তুরস্ক-আরব আমিরাত নতুন দিকে!

ইয়াসির ইয়াকিস | Dec 25, 2021 05:40 pm
তুরস্ক-আরব আমিরাত নতুন দিকে!

তুরস্ক-আরব আমিরাত নতুন দিকে! - ছবি : সংগ্রহ

 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান চূড়ান্তভাবে এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে বিরোধ তার জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না।

মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তুরস্কের জোর সমর্থনের কারণে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কাতার ব্যতীত ‘উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদে’র সদস্যরা ব্রাদারহুডের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আমিরাতের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের তিক্ততা শুরু হয়। দোহা এবং জিসিসির অবশিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে তুরস্ক কাতারের পক্ষে দাঁড়ায়। এটা ছিল আরব দেশগুলোর প্রতি তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী নীতির বরখেলাপ বা বিচ্যুতি।
১৯৩০ এর দশকের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি নোমান মিনিমান সিওলুকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তুরস্ককে অবশ্যই আরব দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। তিনি অন্যদের পক্ষাবলম্বন এড়িয়ে যাওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন।

প্রায় ১০০ বছর তুরস্ক এই নীতি মেনে চলেছিল এবং সকল আরব দেশ ও ইসরাইলের সাথে সমদূরত্ব বজায় রেখেছিল। এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতিগ্রহণ করার কারণে তুরস্ক উভয় পক্ষের সাথে যোগাযোগের চ্যানেল উন্মুক্ত করতে পেরেছিল। আরব দেশগুলো আন্তঃআরব দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে একটি পারিবারিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। তারা এতে অনারব দেশগুলোর হস্তক্ষেপ অপছন্দ করে। আরব দেশগুলো কখনো কখনো নিজেরা হয়তো ঝগড়া-কলহে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পরিশেষে তারা সমঝোতায় এসে যায়। কাতার এবং জিসিসির অন্যান্য দেশের মধ্যকার বর্তমান বিরোধও অনেকটা সেই পর্যায়ের। জিসিসি দেশগুলোর সাথে তুরস্কের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বন্ধন রয়েছে। সব দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার নীতি তুরস্ক প্রায় ১০০ বছর ধরে অনুসরণ করেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তুরস্ক একই ধরনের ভুল করে। এ ব্যাপারে আঙ্কারার প্রতিক্রিয়া ছিল সামঞ্জস্যহীন। কারণ আমিরাত এবং ইসরাইল উভয়ের সাথে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানে আরব আমিরাত আর্থিকভাবে সমর্থন দিয়েছে বলে আঙ্কারা দাবি করার পর তুরস্কের সাথে আমিরাতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সরকারপন্থী পত্রিকাগুলো পূর্ণপৃষ্ঠাব্যাপী রিপোর্ট প্রকাশ করে দাবি করে, অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির জন্য আমিরাত তুরস্কে তহবিল- স্থানান্তর করে। ইউএইর এই ভূমিকার প্রমাণ হিসেবে তুরস্কের কয়েকটি মিডিয়া জানায়, তারা সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আমিরাতের নিন্দা জানানো এবং এরদোগানের প্রতি সমর্থনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল।

তুরস্কের মিডিয়ায় কয়েক মাস ধরে দেশটির আন্ডারওয়ার্ল্ড অপরাধ জগতের নেতা সিদাত পিকারকে নিয়ে বেশ আলোচনা ও বিতর্ক জমে ওঠে। সিদাত পিকার কয়েকটি দেশে আসা-যাওয়া করার পর দুবাইয়ে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সেখান থেকে তুরস্কের অতীত ও বর্তমান সরকারের খারাপ কিছু ভিডিও তৈরি করে প্রচার করতে থাকেন। আমিরাত কর্তৃপক্ষ তাকে এ ধরনের ভিডিও পোস্ট করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেন। এখন পিকার ক্ষমতাসীন একে পার্টির রাজনীতিবিদদের সুনাম ও সুখ্যাতির জন্য সমানভাবে ক্ষতিকর পোস্ট ও টুইট করে যাচ্ছেন। এই বিষয়টি সম্ভবত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করা হয়নি। যাই হোক না কেন, আমরা হয়তো ধারণা করতে পারি উভয় দেশের নিরাপত্তা বিভাগ পর্যায়ে এটা হয়তো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করা হবে। লিবিয়ার সঙ্কট তুরস্ক ও আমিরাতের মধ্যে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত এই বিরোধে দুইপক্ষ পরস্পর বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। আঙ্কারা-আবুধাবির সম্পর্কে বরফ গলার পর এবং আগামী ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য লিবিয়ার নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা দেখার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

ত্রিপোলিভিত্তিক ন্যাশনাল অ্যাকর্ডের জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারকে (জিএনএ) সহযোগিতা দানকারী একমাত্র দেশ হচ্ছে তুরস্ক। জিএনএ জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত বৈধ সরকার। এই সরকারে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রভাবিত এমপিদের প্রাধান্য রয়েছে। অপরদিকে রাশিয়া, আরব আমিরাত ও মিসর সরকারে ব্রাদারহুডের প্রভাবকে মেনে নিতে পারছে না। তাই এই সরকারের ব্যাপারে তাদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে।

সৌভাগ্যবশত জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এই নির্বাচন আয়োজনে সম্ভাব্য অনেক রাজনৈতিক-স্টেকহোল্ডারকে সম্পৃক্ত করা হবে। লিবিয়া সরকার লিবিয়ার মাটি থেকে সকল বিদেশী সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে।
তুরস্ক এই আহ্বান নাকচ করে দিয়ে বলেছে, লিবিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি অন্যদের মতো নয়। জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের আমন্ত্রণেই তারা লিবিয়ায় এসেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান গত সপ্তাহে আঙ্কারা সফরের সময় ১০টি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তুরস্কে বিনিয়োগ করার জন্য ইউএই ১০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল বরাদ্দ রেখেছে। এটা তুরস্কের সঙ্কটাপন্ন অর্থনীতি জোরদার করতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এরদোগান খুশি হবেন; কারণ তুরস্ক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে। আর অর্থনীতিতে ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হলে সেটা দেশটির আর্থিক দুঃসময়ে অস্থায়ীভাবে হলেও একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

তুরস্কে আমিরাতের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ উভয় দেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ভালোভাবে মূল্যায়ন করা প্রকল্পগুলোতে আমিরাতের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের ব্যাপারে একটি সুনাম রয়েছে। কিন্তু তাদের তুর্কি প্রতিপক্ষ আলাপ আলোচনা ও দরকষাকষির ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে নেই। এই সফরের গুরুত্ব হলো, দু’দেশের বন্ধুভাবাপন্ন জনগণের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
লেখক : তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন একে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
আরব নিউজের সৌজন্যে

ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us