ছো। সময়ের জানালায় চোখ রাখো, বোঝার চেষ্টা করো। কোনো শক্তিমান আর অহঙ্কারী দাম্ভিকই আমার চাবুক থেকে পরিত্রাণ পাবে না।
সূরা আসর ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করো হে মন! সময়কে কাজে লাগাও। সময় কিন্তু কাউকে ছেড়ে কথা কয় না।